অনেক কিছুর মতনই গানের ব্যাপারেও বাবা আর মার পছন্দের বিস্তর ফারাক দেখতে দেখতেই বড় হয়েছি। মা নজরুল-গীতিতে রীতিমতন তালিম পেয়েছেন, পূরবী দত্তের গান ওনার ভারী পছন্দের; রান্না করতে করতে হয়ত গুনগুনিয়ে উঠলেন “কাবার জিয়ারতে তুমি কে যাও মদিনায়/ আমার সালাম পৌঁছে দিও নবীজীর রওজায়”। সামান্য বিস্মৃত বাংলা আধুনিক গান-ও মার খুব পছন্দের, সন্ধ্যাবেলায় টিভি দেখতে দেখতে হয়ত দু’কলি গেয়ে উঠলেন “বন্ধু তোমার আসার আশাতে, বসে আছি সাঁঝরাতে, তবু তোমার দেখা মেলে না” ইত্যাদি। বাবা মুড ভালো থাকলে তবেই গান, মেনলি কিশোরকুমার; লিরিক্স প্রায়শই গুলিয়ে ফেলেন (নিজে বানিয়েও নেন কখনোসখনো) কিন্তু ইয়োডলিং টা চমৎকার করেন আর অ্যামেচারিশ গলাতেও ‘মস্তি’টা ভালোই টের পাওয়া যায় – রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে শুনিনি কোনোদিন, নজরুল বা ধ্রুপদী সঙ্গীতে বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই।কিন্তু একজনের গান শুনতে দুজনেই অসম্ভব ভালোবাসেন, তিনি মান্না দে। মান্না দের ক্লাসিকাল গান শুনতে শুনতে মা একশো কোটি বার আক্ষেপ করেছেন “একটা দিনের জন্যও যদি ওনার পায়ের কাছে বসে শুধু গান শুনতে পারতাম”; কলকাতার ঘ্যামপ্যাচপেচে সন্ধ্যায় রেয়ারলি যখন বাবাকে অসম্ভব জোভিয়াল মুডে পেতাম, তখনো সঙ্গে সেই মান্না-ই। “কাশ্মীরে নয় শিলঙে-ও নয়” গানের প্রথম স্ট্যাঞ্জাটা গেয়ে যখন “রয়েছে কাছে এইখানে এই, মনে এই, প্রাণে এই” বলে শেষ করতেন, মুখটা বড্ড খুশী খুশী লাগত।
কিন্তু শুধু পারিবারিক সুখের মুহূর্তগুলো তৈরী করার জন্যই মান্না দে আমার সারাটা জীবন জুড়ে রয়ে যাবেন, একথা বললে সত্যের একটু অপলাপ হবে। মান্না দে কে আমিও খুঁজে পেয়েছি নিজের মতন করে, বারবার। ছ-সাত বছর থেকেই আমি বেজায় ঘরকুনো, ভাড়া বাড়ীর একতলায় এক চিলতে একটা ঘরে বসে শুধু বই পড়তাম, অগুন্তি বই – লীলা মজুমদার, সত্যজিত, শরৎ, বঙ্কিম, লুকিয়ে লুকিয়ে ঠাকুমার জন্য আসা নবকল্লোল। মার নতুন ওয়াকম্যানটা আসার পর ঝোঁক চাপল ওয়াকম্যান কানে গুঁজে বই পড়ার (কম বয়সেই মাল্টিটাস্কিং ভালো পারতাম, সাইকোলজির থিয়োরী অভ্রান্ত প্রমাণিত করে এখন আর পারি না)। গোনাগুনতি কিছু ক্যাসেট ছিল, লন্ডনের রয়্যাল অ্যালবার্ট হলে লতা মঙ্গেশকরের অনুষ্ঠানের রেকর্ডিং, হেমন্তর “কোনো এক গাঁয়ের বধূ”, বেশ কিছু রবীন্দ্রসঙ্গীত – নজরুল গীতি আর, আর সুধীন দাশগুপ্তের সুরে তৈরী হওয়া মান্না দের গানের সঙ্কলন। ভাগ্যিস! দুপুরের পর দুপুর কেটে গেছে ওই একটা ক্যাসেট শুনে শুনে, যেমনটি করে মান্না আর সুধীন আমাকে হিপনোটাইজড করে ফেলেছিলেন তেমনটি করে কেউ পারেননি। ২০০২-এ হঠাৎ নেট দুনিয়ার খুঁজে পেয়েছিলাম জার্মানি প্রবাসী তিমিরকান্তি গাঙ্গুলীর ওয়েবসাইট, যেখানে তিনি শোনার জন্য তুলে রেখেছিলেন মান্না দের অসংখ্য বাংলা গান। তখনো ইউটিউব দূর অস্ত, মিউজিকইন্ডিয়া অনলাইন বলিউড নিয়েই ব্যস্ত, রাগা-র মতন ওয়েবসাইট তখনো জন্ম নেয়নি, – আমার এক্সাইটমেন্টটা একবার ভাবুন। বহুদিন ধরে তিমিরবাবুর ওয়েবসাইট ভারী আরাম দিয়েছে, সময় কম থাকলে বেছে বেছে মান্না-সুধীনের কম্বিনেশনের গানগুলোই শুধু শুনতাম, ততদিনে মোটামুটি সে লিস্ট আমার কন্ঠস্থ হয়ে গেছে। আমার ব্যক্তিগত মত – ক্যাজুয়াল গান শুনিয়েদের জন্য মান্না আর সুধীনের জুড়ি বাংলা গানের ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ ঘটনা। বাঙ্গালী মেলোডি ভালোবাসে, আর সেই মেলোডিকে সুধীন আর মান্না যে উত্তুঙ্গ শিখরে পৌঁছে দিয়ে গেছেন, তাকে স্পর্শ করাও প্রায় কল্পনাতীত ব্যাপার। আর এই কথাটা উঠলেই মনটা আরো একটা কারণে খারাপ হয়ে যায় – পুজোর গান, একটা অসামান্য ঐতিহ্যময় ট্র্যাডিশন যা আমরা ধরে রাখতে পারলাম না।
সুধীন দাশগুপ্তের সুরে মান্না প্রথম গান গেয়েছিলেন ১৯৫৯ এর পুজোতে, বেরিয়েছিল “একই অঙ্গে এত রূপ” আর “মেঘলা মেয়ে মেঘেরই”। ষাট দশকটা ছিল সত্যিই সোনার সময়, সুধীনের সুরে ওনার থেকে পেয়েছি বহু গান, “এক ঝাঁক পাখিদের মতো কিছু রোদ্দুর”, “আমি তার ঠিকানা রাখিনি”, “কথায় কথায় যে রাত হয়ে যায়” ইত্যাদি। মান্না দের নিজের প্রিয় গান ছিল অবশ্য “চার দেওয়ালের মধ্যে নানান দৃশ্যকে”। বহু বছর ধরে অবাক হয়ে দেখেছি নতুন শোনা যে গানের মেলোডি মনকে মাতিয়ে দিয়ে যাচ্ছে, তার প্রায় প্রত্যেকটার সুর (কখনো কথা-ও) সুধীনের, আর অফ কোর্স মান্না ছাড়া কে গাইবেন সেই গান? বাংলা রোম্যান্টিক গানের ইতিবৃত্ত লিখতে বসলে বলা বাহুল্য যে মান্না-সুধীনের গানগুলো অনেকটা জায়গা জুড়ে থাকবে। হয়ত কবীর সুমনের মতন নতুনধারার রোম্যান্টিক গান তখনও ওনারা দিতে পারেননি কিন্তু যে গানগুলো দু’জনে মিলে তৈরী করেছেন সেগুলো ফুল-চাঁদ-পাখির বাইরে গিয়েই করা। আর যদি নিতান্তই কিছু ট্যাগ লাগাতে হয় তাহলে হয়ত বলতে হবে আদিগন্ত আকাশ, হারিয়ে যাওয়া রাস্তা, নিভৃতে নীরবে – ক্ষতি কি? এসব তো আর ফিরে পাব না, ওনাদের গানেই একরাশ স্মৃতিমেদুরতা নিয়ে বেঁচে থাকুক। বেঁচে থাকুক তিন ভুবনের পারে, প্রথম কদমফুল, ছদ্মবেশী, পিকনিক এর গান, আমার মতন নিশ্চয় আরো অনেক বাঙ্গালী আছেন যাঁরা মেলোডির জন্য বাঁচেন। আর মেলোডির কথা বাদ দিলেও মান্না দের কাজের ধারা বহুবিস্তৃত, সে নিয়ে বিশদে যাওয়ার দরকার দেখি না এহেন ছুটকো এবং উটকো স্মৃতিতর্পণে। এ প্রসঙ্গে একটা কথা অবশ্য না লিখে পারছি না, পড়োশনের ‘এক চতুরনার’ বলতেই আমরা যেরকম কিশোরের কাজ নিয়ে হইহই করে উঠি, সেটা নিতান্তই আনফেয়ার; মান্না দে-র ওই অসাধারণ ধ্রুপদী সঙ্গত না থাকলে আমার ধারণা গানটা এরকম কালজয়ী হয়ে হয়ত উঠত না। মনমেজাজ খারাপ থাকলে ক্লাসিক বলিউড হেনতেন ভুলে রাগটা গিয়ে পড়ে মেহমুদের অবিশ্বাস্য রকম খারাপ ভাঁড়ামো কিম্বা সায়রা বানুর গায়ে রি-রি ধরানো ন্যাকামোর ওপর(সময় সময় কিশোরের লম্পট চুল কি সুনীল দত্তের কদমছাঁট দেখেও), তখন একমাত্র সেভিং গ্রেস মান্নার গলা। ভাগ্যিস, সুলোচনা রাজি করিয়েছিলেন গানটা গাওয়ার জন্য! মুডি মান্না প্রথমে রাজি হচ্ছিলেন না কিশোরের সঙ্গে ডুয়েট গাইতে, দৃশ্যায়ণটি নিয়ে বেশ আপত্তি ছিল ওনার।
বই-খবরের কাগজ-জনশ্রুতি থেকে মান্না দে কে আমার একটু উন্নাসিক মনে হয়েছে, মনে হয়েছে একটু দূরত্ব রেখে চলতে ভালোবাসতেন। রাজা ভোজ হোক কি গঙ্গু তেলি, সবাই যখন উত্তম-উত্তম করে হেদিয়ে মরছে, মান্না দে কোনোদিন ‘উত্তমবাবু’ ছাড়া অন্য কোনো সম্বোধনের মধ্যেই যান নি। সুধীন প্রসঙ্গে মান্নার বাইট পাওয়ার জন্য এত বছরের আকুতি শুনে শুনেও শুধুই বলেছেন “সুধীনবাবু অভিজ্ঞ এবং গুণী মানুষ ছিলেন”। ইমোশনের বাহুল্য কোনোদিন খুঁজে পাইনি মান্না দের ইন্টারভিউয়ে (একমাত্র ব্যতিক্রম ছিল ওনার স্ত্রীর প্রসঙ্গ, এবং যথার্থ কারণেই; আর পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় আত্মহত্যা করার পরেও একটা হাহাকার খুঁজে পেয়েছিলাম), তাই আলাদা সম্ভ্রম-ও তৈরী হয়েছিল ওনার জন্য। একবার, শুধু একবারই সেটা একটু টাল খায় মান্না দের একটা সাক্ষাৎকার পড়ে, যেখানে হেমন্তকে নিয়ে সামান্য অসূয়ার আভাস খুঁজে পেয়েছিলাম। মনে হয়েছিল কোনো দরকার ছিল না, মনে হয়েছিল বলি আপনি হয়ত এখনো জানেন না কতটা ভালোবাসা বাঙ্গালী (এবং বাকি ভারতীয়রাও) রেখে দিয়েছে আপনার জন্য, মনে হয়েছিল মার অভিজ্ঞতাটা একবার ওনার ৯ মদন ঘোষ লেনের বাড়িতে চিঠি লিখে জানাই – নেতাজী ইন্ডোরে আপনার গানের প্রোগ্রাম ক্যান্সেল হয়ে গেলে কত মানুষ আক্ষরিক অর্থে কাঁদতে কাঁদতে ফিরেছেন শুধু আপনার গান শুনতে পাননি বলে; জলে যাওয়া টাকা, দূরত্ব, লাইনে ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা কোনোকিছুই এর থেকে বেশী অসহনীয় ছিল না তাঁদের কাছে।
মান্না দের আরো কিছু সাক্ষাৎকার পড়ে সাম্প্রতিক কালে আরো মনে হয়েছে টলিউডে ওনার জয়যাত্রা খুব স্মুদলি হয়ে ওঠেনি, আর সে নিয়ে কিছুটা ক্ষোভ ওনার মধ্যে অনেককাল ছিল। অবাক হয়ে ভেবেছি এরকম একজন শিল্পীকেও কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে তাহলে, পতন-অভ্যুদয়-বন্ধুর পন্থা তাহলে প্রায় সর্বজনসত্য। কিন্তু ‘Bitterest man in the living room’ –ও যদি একজন শিল্পী হন, শিল্পসৃষ্টির কালটিই তাঁর সব থেকে মহৎ মুহূর্ত। আমি নিশ্চিত মান্না দে শেষ জীবন অবধি বেঁচে ছিলেন এরকম মুহূর্ত গুলোতেই, কদাচিৎ ক্ষোভপ্রকাশ গুলো ধর্তব্যের মধ্যে আসে না। আর যদি নেহাতই তর্কের খাতিরে ধরতে হয়-ও, তাহলে অমিয়নাথ সান্যালকে (‘স্মৃতির অতলে’)স্মরণ করতে হয় – “অহঙ্কার আর অভিমান আছে বলেই দলিল লিখে যেতে পেরেছি”।
আজ অনেক বাড়িতেই প্রায় নিরম্বু উপবাস, কিন্তু অতিলৌকিক জগতের অস্তিত্ব থাকলে কে জানে মান্না হয়ত জমিয়ে মাংসই রেঁধে ফেলতেন, আর ডাইনিং টেবলে সোৎসাহে অপেক্ষা করতে করতে পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় গল্প জুড়তেন সুধীন দাশগুপ্তের সঙ্গে – বহুদিন পর ‘ভজহরি মান্না’ ফিরেছেন যে, টুপি সমেত।
(স্থিরচিত্র উৎস – ‘কথায় কথায় রাত হয়ে যায়’ – পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়; আনন্দ পাবলিশার্স, ১৯৯৯)