(Photo Courtesy : Dekh bhai meme)
গুগল অনুবাদ দেখাল demonetization বাংলা মুদ্রারহিতকরণ। কথাটা খটমট ত বটেই তা ছাড়া রহিতকরণ শব্দটির গায়ে এমনই পরিভাষা পরিভাষা গন্ধ যে মনস্থির করলাম সাদাসিধে ‘অবলুপ্তি’ বলাই ভালো। ভারতে ৫০০ এবং ১০০০ টাকার নোট তুলে দেওয়ার প্রসঙ্গেই এই ব্লগপোস্টটির অবতারণা। গত দেড় সপ্তাহে পত্রপত্রিকায় নেহাত কম লেখালেখি হয়নি এ নিয়ে (যদিও বাংলায় বিশ্লেষণী লেখা চোখে পড়ার মতন কম), কিন্তু অধিকাংশ লেখাতেই অর্থনীতির তত্ত্বকে সন্তর্পণে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। অর্থনীতিরই ছাত্র, তাই ভাবলাম দু’কলম লিখে ফেলি। আরো একটা কথা বলা দরকার, মুদ্রা অবলুপ্তি আদৌ কালোবাজারকে নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হবে কিনা সে নিয়ে কিছু লেখা আমার উদ্দেশ্য নয়। আমি শুধু দেখতে চাইব এই অবলুপ্তিকে ধরে নিয়েও আগের স্থিতাবস্থায় পৌঁছনো আদৌ সম্ভব কিনা।
শুরু করব অপেক্ষাকৃত সহজ একটি তত্ত্ব দিয়ে যার পোশাকি নাম ‘কোয়ান্টিটি থিয়োরী অফ মানি’। তত্ত্বটির দীর্ঘ একটি ইতিহাস আছে, তবে এই মুহূর্তে সেই ইতিহাস নিয়ে কথা না বললেও চলবে। আমেরিকান অর্থনীতিবিদ আরভিং ফিশারকেই এই তত্ত্বের জনক বলে ধরা হয়। কলেজে যাঁরা ন্যূনতম অর্থনীতির পাঠ নিয়েছেন তাঁদের হয়ত নামটি মনে পড়ে যেতে পারে। ফিশার খুব সহজ একটি সমীকরণের মাধ্যমে মুদ্রার যোগান, পণ্য মূল্য এবং পণ্যসম্পদের মধ্যে একটি যোগসূত্র স্থাপনের চেষ্টা করেছিলেন। সমীকরণটি এরকম,
m (মুদ্রার যোগান) X v (মুদ্রার গতিবেগ) = p (সমস্ত পণ্যের গড় মূল্য) X Q (বিক্রিত পণ্যের পরিমাণ)
v আদতে velocity, তাই পদার্থবিদ্যার ছাত্রছাত্রীদের থেকে আগেভাগে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি গতি এবং বেগকে মিলিয়ে মিশিয়ে দেওয়ার জন্য।
ধরা যাক ভারতবর্ষের এক মিনিয়েচার সংস্করণে ১ দিনে মোট ১০০০ খানা জিনিসপত্র লেনদেন হয়েছে। আরো ধরা যাক সেই সমস্ত জিনিসের গড় মূল্য ৩ টাকা এবং দেশে সেই মুহূর্তে মোট ৫০০ টি ১ টাকার নোট আছে। ফিশারের সমীকরণের হিসাবে, ওই ৫০০ টি নোটের প্রতিটিকে তাহলে ৬ বার ব্যবহৃত হতে হবে (মানে আপনার হাত থেকে সে নোট গেল বইয়ের দোকানে, দোকানীর স্ত্রী আবার সেই নোটটি দিয়ে কিনে আনলেন ফলস পাড়, ফলস পাড় যিনি বেচলেন তাঁর ছেলে আবার সেই একই নোট নিয়ে কিনতে গেল চপ, এরকম আর কি)।
একবার চট করে মিলিয়ে হিসেবটা মিলিয়ে নিতে পারেন।
৫০০ X ৬ = ৩ X ১০০০
যদি ৫০০ টি ১ টাকার নোট না থেকে ২০০ টি ১ টাকা আর ৫০ টি ২ টাকার নোটে থাকে, তখন? সমীকরণ থেকে ফের বার করে ফেলতে পারেন উত্তর,
(২০০ X ১ + ৫০ X ২) X মুদ্রার গতিবেগ = ৩ X ১০০০
পাওয়া গেল মুদ্রার গতিবেগ = ১০, অর্থাৎ প্রতিটি নোটকে এবার ১০ বার হাত বদল হতে হবে। এবার আপনি বলতেই পারেন কিন্তু কে মাথার দিব্যি দিয়েছে যে ১ টাকা আর ২ টাকার নোটকে একই সংখ্যায় হাত বদল হতে হবে? নাহ, সত্যিই সে দিব্যি কেউ দেয়নি। তখন অবশ্য সমীকরণটা একটু বদলে যাবে।
(২০০ X ১ X x) + (৫০ X ২ X y) = ৩ X ১০০০
বুঝতেই পারছেন x (১ টাকার নোটের গতিবেগ ) আর y (২ টাকার নোটের গতিবেগ) এর মানের ওপর কোনো শর্ত আরোপ না করলে এ ক্ষেত্রে অনেক কটা সমাধানই হতে পারে – যেমন, (x = ৪ , y = ২২ ), (x = ১৫ , y = ০), (x = ০ , y = ৩০ ) এবং আরো অজস্র।
এবার এই তিন নম্বর সমাধানটি নিয়ে একটু মাথা খাটানো যাক – (x = ০ , y = ৩০ )।
ধরা যাক, ৮ই নভেম্বরের মতনই কোনো এক দিন ওই মিনিয়েচার ভারতের জনগণ সকালে উঠে দেখলেন ১ টাকার নোট রাতারাতি বাতিল হয়ে গেছে। নোট বাতিলের পরেও কি মানুষের অর্থনৈতিক জীবনে ব্যাঘাত না ঘটা সম্ভব? সম্ভব, অনেক রকম ভাবেই সে প্রতিশ্রুতি দেওয়া যায়। ওই তিন নম্বর সমাধানটি এরকমই একটি প্রতিশ্রুতি – অর্থাৎ দেশের মানুষকে ২ টাকার নোট নিয়ে ১০ বারের জায়গায় ৩০ বার দোকানে যেতে হবে। সামগ্রিক ভাবে পণ্যসম্পদের পরিমাণ একই থাকছে কিন্তু এখন মানুষকে নানা বাহানা বানিয়ে দোকানে যেতে হবে। এত বার এবং এত বিভিন্ন দোকানে যাওয়ার দরকার আমাদের নাই থাকতে পারে।
তাহলে উপায়?
দ্বিতীয় উপায় হল, নোটের পরিমাণ বাড়িয়ে দেওয়া যাক। ৫০টা ২ টাকার নোট তো থাকল, সরকার যদি আরও ১০০ খানা ২ টাকার নোট সরবরাহ করতে পারেন তাহলেই কেল্লা ফতে, ১০ বারের বেশী দোকানে মোটেই যেতে হবে না। এটাই বোধহয় সবথেকে সহজ উপায়, কিন্তু সবথেকে সহজ উপায়ও যদি সরকার কার্যকর না করে উঠতে পারেন? তখন কি করা?
আরো একটা উপায় আছে, যদি গড় পণ্যমূল্য কোনো ভাবে কমে যায়। ৩ টাকার জায়গায় যদি কোন ম্যাজিকে জিনিসপত্রের দাম ১ টাকা হয়ে যায়, তাহলেও ওই দশবার দোকানে গেলেই চলবে। কিন্তু কে করবে এই অসাধ্য সাধন? আর কে, দেশের রিজার্ভ ব্যাঙ্ক! কিন্তু ধরা যাক, সে ব্যাঙ্কের রকস্টার গভর্নর সবাইকে কাঁদিয়ে কয়েকদিন আগেই আলবিদা বলেছেন, ব্যাঙ্কের কাজকর্মে মন নেই। অতঃ কিম?
আচ্ছা আচ্ছা, ভুরূ কুঁচকোবেন না। ধরে নিলাম ব্যাঙ্কের যথারীতি কাজকর্ম চলছে, কিন্তু দামটা কমবে কি ভাবে? দু’টো প্রধান উপায়। এক হল, বাজারে টাকার যোগান কমিয়ে দেওয়া যাতে পণ্যের চাহিদা কমে যায় (মানুষের হাতে নগদ টাকা যেহেতু বেশী থাকছে না) কিন্তু মনে রাখা দরকার আমাদের সমস্যা শুরুই হয়েছে টাকার যোগান কমে গিয়ে, আরো যোগান কমিয়ে দিলে হিতে বিপরীত হবে। মানুষজনের নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী কেনার জন্যও টাকা থাকবে না।
দু নম্বর রাস্তা হল – টাকা যোগান এক রেখে সুদের হার বাড়িয়ে দেওয়া। ফলে হবে কি, মানুষ খরচ করার থেকে ওই নগদ টাকা ব্যাঙ্কে রাখতে বা বিনিয়োগ করতে বেশী উৎসাহী হবেন। কিন্তু এক্ষেত্রেও একটা সমস্যা থেকে যাচ্ছে, কি বলুন তো? মানুষজন না কিনছেন বই, না কিনছেন ফলস পাড় এমনকি চপ তেলেভাজা দেখলেও আসল শিল্প চাই বলে মুখ ঘুরিয়ে চলে যাচ্ছেন।
আরেকবার সমীকরণ টা মনে করাই,
m (মুদ্রার যোগান) X v (মুদ্রার গতিবেগ) = p (সমস্ত পণ্যের গড় মূল্য) X Q (বিক্রিত পণ্যের পরিমাণ)
m কমে গেছে, v আর বাড়া মুশকিল – ফলে p ও যদি না কমে আগের স্থিতাবস্থা একমাত্র তখনই ফিরবে যদি Q নিজেই কমে যায়।
বুঝতেই পারছেন Q কমে যাওয়াটা কাজের কথা নয়। এই পণ্যসামগ্রী যদি আবশ্যিক নাও হয়, পণ্যসম্পদের পরিমাণ কমে যাওয়াটা যে কোনো অর্থনীতির পক্ষেই বড় ধাক্কা। একটা দেশের অর্থনীতি তো শুধু এক দিনের ‘কোয়ান্টিটি থিয়োরী অফ মানি’ দিয়ে চলে না, পরবর্তী দিনগুলোতে অর্থনৈতিক বৃদ্ধি আনার জন্য Q কে শুধু স্থির রাখলেই হবে না, যতটা সম্ভব বাড়ানো উচিত। সে কথা মাথায় রেখেই শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবাদপ্রতিম অধ্যাপক মিল্টন ফ্রীডম্যান বলেছিলেন ঘোরতর মন্দার বাজারে সেন্ট্রাল ব্যাঙ্কদের উচিত হেলিকপ্টার থেকে ছুঁড়ে ছুঁড়ে মানুষকে টাকা বিলোনো। বলা বাহুল্য যে হেলিকপ্টার এখানে রূপক মাত্র। ফ্রীডম্যান বলতে চেয়েছিলেন মন্দা থেকে মুক্তি পাওয়ার প্রধান উপায় হল মানুষদের হাতে সরাসরি নগদ টাকা পৌঁছিয়ে দেওয়া।
ফ্রীডম্যানের আইডিয়াটি বিতর্কসাপেক্ষ, আমরা আপাতত হেলিকপ্টার ছেড়ে মাটির কাছাকাছিই ফিরে আসি। ওপরের পুরো আলোচনাটাই করা হয়েছে ফিশারের সমীকরণটি বাস্তবিক এরকমটি মেনে নিয়ে। কিন্তু হতে পারেই যে ফিশারের তত্ত্বটি পুরোপুরি ঠিক নয়। আধুনিক অর্থনীতির আর এক পন্ডিত জন মেইনার্ড কেইনস এমনটিই বলেছিলেন। কেইনসের মূল বক্তব্য ছিল মানুষ কিছু টাকা সবসময়ই নিজের হাতে রেখে দিতে চাইবেন। কেন? কারণ অনেক। আচম্বিতে কোনো বিপদ আসতে পারে, পুরনো ঋণের ওপর সুদের হার বেড়ে যেতে পারে বা ভবিষ্যৎ-এর কোনো বড় খরচের জন্য (ছেলেমেয়ের পড়াশোনা কি বাবা-মার চিকিৎসার খরচ) তিল তিল করে কিছু টাকা এখন থেকেই জমাতে হতে পারে।
অর্থাৎ, কেইনস বলছেন মানুষের কত টাকার প্রয়োজন তা নির্ধারিত হবে শুধু তার আয় দিয়ে নয়, বাজারের সুদ দিয়েও। যারা অঙ্কের ভাষা ভালো বোঝেন তাদের জন্য এই থিয়োরীও সমীকরণের মাধ্যমেই লেখা যায়,
Demand for money = M = M1 (y) + M2 (r) যেখানে y হল আয় আর r সুদের হার।
কেইনসের তত্ত্ব সত্যি হলে দু’টি সিদ্ধান্তে পৌঁছনো যায় – প্রথমত, কিছু মানুষের কাছে আগের দিনের বা আগের মাসের বা আগের বছরের m এর কিছু অংশ রয়ে গেছে অর্থাৎ হয়ত ১ টাকা আর ২ টাকার নোটের আসল সংখ্যা আরো বেশী; আর দ্বিতীয়ত ‘কোয়ান্টিটি থিয়োরী অফ মানি’-র ওই v অর্থাৎ মুদ্রার গতিবেগ এক এক মানুষের জন্য এক এক রকম হবে।
এবার একবার চট করে মিনিয়েচার ভারত থেকে আসল ভারতে ফিরে আসা যাক। দেশের মুদ্রার ৮৬ শতাংশই ছিল ৫০০ আর ১০০০ টাকার নোটে, তাই আগের m রয়ে গেলেও সম্ভাবনা খুবই বেশী যে সে টাকাও রয়ে গেছে ওই ৫০০ আর ১০০০ হয়েই। সুতরাং, খুব কিছু কাজের কাজ হবে না।
আর v? কেইনসের বক্তব্য ধরলে এটা মেনে নেওয়াই স্বাভাবিক যে যারা একটু বেশীই ঝুঁকি এড়িয়ে চলতে ভালোবাসেন তাদের জন্য v কম হওয়াটাই দস্তুর। তাহলে এরকম মানুষ কি আদৌ আছেন যাদের v গড়ের থেকেও বেশী? যাঁরা আছেন বলে মুদ্রা অবলুপ্তি ঘটলেও আগের স্থিতাবস্থায় ঠিকই ফেরত যাওয়া যাবে?
আছেন।
যাঁরা ‘প্লাস্টিক মানি’ অর্থাৎ ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করেন।
কিন্তু মনে রাখা দরকার আমরা মিনিয়েচার ভারত থেকে বেরিয়ে এসেছি। আসল ভারতের জনসংখ্যার কত শতাংশ প্লাস্টিক মানি ব্যবহার করে থাকেন? সবথেকে আশাবাদী পরিসংখ্যান বলছে মেরেকেটে দুই শতাংশের কাছাকাছি। অতএব, কেইনসের তত্ত্বকে মেনে নিলেও আমাদের জন্য কোনো সুখবরই অপেক্ষা করে নেই। আরোই ভয়ের কথা এই যে, সরকার টাকার জোগান দিতে যদি অস্বাভাবিক বেশি সময় নেন এবং ততদিনে পণ্যসম্পদ ক্রয়বিক্রয়ের পরিমাণ অত্যন্ত কমে যায় তাহলে সেই সব পণ্যের যোগানদাররাও দোকান বন্ধ করে অন্য কাজে মন দেবেন। কি কাজ? সে চাষবাসও হতে পারে, বাপ-ঠাকুরদার রেখে যাওয়া পয়সা ওড়ানোও হতে পারে এমন কি চাইলে মুদ্রা অবলুপ্তির কারণ নিয়ে পি-এইচ-ডিও করতে যেতে পারেন। কিন্তু আখেরে ক্ষতি হবে এই যে পণ্যসম্পদের যোগান কমে গেলে বাজারে দাম বাড়বে বই কমবে না!
গত বছর হার্ভার্ডের অর্থনীতিবিদ কেনেথ রোগফ তাঁর বিতর্কিত বই ‘দ্য কার্স অফ ক্যাশ’ এ সওয়াল করেছিলেন কাগুজে টাকার ব্যবস্থাটিকেই সম্পূর্ণ ভাবে তুলে দেওয়ার জন্য। কিন্তু সেই সওয়াল করতে গিয়ে এটাও জানিয়েছিলেন যে আমেরিকার মতন উন্নত অর্থনৈতিক পরিকাঠামোর দেশেও দশ থেকে পনের বছর ধরে এই কাজটি হওয়া উচিত। রোগফ আরো বলেছেন সর্বদরিদ্র মানুষগুলির জন্য বিনামূল্যে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট এবং মোবাইল ফোন পরিষেবার বন্দোবস্ত না করে এ কাজ করা যাবে না। নরেন্দ্র মোদী অবশ্যই এই মুহূর্তে ভারতবর্ষ থেকে কাগুজে টাকা তুলে দিতে চান নি, কিন্তু তারপরেও রোগফের কথাগুলি দেখায় কেন যে কোনো রকম মুদ্রা অবলুপ্তিকরণের আগেই দরকার দীর্ঘ প্রস্তুতি। কালোবাজারিদের রোখার জন্য আকস্মিক ঘোষণা যুক্তিসঙ্গত পদক্ষেপ, কিন্তু বিন্দুমাত্রই প্রস্তুতি নিয়ে একাজে পা বাড়ালে পা ফালাফালা হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা।