ঊনচল্লিশের এক এবং অন্যান্য – বাংলাদেশ প্রসঙ্গে

(আমরা কেউ ধর্মে বিশ্বাস করি, কেউ হয়ত ধর্মকে পরিত্যাগ করিনি কিন্তু ধর্ম নিয়ে মাথাও ঘামাই না, কেউ কট্টর নাস্তিক আবার কেউ বা ধর্মনিরপেক্ষ – কিন্তু একটা জায়গায় আমাদের গভীর মিল আছে, আমরা সবাই বাকস্বাধীনতায়  প্রবল ভাবে বিশ্বাসী। আর সেই জন্যই রাজীব হায়দার, অভিজিৎ রায়, ওয়াশিকুর রহমান, অনন্ত বিজয় দাস, নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায়রা যে কথাগুলো বলতে চেয়ে প্রাণ হারালেন সে কথাগুলো যাতে হারিয়ে না যায় তার জন্য আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করে যাব, ওনাদের সঙ্গে আমাদের মতাদর্শের মিল আছে কি নেই সেটা এই মুহূর্তে অবান্তর প্রশ্ন। কথাগুলো পৌঁছে দেওয়ার অভিপ্রায়েই সা্রা বিশ্ব জুড়ে একাধিক ব্লগার কীবোর্ড নিয়ে বসেছেন, সেই লেখাগুলো সঙ্কলিত করে দেওয়া হল পাঠকদের জন্য – তালিকাটি দেখা যাবে এই ব্লগপোস্টের শেষে।)

ঊনচল্লিশের এক – “চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল”।

ঊনচল্লিশের দুই – “রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশী রাষ্ট্রসমূহের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা বা নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত-অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ সংঘটনে প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ সাপেক্ষে ক) প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও ভাবপ্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের, এবং খ) সংবাদপত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল।

বাংলাদেশের সংবিধানের কথা, কথা অমৃতসমান। মানুষই রাষ্ট্র বানিয়েছে, রাষ্ট্র মানুষ নয় কিন্তু শুধু বাংলাদেশ কেন পৃথিবীর প্রায় সব দেশের সংবিধান পড়লেই একটা মেকী নিরাপত্তার ছলনায় বিহ্বল হয়ে পড়তে বেশী সময় লাগে না আমাদের, রাষ্ট্র যেন অতিলৌকিক এক শক্তি – “নিশ্চয়তা দান করা হইল”।

দান করার অঙ্গীকার তো এল কিন্তু কাজটা করবে কারা? রাষ্ট্র? কি এই রাষ্ট্র, কে এই রাষ্ট্র? রাষ্ট্র একটা আদর্শগত ধারণা, মানুষের ব্যক্তিগত বৌদ্ধিক বিকাশের ফসল। আদর্শগত ধারণা বলেই রাষ্ট্রের আদত কাজটা কি সে নিয়ে হাজার হাজার বছর ধরে তীব্র বিতর্ক হয়ে এসেছে, কিন্তু একটা জায়গায় চিন্তাবিদরা একমত হয়েছেন যে সব কিছুর শেষে রাষ্ট্রের আসল কাজটা হল মানুষকে যতটা সম্ভব ভালো রাখা। প্রকৃতি মানুষের কাছে বহু সময়েই প্রবল প্রতিকূল প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দেখা দেয় – খরা হোক কি বন্যা, ক্যানসার হোক কি দারিদ্র্য, ঘরোয়া জঙ্গী হোক কি বিদেশী হানাদার, প্রতিকূলতা যে ভাবেই আসুক না কেন দেশের নাগরিকদের সেই প্রতিকূলতার মুখে যতরকম ভাবে সাহায্য করা যায় রাষ্ট্র সেটা করবে। এবার এই কাজটা করতে গিয়ে রাষ্ট্রের হাতে কতটা ক্ষমতা থাকা উচিত, রাষ্ট্রের কার্যপদ্ধতি নিয়ে আদৌ সমালোচনার জায়গা আছে কিনা এসব নিয়ে তাত্ত্বিক কিন্তু জরুরী বিতর্ক সেই আদিকাল থেকেই হচ্ছে। কিন্তু সেই বিতর্কে ঢোকার দরকার নেই, আজকে আপাতত এটুকু জানলেই চলবে নিজের নাগরিকদের ভালো রাখাই যে রাষ্ট্রের প্রধান কাজ সে নিয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। এটুকু বলে নেওয়া দরকার ছিল কারণ যে মুহূর্তে একটি জনগোষ্ঠী জানাচ্ছে তারা একটি রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত, ধরে নিতেই হবে যে সেই জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক পুরোধারা রাষ্ট্র বলতে কি বোঝায় সেই তত্ত্বটি সঠিক ভাবে অনুধাবন করেছেন। আর বাংলাদেশের মতন নবীন রাষ্ট্রের রাজনৈতিক চিন্তাবিদদের সেটা বোঝার জন্য যে প্রামাণ্য রেফারেন্সের অভাব ঘটেনি সেটা নিশ্চয় অনুমান করে নেওয়া যায়।

কিন্তু তাহলে কেন রাজীব হায়দার, অভিজিত রায়, ওয়াশিকুর রহমানকে আততায়ীদের হাতে প্রাণ দিতে হল? রাষ্ট্র যদি প্রথম বা দ্বিতীয় হত্যাকান্ডটির সময়ে প্রতিকূলতার মাত্রা নিয়ে ওয়াকিবহাল নাও থাকে ওয়াশিকুর হত্যাকান্ডের পর নিশ্চয় নিজেদের ধ্যানধারণা, বিশ্বাসকে আপ-টু-ডেট করে নেওয়া উচিত ছিল। স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে সেটা হয় নি কারণ ওয়াশিকুরের পরেও খুন হয়ে গেলেন অনন্তবিজয় দাস, রাষ্ট্রের সহায়তা চেয়েও বাঁচতে পারলেন না নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায়।

সমস্যাটা কোথায় তাহলে? দুটো সম্ভাবনা – রাষ্ট্র নাগরিকদের ভালো চেয়েও রাখতে পারছে না,  তারা শক্তিহীন অথবা নাগরিকদের ভালো রাখা আর রাষ্ট্রের মৌলিক এবং প্রধান দায়িত্ব হিসাবে পরিগণিত হচ্ছে না।

প্রথম সম্ভাবনাটা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না, কারণ বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে নীলাদ্রি পুলিশের কাছে যখন এফ-আই-আর করতে গেছেন তখন পুলিশ জানিয়েছে যে তারা এফ-আই-আর নিতে অপারগ এবং নীলাদ্রির পক্ষে বাঁচার একমাত্র উপায় হল দেশে ছেড়ে চলে যাওয়া। দুই বাংলার লাখ লাখ মানুষ এবং বহু বিদেশীও এ কথা শুনে চমকে গেছেন, তসলিমা নাসরিন বা আসিফ মহিউদ্দিনের মতন যারা ভাগ্যজোরে আততায়ীদের হাত থেকে বেঁচে গেছেন তারা বহুবারের পর আরো একবার জানিয়েছেন  অবাক হওয়ার কিছু নেই, এটাই ঘোর বাস্তব। সারা পৃথিবীর কাছে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বলে যে আর কিছু থাকছে না এটা রাষ্ট্রশক্তি বুঝতে পারছে না সেটাও হয় না, কিন্তু তার পরেও একের পর এক খুন এবং সংশ্লিষ্ট আততায়ীদের শাস্তিপ্রদানে অক্ষমতা রাষ্ট্রের সার্বিক ব্যর্থতাকেই প্রকট করে।

সিয়েরা লিওন কি সোমালিয়া কি বসনিয়ার মতন ব্যর্থ রাষ্ট্রগুলির পতনের শুরু কিন্তু এই পথেই, যেখানে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা প্রদানে রাষ্ট্রের সার্বিক ব্যর্থতা বাকি পৃথিবীকে জানিয়েছে এই দেশগুলির সার্বভৌমত্ব নষ্ট হওয়ার পথে। কিন্তু বাংলাদেশকে এই দেশগুলির সঙ্গে এক সারিতে বসানো যাবে না; তার একটা বড় কারণ হল ক্ষমতাসীন সরকার ব্লগারদের আততায়ীদের শাস্তি দিলে  সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়ানোর যে ঝুঁকি  থাকে তার থেকে অনেক বেশী ঝুঁকি নিয়েই সাম্প্রতিক কালে ফাঁসিকাঠে চড়িয়েছেন একাধিক মৌলবাদীদের, যাদের প্রধান পরিচয় হল ‘একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী’। দেশব্যাপী দাঙ্গা হাঙ্গামাকে তোয়াক্কা না করে যে রাষ্ট্র মৌলবাদীদের প্রাণ কেড়ে নিতে পারে তাদের তাহলে ব্লগার খুনের রহস্য সমাধানে কিসের এত অনীহা?

এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে কিন্তু মনে হয় দ্বিতীয় সম্ভাবনাটিই অনেক জোরদার – নাগরিকদের ভালো রাখা আর রাষ্ট্রের মৌলিক এবং প্রধান দায়িত্ব হিসাবে পরিগণিত হচ্ছে না। এখানে কিন্তু নাগরিক অর্থে শুধুমাত্র নাস্তিক বা প্রতিবাদী ধর্মনিরপেক্ষ নাগরিকদেরই বোঝাচ্ছি।

অন্য ভাবে বলা যায় নাস্তিক বা প্রতিবাদী ধর্মনিরপেক্ষ মানুষগুলি যে দেশের নাগরিক এই কথাটিকেই প্রকারান্তরে অস্বীকার করা হচ্ছে। দেশের ৯৫% মানুষ (এটা কথার কথা, সংখ্যাটা গুরুত্বপূর্ণ নয়) যে কথাগুলো শুনলে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠছেন সেগুলো বললে রাষ্ট্র তোমার নিরাপত্তার ভার নিতে পারবে না, এটাই হল মূল কথা।

হায় ঊনচল্লিশের এক!

কিন্তু বাংলাদেশের সংবিধান খুঁটিয়ে দেখলে হয়ত এতটা বিলাপ করার জায়গা থাকে না।

রাষ্ট্রধর্ম নিয়ে কি বলছে এই সংবিধান?

বলছে “প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম  ইসলাম, তবে অন্যান্য ধর্মও প্রজাতন্ত্রে শান্তিতে পালন করা যাইবে”। রাষ্ট্রীয় ধর্ম না বলে রাষ্ট্রধর্ম বলাটা বর্তমান পরিস্থিতে বেশ ironic শোনাচ্ছে বটে কিন্তু তার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ কথাটি হল কোনো প্রকার ধর্ম পালনেই আমার অনীহা থাকলে রাষ্ট্র আমাকে কি চোখে দেখবে সে নিয়ে একটিও কথা নেই।  কোনো প্রকার ধর্মপালনে  অনীহা বা যে কোনো ধর্মকেই খুঁটিয়ে বিচার করতে চাওয়াটা ইউরোপীয়ন নবজাগরণের অঙ্গ হিসাবে ধরা যায় – ইউরোপীয়ন নবজাগরণ শেষ হচ্ছে সপ্তদশ শতকে আর আর অষ্টদশ শতকের মোটামুটি শুরুর দিকেই আমরা পাচ্ছি জঁ মেলি (Jean Meslier) , জুলিয়েন ওফরে ডেলা মেত্রি (Julien Offray de La Mettrie), এটিয়েন বনু ডে কন্ডিয়াক (Etienne Bonnot de Condillac) এর মতন নাস্তিক্যবাদের আদি প্রবক্তাদের। পৃথিবী জুড়েই নাস্তিকদের যে প্রবল প্রতিরোধের সামনে পড়তে হয়েছে তাতে দক্ষিণ এশিয়ার প্রান্তে নবজাগরণের আলো ১৯৭২ সালে নাই এসে পৌঁছে থাকতে পারে, কিন্তু নাগরিক স্বার্থেই এখন বোধহয় সময় এসেছে সংবিধান সংশোধন করে যারা ধর্ম পালন করতে চায় না তাদের নিয়েও দুটো কথা বলার।

ইরানের মতন ঘোষনা করে দেওয়া যেতে পারে যে সমস্ত নাগরিককে চারটি বিশেষ ধর্মের একটি বেছে নিতে হবে বা সৌদি আরবের মতন একবাক্যে বলে দেওয়া যেতে পারে যে নাস্তিক্যবাদের পরিণাম মৃত্যু, কিন্তু কিছু একটা বলা হোক যাতে এই তান্ডবলীলা বন্ধ হয়, নাস্তিক বা প্রতিবাদী ধর্মনিরপেক্ষরা যাতে বুঝতে পারেন যে দেশে আদৌ তাঁদের জন্য জায়গা আছে কি নেই।

আবারো বলি, মানুষের জন্য রাষ্ট্র, রাষ্ট্রের জন্য মানুষ নয়। আর তাই ব্যক্তিগত ভাবেও আমাদের কিছু দায়বদ্ধতা থেকে যায়। সেই প্রসঙ্গেও কয়েকটা কথা বলা দরকার। বহু মানুষ এই নয়া নাস্তিক্যবাদের তীব্র বিরোধিতা করছেন,  বলছেন এই নাস্তিক্যবাদ আর ধর্মীয় গোঁড়ামি একই কয়েনের এপিঠ-ওপিঠ। হয়ত তাঁরা ঠিক, হয়ত তাঁরা ভুল কিন্তু এই মুহূর্তে ওই জাতীয় বিরোধিতা নেহাতই মৌলবাদীদের হাত শক্ত করছে। রাজীব-অভিজিত-ওয়াশিকুর-অনন্ত-নীলাদ্রি যে কথাগুলো বলতে চেয়েছিলেন  সে কথাগুলো বলার সম্পূর্ণ অধিকার তাঁদের থাকার কথা ছিল, আমরা যারা সে কথাগুলো শুনতে চেয়েছি তাদেরও সেগুলো শুনতে পাওয়ার সম্পূর্ণ অধিকার থাকা উচিত। মতাদর্শের বিরোধ যাই থাকুক না কেন, এই সহজ কথাটা যে কোনো মানুষেরই না বোঝার কথা নয়, যারা বুঝে উঠতে পারছেন না তাঁদের বোঝানোটা আমাদের দায়িত্ব।

আরো একটা খুন আটকাতেই হবে, রাষ্ট্রশক্তি অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে পারুক আর না পারুক শেষমেশ দায়টা আমাদেরই।

অন্য ব্লগারদের পোস্টগুলি

অভিষেক মুখার্জ্জী  – আইডিয়াKausik Datta – Plight of secular bloggers in Bangladeshতন্ময় মুখার্জ্জী – ধর্ম, ব্লগ আর একঘেয়ে খুন-টুন, তপোব্রত ব্যানার্জ্জী – আহত কলম, রোহন কুদ্দুস – আমার মহানবী, অমৃতরূপা – Know that you have won, সৌরাংশু –  (১৪০) ফিসফাস

পুরনো লেখা

তন্ময় মুখার্জ্জী – ধর্ম, প্রবীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় – অভিজিৎ রায় হত্যা প্রসঙ্গেশিঞ্জিনী সেনগুপ্ত – আজকের খবরে অভিজিৎ মৃত, শিঞ্জিনী সেনগুপ্ত – এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি, কৌশিক দত্ত – Never A Reason To Stop Fighting To Make The World Better,
Nope, not going to write again, অনির্বাণ গুহ – অভিজিৎ vs. অভিজিৎ

5 thoughts on “ঊনচল্লিশের এক এবং অন্যান্য – বাংলাদেশ প্রসঙ্গে

Leave a comment