আত্মগ্লানির অর্থনীতি – প্রসঙ্গ যখন চিট ফান্ড

(গতকাল রিচার্ড থেলার অর্থনীতিতে নোবেল পাওয়ার পর থেকেই একাধিক বন্ধু ফেসবুকে মেসেজ করে বা ট্যাগ করে ‘বিহেভিয়রাল ইকোনমিক্স’ বা আচরণবাদী অর্থনীতি নিয়ে জানতে চেয়েছেন, প্রশ্ন তুলেছেন নিজেদের দৈনন্দিন চৌহদ্দির মধ্যে থেকেই আচরণবাদী অর্থনীতির তত্ত্বকে কী ভাবে বুঝতে পারবেন। 

বছর দুয়েক আগে ‘আরেক রকম পত্রিকায়’ বাংলার চিট ফান্ডের সমস্যাকে বিহেভিয়রাল ইকোনমিক্সের দৃষ্টিকোণ  থেকে দেখার চেষ্টা করেছিলাম। মনে হল লেখাটি হয়ত বিহেভিয়রাল ইকোনমিক্সের প্রয়োগ সম্পর্কে সামান্য কিছু ধারণা দিতে পারে।  তাই বেশ কিছুদিন বাদে সাড়ে বত্রিশ ভাজার পাতায় আবার অর্থনীতির অবতারণা, আলোচনার আশায় রইলাম। ) 

কৃষ্ণকান্ত নন্দী বা গোকুল ঘোষাল নামগুলো চেনা নাই ঠেকতে পারে কারণ এঁরা প্রায় আড়াইশ বছর আগের মানুষ – প্রথমজন গোড়াপত্তন করেছিলেন কাশিমবাজার রাজবাড়ির আর দ্বিতীয়জন ভূকৈলাশ রাজবাড়ির।  দুজনেই উদ্যমী পুরুষ এবং বিস্তর ধনসম্পত্তির মালিক হয়েছিলেন কিন্তু  বাঙ্গালী হিসাবে গর্বিত হওয়ার আগে আপনাদের মনে করিয়ে দিই একাধিক ইতিহাসবিদ মনে করেন এঁদের দৌলতের অনেকটাই সৎ পথে  আসেনি, বিস্তর জমি অসাধু উপায়ে দখল করতে পারাটাই ছিল এঁদের সাফল্যের মূলমন্ত্র। আর এই জমি দখলের কাজটা আরোই সোজা হয়ে গেছিল কৃষ্ণকান্তর সঙ্গে ওয়ারেন হেস্টিংস এবং গোকুলের সঙ্গে হ্যারি ভেরেলস্টের (১৭৬৭ থেকে ১৭৬৯ অবধি ইনি ছিলেন বাংলার গভর্নর) দহরম মহরমের দরুণ – প্রশাসনের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ সাহায্যে এনারা গায়ের জোর, জাল কাগজপত্র দাখিল, তহবিল তছরুপ জাতীয় পন্থার কোনোটাই বাকি রাখেননি নিজেদের জমিদারি বাড়াতে গিয়ে।
শুধু কৃষ্ণকান্ত নন্দী বা গোকুল ঘোষাল নন, দু’শ- আড়াই’শ বছর আগের একাধিক বাঙ্গালী এভাবেই গড়ে তুলেছিলেন নিজেদের জমিদারি, সব গল্প লিখতে গেলে আস্ত একখানা বই হয়ে যায়।  টাইম মেশিনে করে আঠারোশ শতকের বাংলায় ফিরে গেলে আপনার ‘Déjà vu’ হতে বাধ্য কারণ সাম্প্রতিক অতীতে এই একই প্রেক্ষাপট দেখে দেখে আপনার চোখ পচে গেছে। সুদীপ্ত সেন-ও প্রায় এক দশক ধরে সমাজের মাথা হয়ে বসেছিলেন এবং বলা বাহুল্য যে রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক সঙ্গ ছাড়া চিট ফান্ডের কারবারী সুদীপ্ত রিয়াল এস্টেটের ব্যবসাতেও অসামান্য ‘সাফল্য’ দেখতে পেতেন না। ওপরমহলের দুর্নীতি সেদিন-ও ছিল, আজ-ও আছে, লঙ্কায় যাঁরাই গেছেন তাঁদের কেউই দশ মুখ এবং কুড়ি হাতে ভোগের সুবিধাটুকু ছাড়েননি। কিন্তু তারপরেও একটা চোখে পড়ার মতন তফাৎ রয়ে যায় – কৃষ্ণকান্ত বা গোকুলদের শিকার যাঁরা হয়েছিলেন তাঁদের প্রায় সবাইকেই বাধ্য করা হয়েছিল কিন্তু সারদা এবং হাজারখানা অন্য Chit Fund এর ক্ষেত্রে অধিকাংশ মানুষ-ই স্বেচ্ছায় টাকা রেখেছেন। তাঁদেরকে প্রলোভন দেখানো হয়েছে, তাঁদেরকে ঠকানো হয়েছে সব কিছুই সত্যি কিন্তু তারপরেও প্রশ্ন থেকেই যায় যে পশ্চিমবঙ্গের মতন রাজ্যে যেখানে চিট ফান্ডে টাকা হারানোর ইতিহাস বহু বছরের সেখানে কেন মানুষ জেনেশুনে টাকা রাখেন? কী ভাবেই বা এঁরা বিশ্বাস করেন যে সারদার মতন একটি সংস্থায় সুদের হার কুড়ি থেকে তিরিশ শতাংশ হতে পারে যেখানে প্রাইভেট ব্যাঙ্কে-ও সুদের হার আট শতাংশ-ও ছাড়ায় না? প্রশ্নটা আজ বেশী প্রাসঙ্গিক কারণ দেখা যাচ্ছে ঝুলি থেকে বেড়াল ক্রমেই বেরোচ্ছে, সারদার থেকেও বড় মাপের জালিয়াতি হয়ত ঘটে গেছে আমাদের অজান্তে।

 

গ্রামাঞ্চলে এই জালিয়াতির শিকার বেশী লোকে হয়েছেন, তার অন্যতম একটা কারণ ব্যাঙ্কিং এর সুবিধা সে সব জায়গায় প্রায় নেই। শুনতে অবাক লাগলেও এ কথা সত্যি যে শুধু ‘সারদা’ নামের ওপর বিশ্বাস করে অনেক মানুষ টাকা রেখেছেন কারণ সারদা নামটি বিশ্বাসের প্রতীক, ব্যবসার নয়। এ সব কিছু ধরে নেওয়ার পরেও মনে রাখতে হবে ঠিক একই ধরণের জালিয়াতি কয়েকশ বছর ধরে পৃথিবীর সর্বত্র ঘটে আসছে। যে কোনো জালিয়াত চিট ফান্ডের শুরুর সাফল্য আসে নতুন বিনিয়োগ থেকে আসা টাকার মাধ্যমে পুরনো সুদ মিটিয়ে। ব্যাপারটা এরকম ভাবে ভাবতে পারেন – ভবিষ্যৎ-এ যে টাকা আসবে তার মোতাবেক আপনি বর্তমানের ধার শোধ করছেন এবং এ মুহূর্তে নিজের খরচখরচা মেটাচ্ছেন।  যে অবিশ্বাস্য সুদের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে তাতে বুঝতেই পারছেন যে বিনিয়োগকারীর সংখ্যা ক্রমান্বয়ে না বাড়লে এই টাকা চিট ফান্ড পাবে না, আবার বিনিয়োগকারীর সংখ্যা যত বেড়ে চলবে  ততই বাড়বে  সুদের দায়। একটা সময় আসতে বাধ্য যখন ভবিষ্যতের বিনিয়োগ পরিমাণটি বর্তমানের সুদের পরিমাণের তুলনায় নগণ্য হয়ে দেখা দেবে, যেহেতু চিট ফান্ডটির আলাদা করে লাভের মুখ দেখার সম্ভাবনা নেই অতএব পুরো সিস্টেমটি ভেঙ্গে পড়তে বাধ্য।

 

কিন্তু এই অর্থনৈতিক তত্ত্ব শুধু সুদীপ্ত সেনের পশ্চিমবঙ্গ নয়, বার্নার্ড ম্যাডফের নিউইয়র্কের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তাই এ তত্ত্ব জানার পরেও প্রশ্ন থেকে যায় আর পাঁচটা রাজ্যের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গের মানুষ এত ঘন ঘন জালিয়াতির শিকার হচ্ছেন কেন? গুজরাট, পাঞ্জাব কী তামিলনাড়ুর মানুষের তুলনায় কী আমরা বেশী লোভী নাকি বেশী বোকা? বলা বাহুল্য যে কোনোটাই  নই।

 

তাই ‘কেন’র উত্তর পাওয়ার জন্য আমাদের ধ্রুপদী অর্থনীতির বেড়া টপকে একটু বেরোতে হবে, শুনতে হবে নতুন প্রজন্মের অর্থনীতিবিদদের কথা যাঁরা মানুষের দৈনন্দিন আচরণের পুঙ্খনাপুঙ্খ বিশ্লেষণ করে অর্থনীতির তত্ত্বে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনছেন। ধ্রুপদী অর্থনীতি জানায় একজন ধনী আর একজন গরীব দু’জনেই দৈনন্দিন জীবনের সিদ্ধান্তগুলি নেবেন নিজের লাভের কথা মাথায় রেখে, সম্পদের ফারাক থাকলেও তাঁরা দুজনেই বুদ্ধিমান মানুষ আর তাই গুণগত ভাবে দুজনের সিদ্ধান্তের মধ্যে ফারাক কিছু নেই। বিহেভিয়রাল ইকোনমিস্টরা জানাচ্ছেন কথাটা ভুল – যে মানুষগুলি সর্বক্ষণ দারিদ্র্যের সঙ্গে যুঝছেন তাঁদের বিশেষত অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রবল প্রতিকূলতা সহ্য করতে হয়। আর সে প্রতিকূলতা কিন্তু বাইরে থেকে আসে না,  এ প্রতিকূলতা মনস্ত্বাত্তিক চাপের। তথাকথিত ‘বিমারু’ রাজ্যগুলি এবং উত্তর পূর্বাঞ্চল বাদ দিলে পশ্চিমবঙ্গের গড় আয় বাকি রাজ্যদের থেকে কম, কিন্তু  দারিদ্র্য শুধু আয়ের হিসাবে নাই আসতে পারে –  আপনার দৈনন্দিন চাহিদাগুলি মেটানোর জন্য দরকারী পরিকাঠামো না থাকলেও কিন্তু আপনি গরীব। তাই শিক্ষা কী স্বাস্থ্য জাতীয় পরিষেবার হাঁড়ির হালের কথা ভেবে যদি সারাক্ষণ আপনার কালঘাম ছোটে,  অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যাপারে আপনার চিন্তাহীনতার একটা বড় সম্ভাবনা রয়ে যাবে। দারিদ্র্য মানে শুধু অর্থ সম্পদের অভাব তো নয়, বৌদ্ধিক সম্পদের-ও অভাব আর তাই হয়ত টাকা বিনিয়োগের মতন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে আমরা বারংবার ব্যর্থ হচ্ছি। যে মুহূর্তে ‘subjective evaluation’ আপনাকে তূলনামূলক ভাবে গরীব দেখাচ্ছে, এ ব্যর্থতা আসতে বাধ্য। সংসার চালানোর মতন টাকা পকেটে থাকলেও মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্ত বাঙ্গালীর আত্মবিশ্বাস তলানিতে ঠেকে গেলে চিট ফান্ড নামক মহামারীর সঙ্গে লড়াই বেশ কঠিন হয়ে পড়বে। একুশ শতকের কৃষ্ণকান্ত নন্দী বা গোকুল ঘোষালদের প্রশাসনিক মদত পেতে দেখলে আত্মবিশ্বাস ফিরে পাওয়ার আরোই কোনো সম্ভাবনা নেই।

এ তো গেল মনস্তাত্ত্বিক প্রতিকূলতার কথা, যার দরুণ চিট ফান্ডগুলির বিনিয়োগকারীদের অধিকাংশই অর্থনীতিবিদদের ভাষায় ‘বাউন্ডেডলি র‍্যাশনাল’, অর্থাৎ তাঁরা পুরোদস্তুর বিচারক্ষম হয়ে উঠতে পারেন না। আর্থিক বা বৌদ্ধিক সম্পদের অপ্রতুলতার দরুণ আরেক সমস্যা এসে উপস্থিত হয় – অনিচ্ছাকৃত অবহেলা। ছেলের স্কুল ইউনিফর্ম কেনার কথা ভাবতে ভাবতে হয়ত মেয়ের পড়ার বই কেনার কথা মনে রইল না বা অবচেতনে সরিয়ে দিলাম দূরের আরেক তারিখে, বাড়িভাড়ার সংস্থান করতে গিয়ে ভুলে রইলাম স্ত্রীর দরকারী মেডিক্যাল টেস্টের কথা, এ জিনিস আকছারই ঘটে।  উপরন্তু এই মানুষগুলির অধিকাংশর জীবিকাই কায়িক পরিশ্রম নির্ভর, ফলত একাধিক অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তে মনোনিবেশ করার সময় বা ইচ্ছা কোনোটাই বিশেষ থাকে না। চিট ফান্ডের অবাস্তব সুদের প্রতিশ্রুতি কিন্তু এই অবহেলার একটা সমাধান হিসাবে এসে উপস্থিত হয়, আর তাই জন্যই বহু ক্ষেত্রেই চিট ফান্ডে বিনিয়োগের সিদ্ধান্তে পরিবারের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যর সায় থাকে।

বাউন্ডেডলি র‍্যাশনাল হওয়ার দরুণ বহু মানুষ নিজের সঞ্চয়টুকু ফেলে না রেখে কোথাও একটা বিনিয়োগের জন্য উঠেপড়ে লাগেন, এই অতি উৎসাহকে অর্থনীতিবিদ জন কেইন্স ১৯৩৬ সালে ‘অ্যানিম্যাল স্পিরিট’ বলে অভিহিত করে গেছেন। পরবর্তী প্রজন্মের অর্থনীতিবিদরা দেখালেন এই অ্যানিম্যাল স্পিরিট বহুলাংশে নির্ভর করে নিজের সামাজিক গোষ্ঠীর সামগ্রিক সিদ্ধান্তের ওপর। আজকে আমার পাড়ার জনা কুড়ি প্রতিবেশীকে চিট ফান্ডে টাকা রাখতে দেখলে আমিও ভীষণ ভাবেই চাইব একই কাজ করতে; এই অ্যানিম্যাল স্পিরিটের কথা কিন্তু চিট ফান্ডের ম্যানেজাররাও জানেন। তাই অধিকাংশ সময়েই এজেন্টরা ভরসার সূচক হিসাবে দেখাতে থাকেন কতজন পড়শী নাম লিখিয়েছেন খাতায়। সমস্যা আরো ঘনীভূত হয় কারণ সমাজের যে স্তরের মানুষরা চিট ফান্ডগুলোর টার্গেট তাঁদের মধ্যে গোষ্ঠীবদ্ধ থাকার প্রবণতা অন্যদের থেকে অনেকটাই বেশী, চতুর্দিকে নেই নেই রবের মধ্যে কোথাও তো একটা ভরসা থাকা দরকার। অর্থনীতিবিদরা আরো দেখিয়েছেন যে মানুষগুলির বিচারক্ষমতা গড়ের অনেক ওপরে তাঁদের মধ্যেও কিন্তু এই অনুকরণ করার প্রবণতা বিশাল ভাবে রয়ে যায়। সঞ্চয়সংস্থাগুলির প্রতিশ্রুতিগুচ্ছ যে নেহাত অলীক এরকম সন্দেহ করেও বহু মানুষ টাকা রাখেন স্রেফ গরিষ্ঠসংখ্যক বন্ধু বা প্রতিবেশী বা আত্মীয় টাকা রাখছেন বলে।

দরিদ্রসীমার আশেপাশে যে মানুষগুলি ঘোরাফেরা করছেন তাঁদের জন্য সঞ্চয় করার সিদ্ধান্তটি সর্বদা উৎসাহব্যঞ্জক নাই হতে পারে। কোনো বিশেষ একটি দ্রব্য ভোগ করে তাঁরা এই মুহূর্তে যে উপযোগিতা পেতে পারেন তা অধিকাংশ সময়েই সঞ্চয়ের উপযোগিতার থেকে বেশী। এটাও মনে রাখা ভালো যে অধিকাংশ মানুষই ভবিষ্যৎ এর পাওনার থেকে অনেক বেশী অগ্রাধিকার দেন বর্তমানের প্রাপ্তিকে। কিন্তু তার পরেও গরীব মানুষ টাকাটা এজেন্টদের হাতে তুলে দেন কারণ তাঁরা ভাবেন টাকা না জমালে তাঁদের দারিদ্র্য ঘুচবে না বা টাকাটা হাতে থেকে গেলে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে এমন কিছু কিনে বসবেন যা নিতান্ত দরকারী দ্রব্যসামগ্রীর মধ্যে পড়ে না। গরীবরা জানেন অনায়াস আত্মনিয়ন্ত্রণ সহজ কাজ নয় অথচ সেটা করার তাড়না থেকেই বহু মানুষ দৈনিক রোজগারটুকু এই চিট ফান্ডগুলোতে রেখে দিতে দ্বিধাগ্রস্ত হন না।

 

সমস্যার একাধিক হাঁ-মুখ কিন্তু সমাধান কোথায়? খেয়াল করলে দেখা যাবে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যর্থতার কারণে মানুষের মধ্যে যে নৈরাশ্য জন্মায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে সেটিই এই সমস্যার উৎসস্থল। তাই নতুন আইন আনলে বা সরকারি নজরদারি বাড়ালেই সমাধান আসবে না, দরকার প্রাতিষ্ঠানিক সাফল্যের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে ভরসা জাগানো। ক্ষেত্র যাই হোক –  প্রশাসন বা রাজনীতি, মানুষের সার্বিক ভরসা ফিরে এলে মুষ্টিমেয় দুর্নীতিগ্রস্ত লোকের সাধ্য হবে না এই জালিয়াতি চালিয়ে যাওয়ার। অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ ব্যানার্জ্জী এবং এস্থার দুফলো তাঁদের বিখ্যাত বই ‘পুওর ইকোনমিকস’-এ লিখেছিলেন দারিদ্র্যের ফাঁদ থেকে বেরনোর জন্য প্রথমেই দরকার একটু আশার আলো, মানুষের মধ্যে উদ্দীপনা জাগিয়ে তোলাটা একটা বড় কাজ। তাই নতুন আইন আনলেই মানুষ ভরসা পাবেন এরকমটি না ভাবাই ভালো, উদ্দীপনা তখনই আসবে যখন তাঁরা দেখবেন পুরনো আইনটির ত্রুটি থাকলেও সেটি ঠিকমতন বলবত হচ্ছে।

 

প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা বাড়ানো নিতান্তই দরকার, কিন্তু তার বাইরে গিয়ে আর কিছু ভাবা যায় কী? হার্ভার্ডের অর্থনীতিবিদ সেন্ডিল মুল্লাইনাথন এবং প্রিন্সটনের মনস্তত্ববিদ এলদার শফির তাঁদের বই ‘স্কেয়ারসিটি’ তে এক নতুন পথের সন্ধান দিয়েছেন। সেন্ডিলদের বক্তব্য প্রতিটি দেশে জাতীয় অর্থনৈতিক সম্পদ (Gross national product)  হিসেব করার সময় বার করা হোক সে দেশের জাতীয় মনস্তাত্বিক সম্পদ কত, ওনাদের পরিভাষায় ‘Gross national bandwidth’। জাতীয় মনস্তাত্বিক সম্পদের হিসাব দেশের সরকারকে জানাবে চরম প্রতিকূল অবস্থায় সে দেশের মানুষ সিদ্ধান্ত নিতে কতটা দড়। মানুষের গড় বৌদ্ধিক সম্পদের পরিমাণ যদি নিতান্তই কম থাকে তাহলে দেশের সরকারকে অর্থসম্পদ বিনিয়োগ করে শিক্ষা দিতে হবে মানুষদের যাতে তাঁরা সঠিক অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। ভারতের কথাই যদি ধরা যায়, এই মুহূর্তে আমাদের কোনো ধারণা নেই দেশের গড় বৌদ্ধিক সম্পদ কত; ফলত ধনী হোন কী গরীব, শহরাঞ্চলের বাসিন্দা হোন কী প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের, ভারতীয়রা কী ভাবে তাঁদের অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন সে ব্যাপারে আমাদের জ্ঞান প্রায় শূন্য।

 

শুধু দেশের সরকারকে নয়, সেন্ডিলরা পরামর্শ দিচ্ছেন প্রতিটি মানুষকেই। ধরুন ওজন কমাতে আপনি হয়রান, আর তাই জন্য প্রতিবার রান্নঘরে ঢুকলেই দোনামোনা করছেন চকোলেট কুকি খাওয়াটা ঠিক হবে কিনা বা অফিস থেকে ফেরার রাস্তায় যে তেলেভাজার দোকানটা পড়ে তার সামনে রোজই দাঁড়িয়ে মাথা চুলকোচ্ছেন।  সেন্ডিলরা বলছেন প্রতিদিনের এই চাপ আপনার সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাকে কমিয়ে দিতে পারে, তাই জন্য একটিবারের সিদ্ধান্তে এই চাপকে নির্মূল করে ফেলুন – দোকান থেকে চকোলেট কুকি আনাই বন্ধ করে দিন বা অফিস থেকে বাড়ি ফিরুন অন্য রাস্তা ধরে। সেন্ডিল এবং এলদারের এই পরামর্শ অনুসরণ করে বলা যায় যে মানুষগুলি চিট ফান্ডে টাকা রেখে প্রায় প্রতিদিনই গভীর আশঙ্কা নিয়ে বাঁচছেন তাঁরা শুরুতেই অন্য পদ্ধতিতে টাকাটি বিনিয়োগ বা সঞ্চয় করলে জীবন কিছুটা সুখের হতে পারে। তবে সে ক্ষেত্রে প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষগুলিকে সনাতনী ব্যাঙ্কিং না হোক অন্তত মাইক্রোক্রেডিট প্রতিষ্ঠানগুলির আওতায় নিয়ে আসাটা একান্তই দরকার।

সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক গবেষণা দেখাচ্ছে দারিদ্র্য মানে শুধু কম রোজগারই নয়, দারিদ্র্য মানে অনিয়মিত রোজগার-ও। পশ্চিমবাংলার মানুষ যে জেনেশুনেও বার বার চিট ফান্ডের ফাঁদে পা দিচ্ছেন তার একটা বড় কারণ গরিষ্ঠ সংখ্যক মানুষ জানেন না অদূর ভবিষ্যৎ-এ আদৌ তাঁরা রোজগার করার সুযোগ পাবেন কিনা। এই মুহূর্তে হয়ত তাঁদের জীবননির্বাহে কোনো অসুবিধা ঘটছে না কিন্তু ভবিষ্যৎ-এর অনিশ্চয়তা মানুষগুলিকে বড়সড় ঝুঁকি নিতে বাধ্য করছে। পশ্চিমবঙ্গের সার্বিক অর্থনীতির ক্রমাগত অবনতি তো একটা কারণ বটেই, যতদিন না সে ক্ষেত্রে উন্নতি ঘটছে চিট ফান্ডের সমস্যা থেকে যাবে। কিন্তু সামনের কয়েক বছরে রাজ্যের অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে যদি বিশেষ তারতম্য না ঘটে তাহলে করণীয় কী কিছুই নেই?

আছে, এ ক্ষেত্রে দরকার একটি দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা। সমীক্ষা করলে দেখা যাবে চিট ফান্ডে যাঁরা টাকা রাখছেন তাঁদের অধিকাংশেরই অর্থনৈতিক পরিকল্পনা বলতে কিছু নেই, মুষ্টিমেয় যে কয়েকজন এ ব্যাপারে ভাবনাচিন্তা করেন তাঁরা আবার পরিকল্পনা মোতাবেক কাজ করে উঠতে পারেন না। দিনের শেষে এজেন্টদের হাতে টাকা তুলে দেওয়াটাই তাঁদের কাছে পরিকল্পনার প্রক্সি। এ কথা সত্যি যে একাধিক কারণে দরিদ্র মানুষদের পরিকল্পনাগুলি বাস্তবায়িত হয়ে উঠতে পারে না এবং আগের অভিজ্ঞতা থেকেই একটা গভীর হতাশা গ্রাস করে, কিন্তু তার পরেও আগাম অর্থনৈতিক পরিকল্পনার (এবং শৃঙ্খলাবোধের) গুরুত্ব কোনোমতেই কমে না। একেবারে হতদরিদ্র মানুষদের এই পরিকল্পনায় সাহায্যের জন্য অবশ্য সরকারের সহযোগিতা নিতান্তই দরকার, ‘আম আদমি বিমা যোজনা’, ‘ইন্দিরা আবাস যোজনা’ বা ‘প্রধানমন্ত্রী জন ধন যোজনা’ র মতন উন্নয়নমূলক প্রকল্পগুলির এ ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। তাই চিট ফান্ডের বাড়বাড়ন্ত মানে হয় পশ্চিমবঙ্গের বেশীরভাগ মানুষ এই প্রকল্পগুলিতে যোগ দিতে পারছেন না অথবা যোগ দিলেও ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার হেরফের হচ্ছে না। কেন? সে আলোচনা অন্য আরেকদিনের জন্য তোলা থাকুক কিন্তু এটুকু অন্তত বুঝতে পারা যাচ্ছে যে রাজ্যের অর্থনৈতিক কাঠামোতে আমূল পরিবর্তন না এলেও অনেক কিছুই করা সম্ভব, সীমিত সাধ্য দিয়েও মানুষগুলিকে বাঁচানো হয়ত খুব দুরূহ একটা কাজ নয়।

One thought on “আত্মগ্লানির অর্থনীতি – প্রসঙ্গ যখন চিট ফান্ড

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s