টার্কিশ কোলাজ – ৫

বসন্তের শুরুই বলা যায়, ইরাণীরা যাকে বলে বাহার। গালাতা টাওয়ারের ওপরে একটা কালো চিল চক্কর কেটেই চলেছে, শহরের  দেড় কোটি লোক বহাল তবিয়তে আছে কিনা সেটা জানতেএকটা বার্ডস-আই ভিউ থেকে কড়া নজর রাখছে। ওই জায়গায় পৌঁছনোর উপায় থাকলে দেখা যেত ত্রিভুজাকৃতি শহরটার পূবের দিকের বাহুটি হঠাৎ যেন সমতল থেকে একটু উঁচিয়ে উঠে গন্ডারের শিঙ -এর মতন একটা আকার ধারণ করেছে, আর সেই শিঙ এর দু পাশে সমুদ্র। উত্তর দিকে বসফরাসের একটা শাখা ঢুকে এসেছে, দক্ষিণে মর্ম্মর  সাগর – সারাক্ষণ একটা অনর্থক ভরসা যুগিয়ে চলেছে এ শহরের মানুষদের, মাভৈঃ, কেউ আসবে না উৎপাত করতে, আঁচড়টুকু পড়বে না এ শহরের গায়ে। সেই অলীক ভরসাতেই বোধহয় মানুষজন দিব্যি খোশমেজাজেই আছে অথচ শেষ তিনশ বছরে তেইশবার শত্রুপক্ষ এ শহরকে আক্রমণ করেছে, যদিও কব্জা করতে পেরেছে একবারই – পরাক্রমী আরবরা নয়, দুর্দান্ত ভবঘুরে জাত বুলগাররা-ও নয়, শেষবার এ শহরের পতন হয়েছিল চতুর্থ ক্রুসেডের নাইটদের হাতে। মার্চ মাসের শুরুতে, যখন শীত তার শেষ কামড় দিয়ে সদ্য বিদায় নিয়েছে এসব পুরনো কথা ভেবে কেউই মন ভারী করতে চান না, গুপ্তচররাও উৎকণ্ঠায় পড়ার মতন কোনো খবর আনছে না তাই সম্রাট প্যালিওলোগোস খোশমেজাজেই আছেন। কিন্তু রজার ক্রাউলের মনে কু ডেকেছে ওই কালো চিল!

কালো চিলের তাৎপর্য কি সেটা ভালো করে বোঝার আগেই কানের কাছে বেশ হেঁড়ে গলায় কেউ ‘ইয়াসিম’ বলে ডাক ছাড়লেন। দেখি এক স্বর্ণকেশী যুবা তাঁর বান্ধবীকে প্রায় দৌড়ে আসতে বলছেন কারণ সাতটা বিশাল হল ঘুরে শেষমেশ নপুংসক গোয়েন্দা ইয়াসিমের দেখা পেয়েছেন ‘ইনসান কিতাপ’ এর স্টলে। ব্যাপারস্যাপার আরো গুলিয়ে যাওয়ার আগে বলে নি, এসেছিলাম ইস্তানবুলের আন্তর্জাতিক বইমেলায় ঘুরতে। আমার অবস্থা সেই নর্ডিক দেবতার (লোকি বোধহয়) মতন যাকে বাকি দেবতারা হাত-পা বেঁধে পাতালে ফেলে রেখেছিলেন, আর শাপ দিয়েছিলেন জল খেতে গেলেই মুখের সামনে থেকে জল সরে যাবে। চতুর্দিকে থরে থরে বই সাজানো, যেমনি ঝকঝক করছে প্রচ্ছদ তেমনি খোশবাই ছড়াচ্ছে নতুন পাতার গন্ধ কিন্তু বিধি বাম, সাত খানা হলের সর্বত্রই শুধু তুর্কী বই। ইংলিশ বই স্রেফ নেই, ঘন্টা দেড়েক খুঁজে খুঁজে বার করেছিলাম একটিমাত্র স্টল যেখানে সর্বসাকুল্যে দশ থেকে বারোটি ইংলিশ বই বিক্রি হচ্ছে। তারই একটি হল রজার ক্রাউলের “কনস্ট্যান্টিনোপল, দ্য লাস্ট গ্রেট সিইজ” – ১৪৫৩ সালের আঠাশে আর ঊনত্রিশে মে, এই দু’দিনে কিভাবে বাইজ্যান্টাইন সাম্রাজ্যের রাজধানী কনস্ট্যান্টিনোপল দখল করে নেন অটোমান সম্রাট দ্বিতীয় মেহমেদ, তারই ইতিবৃত্ত। তার পাশেই সার দিয়ে দাঁড় করানো অরহান পামুকের ইংলিশে অনূদিত সব কটি বই – ‘স্নো’, ‘ব্ল্যাক বুক’, ‘রেড’, ‘মিউজিউয়াম অফ ইনোসেন্স’ ইত্যাদি। ব্রিটিশ যুগল যে বইটি দেখে আহ্লাদিত হয়ে পড়েছিলেন সেটিরও আন্তর্জাতিক বাজারে রীতিমতন ভালো কাটতি –  জেসন গুডউইনের একমেবাদ্বিতীয়ম নপুংসক গোয়েন্দা ইয়াসিম প্রথম আবির্ভাবেই জিতে নিয়েছিল গোয়েন্দা সাহিত্যের শ্রেষ্ট পুরস্কার ‘এডগার অ্যাওয়ার্ড’; ঊনবিংশ শতকের ইস্তানবুলে সুলতানের রাজপ্রাসাদে আচম্বিতে খুন হয়ে যান এক হারেমসুন্দরী, প্রায় একই সময়ে উধাও হন একাধিক রাজ-অফিসার। সুলতানের হুকুমে রহস্য উন্মোচনের দায়িত্ব পড়ে ইয়াসিমের ওপর, সাধারণ খুনের মামলা কিভাবে যোগসূত্র হয়ে দাঁড়ায় একাধিক ষড়যন্ত্রের মধ্যে তাই নিয়ে বেশ টানটান একটা উপন্যাস লিখেছেন জেসন। কিন্তু এডগার পুরস্কার পাওয়া বইয়ে খুন আর ষড়যন্ত্রের বাইরেও কিছু থাকতে হবে, আর সেই কারণেই পুরনো ইস্তানবুলের গলি, বাজার, প্রাসাদ, মসজিদকে চোখের সামনে জ্যান্ত হয়ে উঠতে দেখাটা একটা উপরি পাওনা। কিন্তু রহস্যকাহিনীর ভক্তদের কাছে জেসন গুডউইন চেনা নাম, আমাকে টানল এমন একটা সিরিজ যেটা টার্কি না এলে জানা যেত না। আহমেত উমিতকে বলা যায় তুরস্কের উম্বেরতো একো। অবশ্যই আসল উম্বেরতো একজনই, ‘নেম অফ দ্য রোজ’ লেখা একজনের পক্ষেই সম্ভব। কিন্তু আহমত উমিত-ও হেলাফেলা করার মতন লেখক নন। আজ অবধি খান কুড়ি বই লিখেছেন, সবগুলোই প্রায় সুপারহিট! ইতিহাসের পাতা থেকে রহস্য খুঁজে বার করতে (এবং সমাধান করতেও) এনার জুড়ি নেই। ইংলিশে সর্বসাকুল্যে খান তিনেক বই বেরিয়েছে। তারই একটা হল ‘দ্য দরবিশ গেট’ – পটভূমিকা জুড়ে রয়েছেন জালালউদ্দিন রুমি এবং রুমির স্পিরিচুয়াল গুরু শামস তাব্রিজি । আজ থেকে সাতশ বছর আগে  ইরাণের তাব্রিজ শহর থেকে হঠাৎ একদিন হারিয়ে যান শামস। বহু লোকের বিশ্বাস রুমি এবং শামসের অন্তরঙ্গ সম্পর্ক সহ্য না করতে পেরে রুমিরই কাছের লোকেরা গুমখুন করেন শামসকে, কিন্তু প্রামাণ্য ইতিহাস কিছুই নেই (পড়তে গিয়ে শ্রীচৈতন্যর অন্তর্ধান রহস্য মনে পড়ছিল); এই বই সেই রহস্য নিয়েই। রহস্যের আনাচেকানাচে চমৎকার ভাবে সুফিসাধনার ইতিহাসকে নিয়ে এসেছেন, সিরিয়াস বিবলিওফাইলদের জন্য রেখে গেছেন প্রাচীন সব বইয়ের সূত্র ধরে জাল গোটানোর ইঙ্গিত – আর কি চাই!

jt-dg

ক্লাসে ঢুকেছি, উল্টোদিকে থেকে অ্যাকিলে প্রায় হাঁইমাই করে উঠলো “খাতা, খাতা”। অ্যাকিলে মানে অ্যাকিলিস আর কি, ইটালির ছেলে – ইতালিয়ান, ফ্রেঞ্চ, জার্মান, ইংলিশ, স্প্যানিশ এর পরেও আরো খান  দুয়েক ভাষা জানে। কিন্তু ওর ধারণা গ্রীক বীরের গোড়ালির মতনই তুর্কী হচ্ছে ওর প্রাণঘাতী জায়গা। এক্সপেকটেশন্স ছিল মাস দুয়েকের মধ্যে কথ্য তুর্কীতে রীতিমতন সড়গড় হয়ে যাবে  – আমি অবশ্য এহেন এক্সপেকটেশন্স শুনে হাঁ, তারপর হরিনাথ দে বা নরসিমহা রাও সুলভ জিনের কথা ভেবে চুপ করে গেছিলাম, কিন্তু সে আর হচ্ছে কই?  তারমধ্যে বান্ধবীকে ইস্তানবুল ঘোরাতে গিয়ে আগের ক্লাস মিস হয়েছে। সুতরাং, খাতা খুলে বোঝাতে হল রবিবারের নাম পাজার (রবিবার বোধহয় ছিল এদের হাটবার), রবিবারের পরেই সোমবার আসে বলে সেটা পাজারতেসি, মঙ্গলবার সালে , এই অবধি বেশ তুর্কী নাচন চলছিল। বেমক্কা বুধ আর বৃহস্পতিবারে ফারসি চলে এসেছে – চারসাম্বা আর পারসাম্বে। শুক্রবার অবশ্য ইউনিভার্সাল জুমা, শুক্রের পরেই শনি বলে সেটা দাঁড়াল জুমারতেসি। “গ্রাতসিয়ে, গ্রাতসিয়ে” বলে চলে গেল যদিও ক্লাসের নিয়ম অনুযায়ী বলার কথা তেশেক্কুরলার, কিন্তু বান্ধবীকে সদ্য এয়ারপোর্টে পৌঁছে দিয়ে এসেছে, তাই আর উদব্যস্ত করলাম না। তুর্কী ভাষী শিক্ষিকার আর মিনিট দশেকের মধ্যেই ক্লাসে ঢুকে যাওয়ার কথা এবং শুরুতেই ক্যুইজ, তাই খাতায় চোখ বোলাচ্ছিলাম হঠাৎ কানের কাছে ভারী সুরেলা কন্ঠে কেউ ‘পারদন’ বলে উঠল। এখানে বলে রাখা ভালো আতাতুর্ক তুর্কী ভাষাকে আধুনিক রূপ দেওয়ার জন্য বহু বিশেষজ্ঞকে সংস্কৃতির পীঠস্থান  ফ্রান্সে পাঠিয়েছিলেন, লাটিন আলফ্যাবেট এবং বহু ফ্রেঞ্চ শব্দ তারই ফলশ্রুতি।

ঘুরে দেখি একটি মেয়ে ভারী কুন্ঠিত হেসে খাতাটি চাইছে, অ্যাকিলের মতন সেও ক্লাস মিস করেছে আগের সপ্তাহে। এ অবশ্য দেখলাম তুর্কী ভাষায় ওস্তাদ, সপ্তাহের বিভিন্ন দিনের নামগুলো আগেই জানে, খাতা দেখে একবার চেক করে নিল ঠিক জানে কিনা। তারপর ভারী মোলায়েম হেসে বলল “এক থেকে নয় অবধি মুখস্থ করেছি, ধরবে্ন প্লীজ?” ধরলাম, আট’কে ঠিকঠাক বলল সেকিজ, দশ আর নয় দিয়ে ঊনিশ হয় বলে দিব্যি বলে দিল ওন-দোকুজ, দেড় মানে যে বের বুচুক সেও চকিতে বলে দিল।  আমি এহেন পারদর্শিনী (এবং পারদর্শী) দের ভারী ডরাই, তাই তাড়াতাড়ি অজুহাত দেখিয়ে  খাতায় মুখ গোঁজার আগেই দেখি ফস করে ক্রিয়াপদ নিয়ে প্রশ্ন করছে, আফটার অল আমাকেও ক্যুইজ দিতে হবে কিনা। ওড়া আর জল খাওয়া এক করে দিলাম, গাড়ী চালানোকে বলে দিলাম ব্রেকফাস্ট করছি, জেগে উঠতে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম – সে এক নাজেহাল কান্ড। আমার আসন্ন সর্বনাশে তার মুখে ছায়া ঘনাচ্ছে দেখে তাড়াতাড়ি প্রশ্ন ঘোরাতে হল – “তুমি কি ফ্রেশম্যান নাকি সফোমোর?” প্রশ্ন শুনে কুটিপাটি অবস্থা , বলল “ঈশ্বর মঙ্গল করুন তোমার, আমি পি-এইচ-ডি’র ছাত্রী।” জানতাম প্রতিপ্রশ্ন আসবেই, অ্যাকিলে যাকে বলে ‘পয়েন্ট অফ নো রিটার্ন’, “তুমি কি সিনিয়র ইয়ার?” বলতে বলতেই বোধহয় চোখ গেছে খোঁচা খোঁচা হয়ে থাকা দুইখান সাদা দাড়ির ওপর “নাকি মাস্টার্স?” তাতেও নিরুত্তর দেখে চোখ আরো বড় “ওঃ, আপনিও পি-এইচ-ডি?” এইবার বলতেই হল “নাহ, আমি হলাম গিয়ে পাজারলামা হোজা।” পাঠক, ঘাবড়াবেন না –  পাজার মানে তো বুঝতেই পারছেন আর হোজাও চেনা শব্দ, সেই যে হোজা নাসিরুদ্দীন যাকে সত্যজিৎ মোল্লা বলে পরিচয় করিয়েছিলেন আমাদের সঙ্গে – অর্থাৎ কিনা, মার্কেটিং এর প্রফেসর। ‘লামা’টাও বুঝে ফেলেছেন নিশ্চয়, হ্যাঁ ‘বাবরনামা’ কি ‘বাঙ্গালনামা’ র নামা, মানে বিষয়।

সে বেচারি দেখি ভারী কাঁচুমাচু হয়ে পড়েছে, প্রফেসরকে ক্রিয়াপদ জিজ্ঞাসা করার মতন ঘোরতর অপরাধ খুব কমই আছে। মাফটাফ চেয়ে বলল “আমি কিন্তু হিন্দী সিনেমা ভয়ঙ্কর ভালোবাসি, শাহরুখের কোনো সিনেমাই ছাড়ি না।” আমি মাথা নাড়িয়ে বললাম “নাহ, আমি ওকে টলারেট করতে পারি না।” ভারী অবাক হচ্ছিল কিন্তু হোজার ব্যাপারটা খেয়াল ছিল তাই একটু চুপ করে থেকে বলল “মিস্টার রওশনকেও আমার বেশ লাগে”। বুঝলাম হৃত্বিকের কথা হচ্ছে, আমি তাতেও ঘাড়া নাড়াতে এবার সূচীভেদ্য স্তব্ধতা – বোধহয় ভাবছে কি কুক্ষণে সিনেমার কথা আরম্ভ করেছিলাম। আমার এবার মায়া হল, বললাম “আ্মার ভালো লাগে আমিরকে”। চোখ পুরো জ্বলজ্বলিয়ে উঠল “তাই বলুন। অফ কোর্স, আমিরকে কার না ভালো লাগে। আমার তো ওকে মিস মুখার্জ্জীর কাজিনের সঙ্গে সিনেমাটাতে দারুণ লেগেছিল।” পাঠক, আমার এতক্ষণে খেয়াল পড়ল মেয়েটি ভারতীয় নয়, পাকিস্তানী-ও না। মিস মুখার্জ্জীর কাজিন শুনে এত অবাক হলাম বোধহয় পাক্কা মিনিট খানেক বাদে প্রশ্নটা বেরোল, “এক্সকিউজ মী, তুমি কোন দেশের?” ভারী সপ্রতিভ হেসে বলল “আমি ফারাহ, তেহরানে বাড়ি – আঃ, এতক্ষণে নামটা মনে পড়েছে, কাজল, কাজল।” আমি এত ইম্প্রেসড কি বলব, নিজের স্টুডেন্ট হলে এক্সট্রা ক্রেডিট দিয়ে দিতাম! ওকে আর বললাম না, ‘ফনা’ খুব একটা সুবিধের লাগেনি, ততক্ষণে কানে আসছে “আর রনবীর সিং কে আজকাল আমার দারুণ লাগছে, সোনাক্ষী কি লুটেরা-তে ওজন একটু কমাল?”

থ্যাঙ্ক ইউ বলিউড, অগুন্তিবারের সঙ্গে আরো একবার।