ফেলুদার প্রথম গল্পের পঞ্চাশ বছর পূর্তি উপলক্ষে ‘টগবগ’ পত্রিকার উৎসব সংখ্যার (২০১৬/ ১৪২৩ বঙ্গাব্দ)জন্য লিখেছিলাম ফেলুদার নতুন গল্প ‘রাজধানীতে তুলকালাম’। ফ্যান ফিকশনই বটে তবে আমি ব্যক্তিগত ভাবে ‘প্যাস্টিশ’ (Pastiche) শব্দটি ব্যবহার করতে ইচ্ছুক। স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠবে ফ্যান ফিকশন এবং প্যাস্টিশের মধ্যে কি তফাৎ? প্যাস্টিশ লিখতে হলে লেখকের অরিজিন্যাল স্টাইলটি মেনে চলতেই হবে, ফ্যান ফিকশন লিখিয়ে দের থেকে সেরকম কোনো চাহিদা থাকে না। বুঝতেই পারছেন একটি সফল প্যাস্টিশ লেখার জন্য গবেষণা করা অত্যন্ত জরুরী। পাঠক হয়ে যখন তরতর করে পড়ে চলেছেন তখন এক কথা, আর যখন লেখকের জুতোয় পা গলিয়ে তাঁকে যথাযথ ভাবে অনুকরণ করার চেষ্টা করছেন সে আরেক কথা। কাজটি বলতে গেলে অপরিসীম কঠিন। হয়ত সে কারণেই ‘ফ্যান ফিকশন’ শব্দবন্ধটি একটু তাচ্ছিল্যের সঙ্গেই ব্যবহৃত হয়, ‘প্যাস্টিশ’ শব্দটি কিন্তু বনেদী ঘরানার। অবশ্য লেখক বা প্রকাশক নিজে বললেই তো হবে না, একটা ফ্যান ফিকশন প্যাস্টিশে উন্নীত হয়েছে কিনা তা বলবেন সংখ্যাগরিষ্ঠ পাঠকরাই। নতুন প্লটের সঙ্গে পুরনো স্টাইল মানিয়ে গেল কিনা সে বিচারের দায়িত্বও নিতান্তই পাঠকের। ‘রাজধানীতে তুলকালাম’ সেই বিচারে ফ্যানফিকশন না প্যাস্টিশ সে কথা বিচারের ভার সাড়ে বত্রিশ ভাজার পাঠকদের ওপরেই ছেড়ে দিলাম। বন্ধুবর এবং সৃষ্টিসুখের কর্ণধার রোহণ কুদ্দুসকে ধন্যবাদ জানাই লেখাটি ব্লগে প্রকাশ করার অনুমতি দেওয়ার জন্য। অনবদ্য ছবিগুলি এঁকেছেন ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং শিল্পী অভীক কুমার মৈত্র (টগবগ উৎসব সংখ্যার জন্য অবশ্য ছবি এঁকেছিলেন আরেক প্রতিভাবান শিল্পী সুমিত রায়)। ফেলুদা প্যাস্টিশ কেমন লাগল সে কথা জানাতে ভুলবেন না যেন, ব্লগ পোস্টে আপনাদের মন্তব্যের জন্য অপেক্ষা করে থাকব।
১
‘হ্যারি হুডিনি চাইলে জবরদস্ত গোয়েন্দাও হতে পারতেন’, মশলার কৌটো থেকে বেছে বেছে কয়েকটা মৌরি তুলতে তুলতে বলল ফেলুদা। রোববারের গোটা সকালটাই ও হুডিনির অটোবায়োগ্রাফি পড়ে কাটিয়েছে তাই আঁচ করছিলাম খাওয়ার টেবলে ম্যাজিক নিয়ে দু’চার কথা বলবে। সেটা অবশ্য হয় নি, এখন খাওয়ার পর বৈঠকখানার ঘরে ঢুকতে না ঢুকতেই এই কথা।
আমি জিজ্ঞেস করলাম ‘বইতে তাই লিখেছেন বুঝি?’
‘দূর বোকা, উনি লিখবেন কেন! এটা আমার ডিডাকশন। যে কায়দায় একের পর এক আধ্যাত্মিক বুজরুকদের মুখোশ খুলে গেছেন, পাকা গোয়েন্দারাও পারবে না। একটা কথা অবশ্য লিখেছেন – যে যত বড় ভণ্ড, তার ভক্তিও তত বেশী।’
বোঝো কান্ড, আমি শুধু জানতাম ভদ্রলোক দারুণ দারুণ সব এসকেপ ম্যাজিক দেখিয়ে গেছেন। এই হাতকড়া খুলে ফেলছেন, ওই নদীর তলায় থাকা বাক্সর মধ্যে থেকে বেরিয়ে এসে দর্শকদের মধ্যে দাঁড়িয়ে পড়ছেন। ফেলুদাকে বলাতে ও বলল আমেরিকাতেও খুব কম লোকেই জানে যে হুডিনি ভণ্ড ধর্মগুরুদের পেছনে সারা জীবন লেগে ছিলেন।
হুডিনিকে নিয়ে আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল এমন সময়ে কলিং বেলটা বেজে উঠল। আমি তড়িঘড়ি উঠতে যাচ্ছিলাম, ফেলুদা একটা হাই তুলে তুড়ি দিতে দিতে বলল, ‘উত্তেজিত হোস না। মক্কেল নয়, জটায়ু এসেছেন।’
আমি অবাক হয়ে তাকাচ্ছি দেখে বলল, ‘ভদ্রলোকের গাড়ির নতুন হর্নটা এই প্রথম শুনলি বোধহয়, না?’
তাই তো! মিনিট দুয়েক আগেই গলির মধ্যে থেকে ‘জয় জগদীশ হরে’র সুর শুনতে পাচ্ছিলাম। ফেলুদার সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে খেয়াল করিনি যে ওটা গাড়ির হর্ন।
আমাকে যেতে হল না, শ্রীনাথ তার আগেই দরজা খুলে দিয়েছে। লালমোহনবাবু দেখি এক গাল হেসে শ্রীনাথের হাতে একটা বড় প্যাকেট ধরালেন।
ভদ্রলোক ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললেন, ‘নাহুমের কেক মশাই। গত মাসে প্রথম চাখলাম, তারপর থেকে আর কিছু মনেই ধরছে না। এসব সাহেবী কেকের পাশে বাঙালি টিফিন কেক পাত্তা পায় বলুন তো? ছ্যা।’
ফেলুদা ভুরূ তুলে বলল, ‘সাহেবটি যে রাণীর দেশের নন সে খবরটা আশা করি জানেন।’
লালমোহনবাবু একটু ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেলেন, ‘রাণী? মানে ভি…ভিক্টোরিয়া? বিলেতের নয় বলছেন, আমেরিকান বুঝি?’
ফেলুদা মাথা নেড়ে বলল, ‘একশ বছর মতন দেরী করে ফেললেন। এখনো যে আপনি রাণী বলতে ভিক্টোরিয়াকেই বোঝেন সে খবরে এলিজাবেথ কতটা প্রসন্ন হবেন সে নিয়ে সন্দেহ আছে। তবে সাহেবটি ইহুদী, এবং এসেছিলেন বাগদাদ থেকে।’
জটায়ুর মুখটা দেখার মতন হল। আধ মিনিট মতন গোল গোল চোখে ফেলুদার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, ‘বাগদাদের সাহেব! বলেন কী ফেলুবাবু?’
‘নোট করে নিন, পরের উপন্যাসে প্রখর রুদ্রর মোকাবিলা কোনো বাগদাদী সাহবের সঙ্গে করিয়ে দেবেন।’
‘হেঁ হেঁ, যা বলেছেন স্যার। তবে নেক্সট লেখাটা ভাবছি দিল্লীর ব্যাকগ্রাউন্ডে রাখব’, জানালেন লালমোহনবাবু।
ফেলুদা চারমিনারের প্যাকেট থেকে সিগারেট বার করতে গিয়ে থেমে গেল, ‘দিল্লী চললেন নাকি? কবে?’
লালমোহনবাবু হাসি হাসি মুখে বললেন, ‘শুধু আমি নই, আপনারাও। কিন্তু পুজোর সময় কলকাতা ছাড়তে অসুবিধা নেই তো?’
আমি ফেলুদার দিকে তাকালাম। ফেলুদা উত্তর না দিয়ে সিগারেটটা প্যাকেটের উপর ঠুকতে লাগল। আমি জানি ও কী ভাবছে। পুজোর সময়টা ঠিক কলকাতা ছেড়ে নড়তে চায় না ফেলুদা, রাস্তায় পারতপক্ষে না বেরোলেও বলে পুজোর ফীল টা কলকাতা ছাড়া কোথাও পাওয়া মুশকিল।
‘উপলক্ষটা কী শুনি?’, লালমোহনবাবুকে জিজ্ঞাসা করল ফেলুদা।
ভদ্রলোক একটা কান এঁটো করা হাসি হাসলেন, ‘ইয়ে, দিল্লীর বাঙালি অ্যাসোশিয়েশন একটা সাহিত্যমেলা করছে পুজোর সময়। আমাকে বিশেষ ভাবে ধরেছে যাওয়ার জন্য’। তারপর আমার দিকে ঘুরে বললেন, ‘বুঝলে তপেশ, দিল্লীতেও যে প্রখর রুদ্রর এত খ্যাতি ছড়িয়েছে তা জানতাম না। বললে কিনা গত বছর পুজোর সময় ওদের স্টল থেকেই নাকি ‘ফুজিয়ামার ফৌজ’ এর খান সত্তর কপি বিক্রি হয়েছে।’
এখানে বলে রাখা ভালো ‘ফুজিয়ামার ফৌজ’ বিক্রিবাটার দিক থেকে গত বছর রহস্য রোমাঞ্চ উপন্যাসগুলির মধ্যে টানা চার মাস এক নম্বরে ছিল। এ বছর সে বইয়ের পরের খন্ড আসছে, নাম ‘তাইহোকুর তান্ত্রিক’।
ফেলুদা সিক্যুয়েলের খবরটা জানত না, শুনে জিজ্ঞাসা করল ‘ফুজিয়ামা থেকে সটাং তাইহোকু চলে গেলেন কেন? নিদেনপক্ষে টোকিওতে এক বছর কাটিয়ে গেলে হত না?’
তাতে লালমোহনবাবু বললেন, ‘আরে মশাই, টোকিও – ফুজিয়ামা – তাইহোকু সবই তো জাপানে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানীরা কী ফাইটটাই দিয়েছিল বলুন তো, অ্যাকশন সিনে কিন্তু ওদের টেক্কা দেওয়া মুশকিল’।
ফেলুদা লালমোহনবাবুর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তাইহোকুকে জাপানে নিয়ে গেলে হিন্দি আর চিনি দুই ভাই-ই যে বেদম চটবেন সেটা যেন খেয়াল থাকে।’
লালমোহনবাবু কিছুই বুঝতে পারছিলেন না, বাধ্য হয়ে ওনাকে বলতে হল তাইহোকু শহরটা জাপানে নয়, তাইওয়ানে। ওখানেই সুভাষচন্দ্রের প্লেনটা দুর্ঘটনায় পড়েছিল।
এইবারে এক গাল হেসে বললেন, ‘দেকেচ কান্ড, আমিও তো সুভাষ বোসের জন্যই নামটা শুনেছিলাম। এদিকে লেখার সময়ে কিছুতেই মনে পড়ল না নামটা কেন চেনা লাগছে’।
‘কিন্তু আপনি দিল্লী যাবেন তো ফেলুবাবু?’ একটু উদগ্রীব হয়েই জিজ্ঞাসা করলেন লালমোহনবাবু।
‘যাবি নাকি তোপসে?’
আমি তো যাকে বলে এক পায়ে খাড়া, পুরো পুজোর ছুটিটা কলকাতায় কাটানোর মানে হয় না। তা ছাড়া দিল্লীর পুজোও দেখা যাবে।
ফেলুদা বলল, ‘আমারও এমনিতে আপত্তি নেই, তবে একটা কন্ডিশন আছে।’
‘এনিথিং ফর ইউ’, বললেন লালমোহনবাবু।
‘আপনার গাড়ির হর্নটি চেঞ্জ করতে হবে। যাওয়ার দিন রজনী সেন রোডে জয় জগদীশ হরে শুনতে পেলে আমি বাক্সপ্যাঁটরা নিয়ে ফের ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ব।’
ভদ্রলোক বিস্তর জিভটিভ কেটে বললেন, ‘আরে না না। আসলে নভেল লিখে টু পাইস মন্দ আসছে না তো, তাই ভাবছিলাম ঠাকুরদেবতাকে খুশি রাখাটা দরকার। তবে আপনি যখন বলছেন…’
‘বাই দ্য ওয়ে, তোপসে আর আমার খরচটা…’
‘প্লীজ ফেলুবাবু’ লালমোহনবাবু হাত তুলে থামালেন ফেলুদাকে। ‘এ শর্মা থাকতে আপনি পয়স খরচ করবেন তা কখনো হয়? হরিপদ কালকে গিয়েই রাজধানীতে তিনটে টিকেট কেটে আনবে। আপনাদের দয়াতেই তো একটু করেকম্মে খাচ্ছি।’
যাওয়ার আগের দিন ফেলুদা বলল ‘তোপসে, চট্ করে তৈরি হয়ে নে তো, একবার সিধুজ্যাঠার বাড়ি ঘুরে আসি। দিল্লীর আসল ইতিহাস জানার জন্য কোন অলিগলিতে ঘুরতে হবে সেটা উনি ছাড়া আর কে বলবেন?’
তৈরি হওয়ার জন্য ভেতরের ঘরে যেতে গিয়ে হঠাৎ হুডিনির বইটা চোখে পড়ায় মনে হল রাজধানীতেও কী ফেলুদার বরাতে গোয়েন্দাগিরি নাচছে?
কে জানত যে দিল্লী পৌঁছনোর আগেই ফেলুদার হাতে মোক্ষম এক কেস এসে পড়বে।
২
সিধুজ্যাঠা বাড়িতেই ছিলেন, বিশেষ দরকার না পড়লে এমনিতেও পারতপক্ষে ঘর ছেড়ে নড়েন না। আমরা দিল্লী যাচ্ছি শুনে প্রায় চোখ কপালে তুলে বললেন, ‘একেই বলে সমাপতন। আজকেই ভাবছিলাম ফেলুরামের বাড়িতে একবার যাওয়া দরকার, আর ভাবতে না ভাবতেই তোমরা এসে হাজির। দরকারটা যে দিল্লী যাওয়া নিয়েই। ’
ফেলুদা একটু হেসে বলল, ‘উল্টোটাই সাধারণত হয়ে থাকে বলে মনে হচ্ছে একটা আরজেন্সি আছে। তাই কী?’
‘আরজেন্সি তো বটেই। আর তুমি ছাড়া এ সমস্যার সমাধান কেউ করতে পারবে বলে মনে হয় না, তোমার হাতে সময় আছে কিনা সেটা জানাটাও খুব জরুরী।’
‘নিশ্চয়, আপনি বলুন কী সমস্যা।’
সিধুজ্যাঠা তক্তপোষে বসতে বসতে বললেন, ‘তার আগে বলো জয়পুরের রুবি-আইড প্যারট এর নাম শুনেছো কিনা?’
‘নাহ, সেরকম তো কিছু খেয়াল পড়ছে না।’
‘১৮৭৩ সালে জয়পুরের মহারাজের জন্য এই টিয়া বানিয়েছিলেন প্যারিসের এক মণিকার। মহারাজার কালেকশনের স্টার আইটেম এই রুবি-আইড প্যারট। এর পুরো শরীরটাই প্রায় নিখাদ সোনা দিয়ে বানানো। চোখ, ঝুঁটি আর পাখায় বসানো রয়েছে দুর্মূল্য রুবি। পান্নাসবুজ এনামেলের কারুকাজ রয়েছে পুরো শরীরটায়। টিয়াপাখি বসে আছে একটা ডালের ওপরে, আর তার মুখে ধরা একটা ফুল। এগুলোতেও হীরে, পান্না, রুবির ছড়াছড়ি। টিয়াপাখিটি দেখে মহারাজের এতই ভালো লেগে যায় যে তিনি সেই ফরাসী শিল্পীকে দিয়ে আর এক পিস বানিয়েছিলেন। তো দু’খানা টিয়ার মধ্যে একটি এখনো জয়পুরের প্যালেসেই আছে, অন্যটি গেছে লন্ডনের ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড অ্যালবার্ট মিউজিয়মে।’
‘আমার এই বিষয়ে একটু পড়াশোনা ছিল বলে দু’বছর আগে একটা আর্ট জার্নালে এই টিয়াপাখিদের নিয়ে বিশদে লিখি। তখন কিছু চিঠিপত্র পেয়েছিলাম কিন্তু ওই পর্যন্তই, তারপর সে নিয়ে আর বিশেষ কোনো চর্চার কারণ ঘটেনি। কয়েক মাস আগে হঠাৎই আমি দিল্লী থেকে একটি ট্রাঙ্ককল পাই, ফোনটি যিনি করেছিলেন তাঁর নাম অনুকূল ভদ্র।’
ফেলুদা মাঝখানে বলল, ‘অনুকূল ভদ্র নামটা কিরকম চেনা চেনা ঠেকছে।’
‘চেনা চেনা ঠেকতেই পারে। এককালে বরোদার সয়াজিরাও ইউনিভার্সিটির ফাইন আর্টস ডিপার্টমেন্টের প্রফেসর ছিলেন, বেশ নামটামও হয়েছিল। তারপর খানিকটা আচমকাই রিটায়ারমেন্ট নিয়ে চলে যান, কোথায় যে চলে যান কেউ জানত না। এই এবারে ফোনে বলল এখন ও দিল্লীতে থাকে। আমার আগের পাড়াতেই ওর বাড়ি ছিল, কিন্তু ওকে শেষ দেখেছি তা প্রায় বছর দশেক তো হবেই।’
‘অনুকূল আমাকে একটা অদ্ভুত প্রশ্ন করল, বুঝলে। বলল জয়পুরের মহারাজার জন্য আরো একটি টিয়া বানানো হয়েছিল এরকম কোনো খবর আমার কাছে আছে কিনা?’
‘মানে তিন নম্বর টিয়া?’
‘একজ্যাক্টলি সো, তিন নম্বর টিয়া। আমি অনুকূলকে বললাম আমার কাছে এরকম কোনো খবর নেই, আমি যতদূর জানি দু’টো টিয়াই বানানো হয়েছিল। ওকে আমার লেখাটার রেফারেন্সও দিলাম, বলল লেখাটা পড়েছিল বলেই আমাকে ফোন করেছে।’
‘যাই হোক অনুকূল তারপর ফোন রেখে দিল, আমিও টিয়ার কথা ভুলে গেছি। তারপর হঠাৎ হপ্তাখানেক আগে আবার তার ফোন, বলল দু’জন ভদ্রলোককে আমার কাছে পাঠাচ্ছে কি এক আর্জেন্ট দরকারে। দু’দিন পরেই তারা এসে হাজির – একজনের নাম পবনদেও জয়সওয়াল আর অন্যজন মাধবরাও যোশী। যোশীর হাতে একটা অ্যাটাচি কেস।’
‘বললে বিশ্বাস করবে না, সেই অ্যাটাচি কেস থেকে কি বেরলো জানো? তিন নম্বর টিয়া। আমি তো দেখে থ।’
ফেলুদা জিজ্ঞাসা করল, ‘টিয়াটি উদয় হল কোথা থেকে?’
‘সে কথাতেই যাচ্ছি। মাধবরাও যোশী গুজরাটের একজন আর্ট কালেক্টর এবং পেশার খাতিরে অনুকূলের পূর্বপরিচিত। ছ’মাস আগে উদয়পুরে ঘুরতে গিয়ে এই টিয়ার খবর পান পবনদেও জয়সওয়াল এর কাছে। জয়পুরের মহারাজার পার্সোনাল ফিজিসিয়ানের বংশধর হলেন এই পবনদেও জয়সওয়াল।
পবনদেও জানালেন মহারাজার চিকিৎসক অন্তত দু’বার ওনাকে সাক্ষাৎ মৃত্যুর হাত থেকে ফিরিয়ে এনেছিলেন। কৃতজ্ঞতাস্বরূপ মহারাজ তাই তিন নম্বর টিয়াটি সেই চিকিৎসকের হাতে তুলে দেন। জয়পুরের রাজা মারা যাওয়ার পর তিনি উদয়পুরের মহারাজার কাছে চাকরি নিয়ে চলে যান। পবনদেওর রিয়াল এস্টেটের বিজনেসে মন্দা চলছে বলে টিয়াটি যোশীর কাছে বেচতে চান। কিন্তু বুঝতেই পারছ টিয়া আসল কিনা সেটা আগে ভেরিফাই করা দরকার। যোশী তাই অনূকুলের সাজেশনে জয়সওয়াল এবং টিয়া দু’জনকে নিয়েই আমার কাছে ভেরিফাই করতে চলে এসেছেন। সোনাদানা খাঁটি কিনা সে তো যে কোনো স্যাকরাই বলে দেবে কিন্তু আসল কথাটা হল প্যারিসের সেই শিল্পীই এই টিয়া বানিয়েছিলেন কিনা সেটা জানা দরকার।’
‘পেলেন প্রমাণ?’
‘দাঁড়াও, তোমাকে সে টিয়ার একটা ছবি দেখাই। জয়সওয়ালই সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিল’, তক্তপোষে রাখা গাদাখানেক বইয়ের একটার ভেতর থেকে সিধুজ্যাঠা একটা ফটোগ্রাফ টেনে বার করলেন, “ফেলু, ওদিক থেকে ম্যাগনিফাইং গ্লাসটা দাও তো”।
কালারড ছবিতেই টিয়া পাখিকে দেখে আমার মাথা প্রায় ঘুরে যাচ্ছিল, এরকম চোখধাঁধা্নো শিল্পকর্ম আমি আগে দেখিনি। টিয়ার দু’টো চোখের রুবিগুলো ছবিতেও যেন ঝলসে ঝলসে উঠছে, ডানায় অর্ধচন্দ্রাকারে সার দিয়ে বসানো হীরেগুলো দেখেই বোঝা যাচ্ছে এ জিনিস অমূল্য।
টিয়াপাখির মুখে ধরা যে ফুল তার ওপর এবার ম্যাগনিফাইং গ্লাস ফেললেন সিধুজ্যাঠা, ‘কিছু দেখতে পাচ্ছ ফেলু?’
‘পেয়েছি। ফুলের তিনটি পাপড়ির ওপর সোনার জলে তিনটি ইংরেজি অক্ষর খোদাই করা – এইচ, এম, ভি। খুবই ছোট করে খোদাই করা যদিও।’
‘ফ্যান্টাসটিক। এই এইচ – এম – ভি’র মানে কিন্তু হিজ মাস্টার্স ভয়েজ নয়। এই তিন আদ্যক্ষরের মানে হেনরিয়েটা মারিয়া ভিনসেন্ট।’
ফেলুদা একটু অবাক হয়ে বলল, ‘শিল্পী তাহলে মহিলা ছিলেন?’
‘উঁহু, হেনরিয়েটা মারিয়া ছিলেন শিল্পীর স্ত্রী। জয়পুরের মহারাজা নিজেই অনুরোধ করেছিলেন শিল্পীকে তাঁর নামের আদ্যক্ষরগুলো কাজটিতে রেখে দিতে; ভদ্রলোক নিজের নামের জায়গায় তাঁর স্ত্রীর নামটি অমর করে দিয়ে গেছেন। হাতে গোনা কয়েকজন মানুষই শিল্পীর এই কেরামতির খবরটুকু রাখেন।’
‘এ তো বিশাল খবর! তাহলে মাধবরাও যোশী এই তৃতীয় টিয়ার বর্তমান মালিক ?’
সিধুজ্যাঠা বসে পড়লেন, ‘সেখানেই যে সমস্যা ফেলু, জিনিসটা থাকলে তবে তো মালিক। সে টিয়া মিসিং।’
‘মিসিং?’ ফেলুদার চোখের পলক নড়ছে না।
‘খুবই রহস্যজনক ব্যাপার ফেলু। কাগজে দেখেছ বোধহয় ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের এমপ্লয়ীরা সারা সপ্তাহ ধরে স্ট্রাইক ডেকেছে। তাই খানিকটা বাধ্য হয়েই ওদের বিকালবেলার রাজধানী এক্সপ্রেস নিতে হয়েছিল। সকালবেলা উঠে দেখছে অ্যাটাচি কেস যেমনকার তেমন আছে, শুধু ভেতরে টিয়াটাই নেই। অথচ অ্যাটাচি কেসের চাবি যোশীর কোটের ভেতরের পকেট থেকে এক চুলও নড়েনি।
‘ভেরি স্ট্রেঞ্জ। কিন্তু আপনি জানলেন কি করে?’
‘গতকাল জয়সওয়াল ফোন করেছিল। সেই জানাল সব খবর। বলা বাহুল্য যে যোশী এবং জয়সওয়াল দু’জনেই অত্যন্ত ওরিড, যেনতেনপ্রকারেণ তারা টিয়াটি ফেরত পেতে চায়। জয়সওয়াল পার্সোন্যালি রিকুয়েস্ট করেছে তুমি যাতে কেসটা নাও।’
‘জয়সওয়াল আমাকে চেনেন নাকি?’ ফেলুদার মুখ দেখেই বোঝা গেল এ খবরটা সত্যিই সারপ্রাইজিং।
সিধুজ্যাঠা হাসলেন, ‘চিনত না। এই এবারে আমার বাড়ি এসেই চিনেছে। ওদের কাছে গল্প করছিলাম রেসকোর্সের খুনের মামলাটা তুমি কী ব্রিলিয়ান্টলি সলভ করেছ। বুঝতেই পারছ তোমার কীর্তিকলাপ জয়সওয়ালকে কতটা ইনফ্লুয়েন্স করেছে। আর পুলিশের ব্যাপার তো জানোই, তাদের আঠারো মাসে বছর।’
ফেলুদা চুপ করে কিছু একটা ভাবছিল, সিধুজ্যাঠার কথা শেষ হলে বলল, ‘আপনি ওনাকে জানিয়ে দিন আমি আসছি। আজ বিষ্যুতবার, শনিবার আমরা দিল্লী পৌঁছব রাজধানী এক্সপ্রেসে। সেরকম হলে নয় রবিবারেই জয়সওয়ালের সঙ্গে দেখা করা যাবে।’
‘বাঁচালে ফেলু’, সিধুজ্যাঠা ফেলুর হাত ধরে বললেন, ‘জয়সওয়াল উঠেছে হোটেল মেট্রোপলিটানে, আমি তোমাকে হোটেলের অ্যাড্রেস আর ফোন নম্বরটা দিয়ে দিচ্ছি। তুমি দিল্লী পৌঁছেই ওর সাথে দেখা করে নিও।’
৩
রাজধানীতে জটায়ু এই বোধহয় প্রথম চড়লেন। সিটের গদিতে যে ভাবে বারকয়েক হাত বোলালেন তাতে বোঝাই গেল দারুণ ইম্প্রেসড হয়েছেন।
‘বুঝলেন, আমাদের পাড়ার নগেন সমাদ্দার বলছিল লালুদা ওই ট্রেনে চড়ার পর আর অন্য সব ট্রেন মনে হবে মার্টিনের ন্যারোগেজের ছ্যাকড়াগাড়ি। ছোঁড়া একদম খাঁটি কথা বলেছে।’ এই সময় ট্রেনের অ্যাটেন্ডান্ট আমাদের কুপে ঢুকে প্রত্যেককে একটা করে গোলাপ ফুল দিয়ে গেলেন।
লালমোহনবাবু ফুলটা ধরে বললেন, ‘নিজেকে শাহাজান শাহাজান মনে হচ্ছে মশাই। উফফ! গাড়িতে উঠতে না উঠতেই কী খাতির যত্ন।’
ফেলুদা সুটকেসটা সীটের তলার ঢোকাতে ঢোকাতে বলল, ‘তাহলেই ভাবুন, শাহাজানেই এই। শাজাহান বললে না জানি আরো কত আদর আপ্যায়ন পাবেন’।
লালমোহনবাবু একটু থমকে গেছিলেন, তারপর গদিতে একটা জোর চাপড় দিয়ে হেসে উঠতে গিয়েও থেমে গেলেন। কুপের চতুর্থ যাত্রীটি ঢুকে পড়েছেন। লালমোহনবাবু আমার দিকে তাকিয়ে যেরকম মুখভঙ্গি করলেন তাতে বেশ টের পাওয়া গেল আমরা তিনজন ছাড়াও যে আরেকজন যাবেন সেই সম্ভাবনার কথাটা ওনার মাথাতেই ছিল না।
ভদ্রলোক আমাদের দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন, ‘গুড ইভনিং।’ চল্লিশ পেরিয়ে গেছেন বলেই মনে হল, মাথার চুলে যদিও সামান্য পাক ধরেছে।
‘গুড ইভনিং মিস্টার সোলাঙ্কি’, বলল ফেলুদা।
ভদ্রলোক এবার স্পষ্ট বাংলায় বললেন, ‘আপনি কী গাঙ্গুলি না মিটার?’
লালমোহনবাবু দু’জনের কথাবার্তা শুনে প্রায় হাঁ হয়ে গেছিলেন। আমাকে তাই বলতে হল কামরার বাইরে রাখা রিজার্ভেশন লিস্টে চোখ বোলালেই সবার পদবীগুলো দেখে নেওয়া যায়।
‘মিটার, আমার নাম প্রদোষ মিত্র। এ আমার খুড়তুতো ভাই তপেশরঞ্জন মিত্র, আর ইনি আমাদের বন্ধু লালমোহন গাঙ্গুলী।’
সোলাঙ্কি ফেলুদা আর লালমোহনবাবু দু’জনকেই একটা করে ভিজিটিং কার্ড দিলেন। ফেলুদা কার্ডে একবার চোখ বুলিয়ে বলল, ‘লিটল রাসেল স্ট্রীটের সোলাঙ্কি জুয়েলার্সটা কী আপনারই দোকান?’
‘গ্রেট, একদম ঠিক ধরেছেন’, জানালেন সত্যেন্দ্র সোলাঙ্কি, ‘জুয়েলারি নিয়ে আমাদের চার পুরুষের ব্যবসা। কলকাতায় ব্যবসাটা আমিই দেখি। নর্থ ইন্ডিয়ায় ব্যবসা চালায় আমার ভাইরা। দিল্লীতে বিজনেসের কাজেই যাচ্ছি যদিও, ভাইদের সঙ্গেও দেখা হয়ে যাবে। আপনাদেরও বিজনেস নাকি ঘুরতে চললেন?’
ফেলুদাকে খানিকটা বাধ্য হয়েই নিজের কার্ডটা দিতে হল। কার্ড দেখে সোলাঙ্কি বললেন, ‘কি বলব মিস্টার মিটার, জীবনে এই প্রথম কোনো প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটরের সঙ্গে আলাপ হল। তা দিল্লী চললেন কী কোনো কেসের কাজে?’
ফেলুদা লালমোহনবাবুর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এনার জন্যই দিল্লী যাওয়া। কলকাতায় বসে যা যা প্লট ভাবার ছিল সব ভেবে ফেলেছেন, এখন শহরের বাইরে যাওয়া ছাড়া গতি নেই।’
‘কেয়া বাত মিস্টার গাঙ্গুলি, আপনি রাইটার নাকি?’
‘হেঃ, ওই একটু আধটু’, লালমোহনবাবু দেখলাম বিনয় দেখাতে গিয়ে প্রায় চোখ বুজে ফেললেন। সোলাঙ্কি বাঙালি রাইটারদের ভুরি ভুরি প্রশংসা করে বললেন, ‘আমি একটু টয়লেট থেকে ফ্রেশ হয়ে আসি। এসে কিন্তু আপনার লেখার গল্প শুনব। কাস্টমারদের বায়নাক্কা শুনে শুনেই জীবন কেটে গেল, কোনো উত্তেজনা নেই মশাই লাইফে। একটু থ্রিল না হলে চলে বলুন তো?’
সোলাঙ্কি বেরোলে লালমোহনবাবু বললেন, ‘দিব্যি লোক। একজন অবাঙালি বাংলা সাহিত্য নিয়ে এত খোঁজখবর রেখেছে, ভাবাই যায় না। কি বলেন?’
ফেলুদা ভুরু কুঁচকে কি যেন ভাবছিল। লালমোহনবাবুর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘হুঁ, একটু বেশিই খবর রাখেন।’
লালমোহনবাবু ধড়মড় করে উঠে বসে বললেন, ‘কী ব্যাপার মশাই? এর মধ্যেই সাসপিশাস কিছু দেখলেন নাকি?’
‘নাহ, সেরকম কিছু নয়। আপনারা বসুন, আমি একটু ঘুরে আসি’। ফেলুদার গলাটা একটু অন্যমনস্ক কি?
লালমোহনবাবু ঝিম মেরে কিছুক্ষণ বসে রইলেন। তারপর আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমার দাদার কী ব্যাপার বলো তো তপেশ? আমার কিন্তু সোলাঙ্কিকে দিব্যি লাগল।’ ফেলুদা যে কি ভাবছে সে নিয়ে আমারও কোনো আইডিয়া নেই, সেটাই বললাম ভদ্রলোককে।
‘অনেকদিন হাতে কেস আসেনি বলে বোধহয় তোমার দাদা একটু উত্তেজিত হয়ে আছেন’। লালমোহনবাবুর কথায় খেয়াল পড়ল ফেলুদা এখনো ওকে জয়পুরী টিয়া নিয়ে কিছু বলেনি।
ফেলুদা একটু পরেই ফিরে এল, এখন একেবারে স্বাভাবিক মুখ। আর একটু পরেই সোলাঙ্কিও এসে ঢুকলেন। চান করে এলেন বোঝা যাচ্ছে, গা থেকে ভুরভুর করে পারফিউমের গন্ধ বেরোচ্ছে। বাকি সময়টুকু গল্পগুজবেই কেটে গেল, সোলাঙ্কি লালমোহনবাবুর প্লট শুনে কখনো বললেন, ‘গুড গড’, কখনো বললেন ‘লোম খাড়া হয়ে যাচ্ছে মশাই’। ফেলুদা সেরকম ভাবে আড্ডায় না ঢুকলেও টুকটাক কথা বলছিল অবশ্য।
খাওয়ার পরে সোলাঙ্কি বললেন, ‘দুটো আপারই তো আপনাদের। আমি যদি একটা লোয়ারে শুয়ে পড়ি, উড ইউ মাইন্ড? আমার আবার কালকে দিল্লী পৌঁছেই ছোটাছুটি করতে হবে, একটা ভালো ঘুম দরকার।’
আমাদের কারোরই অসুবিধা নেই। সোলাঙ্কির ওপরের আপার বার্থে গেলাম আমি; লালমোহনবাবু নিলেন অন্য আপার বার্থ, বললেন ইদানীং আপার বার্থেই নাকি ওনার ভালো ঘুম হয়।
মাঝরাতের দিকে একবার ঘুমটা ভেঙ্গে যেতে নীচে কোনাকুনি নজর গেল।
কুপের হাল্কা নীলচে আলোতেও দেখতে পেলাম ফেলুদার চোখ দুটো খোলা।
সোলাঙ্কি ভালোই ঘুমোচ্ছেন, হাল্কা নাক ডাকার একটা আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে।
আবার কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম খেয়াল নেই, সকালে ব্রেকফাস্ট নিয়ে অ্যাটেন্ডান্ট আসার পর ঘুম ভাঙ্গল।
সকাল দশটা কুড়িতে পৌঁছনোর কথা, নিউ দিল্লী স্টেশনে রাজধানী ঢুকে গেল দশটা পনেরোয়। লালমোহনবাবু বললেন, ‘ভারতবর্ষে একটা ট্রেন বিফোর টাইম পৌঁছচ্ছে, এটা ভাবতে পারেন? ধন্য রাজধানী এক্সপ্রেস’। সোলাঙ্কি যাওয়ার আগে হ্যান্ডশেক করে গেলেন, ফেলুদাকে বললেন ‘কলকাতায় ফিরলে একবার আসবেন আমাদের দোকানে, খুব ভালো লাগবে।’
জনপথের কাছে লালমোহনবাবুই হোটেলের ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। ফেলুদা হোটেলে ঢুকেই আগে রিসেপশনে গেল ফোন করতে, বুঝলাম জয়সওয়ালকে পৌঁছনোর সংবাদটা দেবে। আমাকে বলে গেল জটায়ুর ঘরে ওয়েট করতে।
লালমোহনবাবু বিছানায় আয়েশ করে ঠেস দিয়ে বসে বললেন, ‘সেই সিমলা যাওয়ার সময়ে দিল্লী এসেছিলাম, মনে আছে তপেশ?’
মনে আর থাকবে না? এখনো ভাবলে গায়ে কাঁটা দেয়। খুব অল্প সময়ের জন্যই দিল্লীতে ছিলাম, কিন্তু তার মাঝেই ফেলুদার ওপর হামলা হয়েছিল।
হামলার কথা লালমোহনবাবুর খেয়াল আছে কিনা বোঝা গেল না, আমাকে বললেন, ‘দিল্লী নিয়ে এথিনিয়াম ইস্কুলের বৈকুন্ঠ মল্লিক এমন কবিতা লিখেছিলেন, এখনো আবৃত্তি করলে লোম খাড়া হয়ে ওঠে। শুনবে নাকি?’, বলে অবশ্য আমার উত্তরের জন্য অপেক্ষা না করেই চোখ বুজে আবৃত্তি শুরু করলেন –
নিখিল বিশ্ব ক্রন্দনরত, ভেসেছে যমুনা তীর
তৈমুর নামে ঘাতকে তোমার ছিন্ন করেছে শির।
হৃদিমূলে মম জ্বলেছে বহ্নি, রুষিয়া উঠেছে তেজ,
তবু দেখি ঠাঁই পেয়েছে হেথায় মুঘল আর ইংরেজ।
অহো দিল্লী, তুমিই সেই জনগণরাজধানী
হিংসারে ফেলি রেখেছ যতনে চিরশান্তির বাণী।
লালমোহনবাবু চোখ বন্ধ করেই বললেন, ‘শহরটা নিয়ে কবির আবেগ দেখেছ তপেশ? আর প্রতিহিংসা নয়, ভালোবাসাই যে আসল কথা সেটা দু লাইনেই কেমন মনে করিয়ে দিলেন বলো?’
‘খুব ভালোবেসে বোধ হয় মুঘল বা ইংরেজ কাউকেই এ শহর ঠাঁই দেয় নি’, ফেলুদা যে কখন ফিরে এসেছে খেয়াল করিনি।
লালমোহনবাবু প্রতিবাদের ভঙ্গীতে হাতটা ওঠালেন, ‘কী বলছেন মশাই? কত বছর ধরে রাজত্ব করে গেল সব।’
‘সেটাই কথা লালমোহনবাবু, রাজত্ব করার জন্যই তো এসেছিল। ভালোবাসা পেতে এসেছিল কী?’
লালমোহনবাবু খুব একটা কনভিন্সড হয়েছেন বলে মনে হল না। ফেলুদা অবশ্য তাতে পাত্তা না দিয়ে বলল, ‘চলুন খাওয়াদাওয়াটা সেরে ফেলা যাক। আপনার সাহিত্যমেলা তো শুরু হচ্ছে আজ বিকালে, তাই না? দিল্লী শহরটা ঘোরার মতন এখনো কিছু সময় আছে তাহলে’।
আমার মনটা ছটফট করছিল ফোনে কী কথা হল শোনার জন্য কিন্তু ফেলুদা দেখলাম সেসবের ধারেকাছে গেল না।
অক্টোবরের শুরু বলে দুপুরের দিকটাতেও বেশ চমৎকার আবহাওয়া। আমরা জনপথ থেকে একটা ট্যাক্সি নিয়ে সোজা চলে এসেছি কুতব মিনারে। ঘুরতে আসার প্ল্যানটা ফেলুদারই। লালমোহনবাবু ট্যাক্সিতে আসতে আসতেই বলছিলেন, ‘গায়ে কাঁটা দিচ্ছে ভাই তপেশ, কুতুব মিনার দেখার শখ কী আজকের? ফরটি টু’তে জ্যাঠা মোহিনীমোহন দিল্লী ঘুরতে এসেছিলেন। গড়পারের বাড়িতে বসে কুতুব মিনারের কত গপ্পো যেই শুনিচি, ওফ! বেলাডোনা পালসেটিলা খেতাম আর স্বপ্ন দেখতাম আমিও একদিন ঘুরতে আসব। তা সে স্বপ্ন অ্যাদ্দিনে সত্যি হতে চলেছে।’
প্রায় সাড়ে সাতশ বছর আগে কুতব উদ দিন আয়বক যে মিনার বানিয়ে গেছিলেন সেটা অবশ্য এখন দেখা যাবে না। প্রথমে বাজ পড়ে, তারপর ভূমিকম্পে আসল মিনার প্রায় বেপাত্তা হয়ে আছে। এখন যা রয়ে গেছে তা মূলত ব্রিটিশ আমলে বানানো। কুতব মিনারের প্রায় পাশেই বিখ্যাত লৌহস্তম্ভ; শোনা যায় দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত ,যাঁকে আমরা বিক্রমাদিত্য নামে জানি, নাকি বানিয়েছিলেন এই লোহার পিলারটি।
লালমোহনবাবু খানিকক্ষণ হাঁ করে থেকে বললেন, ‘এক ফোঁটা মরচে নেই। ভাবতে পারো? অথচ সেই যে রাজস্থানে নেপালি কুকরিটা নিয়ে গেছিলাম তাতে অলরেডি জং ধরে গেছে। কলিযুগে বেঁচে থেকে সুখ নেই ভায়া।’
ফেলুদা সবে প্রশ্ন করেছে ‘বিক্রমাদিত্য কোন যুগের রাজা ছিলেন বলে আপনার মনে হয়’, আর ঠিক সেই সময় একটা ঢিল এসে লালমোহনবাবুর কাঁধে থাকা ঝোলায় লেগে পড়ে গেল। লালমোহনবাবু চমকে উঠে পড়েই যাচ্ছিলেন, আমি তাড়াতাড়ি ধরে না ফেললে একটা দুর্ঘটনা ঘটতে পারত। ফেলুদাকে ডাকব বলে ঘুরে দেখি ফেলুদা বাহারী কাজ করা খিলানগুলোর দিকে সোজা দৌড় দিয়েছে।
‘ভাই তপেশ, এটা কী ব্যাপার বলো তো?’, ঘুরে দেখি লালামোহনবাবুর হাতে ধরা একটা ছোট্ট চিরকুট, ভদ্রলোকের মুখটা পুরো ফ্যাকাশে হয়ে গেছে।
চিরকুটটা হাতে নিয়ে দেখি ইংরেজিতে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা, ‘টিয়ার হদিশ ছেড়ে কলকাতা ফিরে যাও, নইলে ঘোর বিপদ।’
মিনিট পাঁচেক বাদে ফেলুদা ফিরল। ওকে চিরকুটটা দিতে শুধু এক ঝলক দেখে গম্ভীর গলার বলল ‘হুঁ।’
তারপর লালমোহনবাবুর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আপনি ঠিক আছেন তো? আমাদের এখানে আরো ঘন্টাখানেক কাটানো দরকার।’
লালমোহনবাবু ঘাড় নাড়লেন, খুব একটা ইচ্ছা নেই বলেই মনে হল যদিও। এরকম একটা দুর্ঘটনার পরেও ফেলুদা থাকার জন্য ইনসিস্ট করছে দেখে আমিও একটু অবাক হলাম।
৪
‘আপনাকে আজ রাত্রেই ধীরে সুস্থে বলব ভেবেছিলাম। কিন্তু ঘটনা যে দিকে মোড় নিয়েছে তাতে আপনাকে আর অপেক্ষা করিয়ে লাভ নেই।’ আমরা চিত্তরঞ্জন পার্কের একটা চায়ের দোকানে এখন বসে। জটায়ুর মূহ্যমান ভাবটা এখনো ঠিক কাটেনি, ফেলুদার কথায় এবার একটু নড়েচড়ে উঠলেন। ‘কী ব্যপার বলুন তো ফেলুবাবু?’
ফেলুদার থেকে জয়পুরের টিয়ার ঘটনাটা শোনার পরে লালমোহনবাবু বেশ অবাকই হলেন। ‘কিন্তু মশাই, আপনি তো কেসটা বলতে গেলে হাতেই নেন নি। অকুস্থলে গিয়েই উঠতে পারলেন না অথচ এর মধ্যেই পেছনে লোক লেগে গেল?’
‘লোক যে লেগেছে সেটা পরিষ্কার, কিন্তু কখন থেকে লেগেছে সেটাই প্রশ্ন।’
‘তার মানে বলছেন আমরা হোটেল থেকে বেরনো ইস্তক ফলো করছিল?’
ফেলুদা মাথা নাড়ল, ‘লোকটাকে এক ঝলকই দেখতে পেয়েছিলাম, দূর থেকে মনে হল একটা ট্যুইডের জ্যাকেট পরেছিল। হোটেল থেকে বেরনোর সময় এরকম কাউকে চোখে পড়েনি। হতেই পারে যে ফলো করছিল তার চোখে ধূলো দেওয়ার অসীম ক্ষমতা। যদি না……’
‘যদি না কী মশাই?’
‘কলকাতা থেকেই পিছু নিয়ে থাকে।’
লালমোহনবাবু কপালের ঘাম মুছে বললেন, ‘বলেন কী? ক্ক-কলকাতা থেকেই?’
ফেলুদা চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বলল, ‘সম্ভব সবই। আমাকে আরো একটা জিনিস ভাবাচ্ছে।’ বলে চুপ করে গেল।
আমি আর লালমোহনবাবু দু’জনেই তাকিয়ে আছি বুঝতে পেরে তারপর অবশ্য মুখ খুলল, ‘জয়সওয়াল কেন এলেন না।’
আমি অবাক। জয়সওয়ালেরও তাহলে কুতব মিনারে আসার কথা ছিল?
‘সকালে উনিই তো সাজেস্ট করলেন। বললেন দিল্লীর ওই দিকটাই একটু নিরিবিলি আছে, আর দুপুরের দিকে একটু কম লোক থাকে’, বলল ফেলুদা।
আমি বললাম, ‘আর কী বললেন জয়সওয়াল?’
‘বেশী কিছু নয়, তবে গলাটা শুনে মনে হল বেশ ঘাবড়ে আছে। আমাকে বললেন যোশীর সঙ্গে মীট করানোর আগে উনি আলাদা করে আমার সঙ্গে দেখা করতে চান, কিছু জরুরী কথা আছে। ব্যাপারটা বোঝা যাচ্ছে না, দেখি হোটেলে ফিরে আবার ফোন করতে হবে।’
লালমোহনবাবু এতক্ষণে একটু চাঙ্গা হয়েছেন বলে মনে হল। হাসি হাসি মুখে বললেন, ‘আপনি রহস্যকে ছাড়তে চাইলেও মশাই রহস্য আপনাকে ছাড়বে না। আপনার কাছে যদিও এ রহস্য নস্যি। চুরির মাল ফেরত পেতে বেশী সময় লাগবে না।’
ফেলুদা চারমিনারে আগুন ধরাতে ধরাতে বলল, ‘আপনার মুখে আবার খাবো দেদার পড়ুক, সিধুজ্যাঠাকে আশাহত হতে দেখলে সত্যিই খারাপ লাগবে।’
চায়ের দোকান থেকে বেঙ্গলি অ্যাসোশিয়েশনের অফিস কাম পুজোর জায়গাটা হেঁটে আরো মিনিট দশেক মতন। লালমোহনবাবু ওই দশ মিনিট হাঁটতে গিয়ে একেবারে ছেলেমানুষের মতন উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে শুরু করলেন। শুরু হয়েছিল ‘কমলা ভান্ডার’ নামের একটা মুদির দোকানে দশকর্মার জিনিসপত্র দেখে। তারপর ‘বেঙ্গল স্যুইটস হোম’-এ রসগোল্লা আর পান্তুয়ার সাজানো ট্রে দেখে বেজায় খুশী হলেন, শেষে বৈকালিক মাছের বাজারে ঢাউস ঢাউস রুই আর কাতলা মাছ কাটা হচ্ছে দেখে উত্তেজনার চোটে ফেলুদার জামার আস্তিন ধরে বললেন, ‘বাঙালিরা করেছে কী মশাই? পুরো দিল্লী তো আমাদেরই দখলে।’
ফেলুদা বলল, ‘তাও তো দুর্গাপুজোর কথাটাই বাদ গেল। তবে দিল্লীর পুজো শুধু বাঙালির নয় সেটা মনে রাখা দরকার।’
আজকে পঞ্চমী কিন্তু শনিবার পড়েছে বলে পুজোর জায়গায় মেলা লোক। লালমোহনবাবু গিয়ে হাজির হতে বেশ সাড়াই পড়ে গেল। বাঙালি অ্যাসোশিয়েনশনের তরফ থেকে যিনি চিঠি পাঠিয়েছিলেন তিনি লালমোহনবাবুর পূর্বপরিচিত, নাম প্রণব পাইন। প্রণববাবু দু’হাত জড়ো করে বললেন, ‘স্বনামধন্য গোয়েন্দা প্রদোষ মিত্র আমাদের পুজোয় এসেছেন, এটা ভাবাই যাচ্ছে না।’
ফেলুদা নমস্কার ফিরিয়ে বলল, ‘আমি যে গোয়েন্দা সে কথা আপনি জানলেন কী করে? লালমোহনবাবু বলেছেন নাকি?’
‘কি বলছেন মশাই, আপনি এখানে লালমোহনবাবুর মতনই সেলিব্রিটি। আনন্দবাজারটা আমরা সবাই পড়ি এখানে, হ্যাঁ সকালের টাটকা খবর পেতে পেতে সন্ধ্যা হয়ে যায় কিন্তু তাও পড়া চাই। রেসকোর্সে খুন বলুন বা উইলিয়াম ড্যানিয়েলের ছবি চুরি, রিসেন্ট টাইমসে যা যা কেস আপনি সলভ করেছেন তা আমাদের মুখস্থ।’
ফেলুদা একটা বিব্রত হাসি দিতে যাচ্ছিল, আচমকা কিছু একটা মনে পড়ায় প্রণববাবুকে বলল, ‘ওহ হো, একটা কথা ছিল। অনুকূল ভদ্র নামে কাউকে চেনেন কী? দিল্লীতে বছর দশেক হল আছেন।’
প্রণববাবু আশ্চর্য হয়ে বললেন, ‘অনুকূল দা’র সঙ্গে আপনার আলাপ আছে নাকি? আমার তো ধারণা ছিল বেঙ্গলি অ্যাসোশিয়নের লোকজন ছাড়া কেউই ওনাকে চেনেন না। উনি তো এখানেই আছেন এখন।’
বলে প্রণববাবু ভেতরের দিকে তাকিয়ে হাঁক ছাড়লেন, ‘অনুকূলদা কে একটু পাঠিয়ে দাও তো এদিকে। বলো ওনার সঙ্গে দেখা করতে কয়েকজন ভদ্রলোক এসেছেন।’
প্রণববাবুর কথা শুনে আমি আর লালমহনবাবু দু’জনেই বেশ চমকেছি। ফেলুদা শান্ত স্বরেই জিজ্ঞাসা করল, ‘দিল্লীর বাঙালিরা তাহলে মোটামুটি সবাই সবাইকে চেনেন?’
প্রণববাবু হেসে ফেললেন, ‘আজ্ঞ তা ঠিক নয়। তবে অনুকূল বাবু আমাদের সম্মানীয় সদস্য, প্রায় সাত আট বছর হল অ্যাসোশিয়েশনের সঙ্গে যুক্ত।’
ভেতর থেকে একটি ছেলে এসে খবর দিয়ে গেল অনুকূল বাবু কি কাজে ব্যস্ত আছেন, আসতে একটু দেরী হবে। প্রণববাবু বললেন, ‘আপনারা ততক্ষণ একটু বিশ্রাম নিন।অনুকূলদা বোধহয় কালকে আমাদের যে নাটকটা হবে তার সাজসজ্জার তদারকি করছেন।’
ফেলুদা বলল ততক্ষণে বরং প্রতিমা দেখে আসা যাক।
একচালার প্রতিমাটা বেশ লাগল আমার। অবশ্য শুধু মূর্তি নয়, আন্তরিকতার দিক থেকেও এখানে একটা ঘরোয়া ব্যাপার খুঁজে পেলাম। আজকে যদিও অ্যাসোশিয়েশনের সদস্যরা বেশী ব্যস্ত সাহিত্যমেলার ব্যবস্থাপনা নিয়ে।
লালমোহনবাবু যে দিল্লী নিয়ে থরোলি ইম্প্রেসড সেটা বেশ বোঝা গেল যখন উনি বললেন, ‘অসুরকে কিরকম তেজীয়ান বানিয়েছে দেখছেন, দেখলেই মনে হয় মা দুর্গার সঙ্গে সমানে ফাইট দিয়ে যাবে। কলকাতার অসুরগুলোকে মশাই দেখলে মনে হয় সদ্য ম্যালেরিয়া থেকে উঠে এসেছে।
‘ইয়ে, এ প্রতিমা কিন্তু কুমোরটুলির শিল্পীরাই বানিয়েছেন। প্রত্যেকবারই ওনারা দিল্লীতে এসে প্রতিমা বানিয়ে দিয়ে যান।’
পেছন থেকে কথাগুলো ভেসে আসতে ঘুরে দেখি হাই পাওয়ারের চশমা পরা এক ক্লীন শেভড ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে। আমাদের দেখে হেসে বললেন, ‘নমস্কার, আশা করি কিছু মনে করেন নি আগ বাড়িয়ে কথা বলার জন্য।’
‘মনে করার কোনো প্রশ্নই নেই, তবে এ অসুর কলকাত্তাইয়া শুনে আমার বন্ধুটি সম্ভবত নিরাশ হয়েছেন। আপনার পরিচয় টা?’
ভদ্রলোক হাসলেন, ‘আমার নাম হয়ত আপনারা সিদ্ধেশ্বরবাবুর থেকে শুনে থাকবেন, অনুকূল ভদ্র।’
‘অফ কোর্স, আমি তো ভাবছিলাম আজকে রাত্রেই না একবার আপনার কাছে যেতে হয়।’
ভদ্রলোক একটু আশ্চর্য হলেন, ‘আমার কাছে? কোনো দরকার ছিল কী?’
ফেলুদা বলল, ‘তার আগে বলুন তো আপনি কি শুনেছেন জয়পুরের সেই টিয়াটি মিসিং?’
অনুকূল ভদ্র আকাশ থেকে পড়লেন, ‘কী বলছেন? কবে ঘটল এ কান্ড? আমি তো কিছুই জানি না’।
‘পবনদেও বা মাধবরাও কেউই তাহলে আপনাকে এ ব্যাপারে কিছু জানান নি?’
‘নাহ্, ইন ফ্যাক্ট সিদ্ধেশ্বরবাবুর কাছে ওরা যাওয়ার পর থেকে আর কোনো কথাই হয় নি।’
‘হুম।’
ফেলুদা আর কিছু বলল না দেখে অনুকূল বাবু জটায়ুর দিকে ঘুরে বললেন, ‘আপনার বক্তৃতা শোনার জন্য কিন্তু মুখিয়ে আছি মশাই।’
লালমোহনবাবু হাসতে যাচ্ছিলেন, আচম্বিতে মুখটা কিরকম শুকিয়ে গেল। আমি জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছি কী হয়েছে, এমন সময়ে প্রণব পাইন এসে হাজির। ‘এবার তাহলে প্রোগ্রামটা শুরু করি লালমোহনবাবু? আপনাকে দিয়েই শুরু, তারপর সাহিত্যপাঠের আসর শুরুর হবে।’ এই সময় অনুকুল বাবুর দিকে চোখ পড়াতে বলে উঠলেন, ‘অনুকূল দা, কালকের নাটকের জন্য সব রেডি তো?’
‘নাটক নিয়ে কোনো চিন্তা নেই ভাই, সব তৈরি। মেক আপের সরঞ্জামগুলো খালি বাড়ি থেকে নিয়ে আসতে হবে কাল। তোমার নাটককে উতরিয়ে দিয়ে তবে আমার ছুটি।’
প্রণববাবু ফেলুদার দিকে হেসে বললেন, ‘অনুকূল দা যবে থেকে দিল্লীতে আস্তানা গেড়েছেন বেঙ্গলি অ্যাসোশিয়েশনকে বাৎসরিক নাটক নিয়ে আর চিন্তা করতে হয় না। স্টেজ ডেকরেশন বলুন, কস্টিউম, মেক আপ সব কিছুর দায়িত্ব অনুকূলদার।’
অনুকূল বাবুকে দেখে ইস্তক আমার কি একটা অস্বস্তি হচ্ছিল, প্রণব পাইনের সঙ্গে ভদ্রলোক চলে যাওয়ার পর ফেলুদাকে সে কথা বলতে উত্তর এল, ‘সিঁথি।’
যাঃ বাবা, সে আবার কী?
‘ভদ্রলোকের চুলের সিঁথিটা ডানদিকে করা। আপনিও কী উল্টোদিকে সিঁথি দেখেই নার্ভাস হয়ে পড়লেন লালমোহনবাবু?’
ফেলুদার কথায় একেবারে হাঁইমাই করে উঠলেন ভদ্রলোক ‘আরে মশাই, আমাকে যে কিছু বলতে হবে সেটাই ভুলে গেছিলাম। এখন পা কাঁপছে।’
‘এটা একটা কথা হল! এত প্লট গজগজ করছে মাথায়, মিনিট কুড়ি তিরিশ ম্যানেজ করতে পারবেন না?’
ফেলুদা যে নেহাতই মজা করছে সেটা বুঝতে জটায়ুর অসুবিধা হয় নি, তবে স্লাইট খোঁচাটা বোধহয় ধরতে পারেননি। বিনীত স্বরে অভিযোগ করলেন, ‘মাঝে মাঝে এত লজ্জায় ফেলে দেন ফেলুবাবু।’
খারাপ অবশ্য বললেন না ভদ্রলোক। কিশোর কিশোরীদের জন্য কল্পনার রাজ্য উন্মুক্ত করে দিতে রহস্য রোমাঞ্চ উপন্যাসেরও যে অবদান আছে সেটাই ছিল ওনার মূল বক্তব্য। শুরুতে খালি রবীন্দ্রনাথের ‘ওরে নবীন, ওরে আমার কাঁচা’ লাইনটা বার দুয়েক রিপিট করে হাল ছেড়ে দিলেন, বোধহয় বাকিটা মনে ছিল না। আর শেষের দিকে ওনার আণবিক দানব উপন্যাসে আইনস্টাইনের কি প্রভাব ছিল সেটা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে আপেলগাছের কথা টেনে এনেছিলেন। আমি বক্তৃতার শেষে ভুলটা ধরিয়ে দিতে জটায়ু মোটেও মাইন্ড করলেন না, বেশ খুশ মেজাজেই বললেন, ‘তপেশ ভাই, আপেলটা কার মাথায় পড়েছিল সেটা আসল কথা নয়, কথাটা হল আপেলটা পড়েছিল বলেই না আইডিয়াটা এসেছিল। ভালো কথা, ফেলুবাবু কই?’
তাকিয়ে দেখি ফেলুদা অনুকূল ভদ্রের সঙ্গে কথা বলতে বলতে আমাদের দিকেই আসছে। এসে বলল, ‘হোটেল মেট্রোপলিটানে ফোন করে জয়সওয়ালকে পাওয়া গেল না। ওনার রুমে ফোন বেজেই যাচ্ছে। ভাবছি একবার হোটেলটা ঘুরেই আসি। হয়ত কোথাও বেরিয়েছেন, আমরা আসতে আসতে চলে আসবেন। অনুকূল বাবু বললেন মেট্রোপলিটান হোটেলটা গ্রেটার কৈলাশে, এখান থেকে মিনিট পনেরোর পথ। উনিও আমাদের সঙ্গে আসছেন। তাই তো, অনুকূল বাবু?’
ভদ্রলোক সাগ্রহে ঘাড় নাড়লেন, ‘সে কথা আর বলতে মশাই। এতবড় একটা ঘটনা ঘটে গেছে অথচ ওরা কেউ কিছু জানাল না, ভেবে খুব অবাক হচ্ছি। আমিও একবার দেখা করে আসি।’
বাইরে বেরিয়ে টের পেলাম বেশ ভালোই ঠান্ডা পড়েছে। লালমোহনবাবু দেখলাম ওনার ঝোলা থেকে একটা মাঙ্কি ক্যাপ বার করে সেটা চাপিয়ে নিলেন। অনুকূল বাবু চিত্তরঞ্জন পার্কের ভেতরের রাস্তা দিয়ে নিয়ে চললেন আমাদের।
গলিঘুঁজির মধ্যে দিয়ে হাঁটতে খারাপ লাগছিল না। মাঝে মাঝে দেখলাম এক একটা বাড়ি থেকে ‘সা রে গা মা’-র আওয়াজও ভেসে আসছে, বাঙালি পাড়া বলেই বোধহয় সন্ধের রেওয়াজের চলটা এ চত্বরেও আছে। মাঝ রাস্তায় একটা চপের দোকান দেখে লালমোহনবাবু প্রায় দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন, ফেলুদা ঘড়ি দেখে রায় দিল ফেরার পথে দাঁড়ালেই বেটার হয়।
সত্যিই দেখি মিনিট পনেরো হাঁটার পর আমরা গ্রেটার কৈলাশে পৌঁছে গেছি। আর সব থেকে ভালো ব্যাপার, বড় রাস্তার ওপর থেকেই হোটেল মেট্রোপলিটানের নিওন বোর্ডটা দেখা যাচ্ছে।
হোটেলের রিসেপশন থেকে ফের ফোন করা হল জয়সওয়ালের রুমে। রিসেপশনিস্ট বেশ কিছুক্ষণ রিসিভার কানে ঠেকিয়ে রেখে ঘাড় নাড়ল, এখনো ফোন বেজে যাচ্ছে।
মিনিট পনেরো কুড়ি হোটেলের লবিতে অপেক্ষা করার পর লালমোহনবাবু বললেন, ‘এই ঠান্ডায় মশাই আর দাঁড়িয়ে থেকে লাভ কী? ভদ্রলোক যে এক্ষুনি ফিরবেন এরকমও তো জানা নেই। কালকে সকালে এসে দেখলে হয় না?’
অনুকূল বাবুও একটু অবাক, ‘এই শীতের রাত্রে গেলেন কোথায় ভদ্রলোক?’
ফেলুদার কপালে একাধিক ভাঁজ, কি ভাবছে কে জানে।
আরও মিনিট দশেক পর লালমোহনবাবু আর ধৈর্য ধরতে না পেরে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী ভাবছেন ফেলুবাবু?’
ফেলুদা দেখি উত্তর না দিয়ে হনহন করে ফের রিসেপশনের দিকে যাচ্ছে। গিয়ে হিন্দিতে যা বলল তার মর্মার্থ জয়সওয়াল যে অজ্ঞান হয়ে ঘরেই পড়ে নেই এরকম কোনো গ্যারান্টি কি হোটেল ম্যানেজার দিতে পারবে? হোটেলের জানা উচিত ভদ্রলোকের কী সাঙ্ঘাতিক হার্টের প্রবলেম।
ফেলুদার গলায় এমন কিছু একটা ছিল যে রিসেপশনিস্ট বিনা বাক্যব্যয়ে হোটেলের মাস্টার-কী টি নিয়ে তিনতলার জয়সওয়ালের ঘরের দিকে রওনা দিল। ফেলুদা চাপা গলায় বলল, ‘মিথ্যাচারণ করতে হল বটে, কিন্তু একটা দুশ্চিন্তা মনটাকে ছেয়ে ফেলছে। একবার ঘরে গিয়ে না দেখা অবধি শান্তি পাচ্ছি না’।
৩০৫ নম্বর ঘরের কাছে গিয়ে দেখা গেল দরজা বন্ধ। রিসেপশনিস্ট ভদ্রলোক বেশ কয়েকবার নক করার পরেও সাড়া না পেয়ে মাস্টার-কী দিয়ে ঘরের দরজা খুলে ফেললেন।
ভেতরটা নিকষ অন্ধকার, জানলার পর্দাগুলোও সব টানা।
লালমোহনবাবু রিসেপশনিস্ট ভদ্রলোককেও ছাড়িয়ে এগিয়ে গেছিলেন, হঠাৎ ‘উরে বাবা…গেলুম’ বলে একটা বিকট চিৎকার করে উঠলেন।
‘নির্ঘাত হোঁচট খেয়েছেন। তোপসে, এদিকে আয়। মিস্টার মালহোত্রা, আপ জারা দেখিয়ে না ইয়ে সুইচবোর্ড কিস দিওয়ার পে হ্যায়।’
আলো জ্বলে উঠতে দেখা গেল লালমোহনবাবু প্রায় মুখ থুবড়ে পড়ে আছেন। আমরা বাকি চারজনই অবশ্য দাঁড়িয়ে পড়েছি।
লালমোহনবাবুকে দেখে নয়।
লালমোহনবাবুর পাশেই আর এক জোড়া পা দেখা যাচ্ছে। ওই পায়ে ধাক্কা লেগেই ভদ্রলোক পড়ে গেছেন।
এবং স্পষ্টতই সে পা জোড়ার মালিকের শরীরে কোনো প্রাণ নেই।
‘ফেলুদা!’
‘এগোস না আর। লালমোনবাবু, আপনিও উঠে আসুন।’
‘লাশ! কি সর্বনাশ’, লালমোহনবাবু যদিও উঠে দাঁড়িয়েছেন কিন্তু মুখের চেহারা দেখে মনে হল আবার টলে পড়ে যাবেন।
লাশই বটে, বুকের বাঁদিক থেকে উঠে থাকা ছোরার হাতলটি দেখে আরোই সন্দেহ থাকার কথা নয়।
আমারও হার্টবীট মারাত্মক রকম বেড়ে গেছে। ফেলুদাকে জিজ্ঞাসা করলাম ‘জয়সওয়াল কতক্ষণ খুন হয়েছেন বলে মনে হয়?’
‘পোস্ট মরটেম রিপোর্ট না আসা অবধি সেটা বোঝা যাবে না।’
‘কিন্তু খুন তো উনি হন নি,’ বলে উঠলেন অনুকূল ভদ্র।
দেখি ভদ্রলোক ভয়ঙ্কর ফ্যাকাশে মুখে মৃতদেহর দিকে তাকিয়ে আছেন। আমাদের হতবাক মুখগুলোর দিকে নজর পড়তেই বোধহয় সম্বিৎ ফিরল ওনার, ‘জয়সওয়াল নয়, এ লাশ মাধবরাও যোশীর’।
এক সেকন্ডের জন্য মনে হল আমার হার্টবীট বন্ধই হয়ে গেছে।
৫
কাল রাতে হোটেল ফিরতে বেশ দেরী হল। পুলিশকে খবর দেওয়ার ব্যাপার তো ছিলই, পুলিশ আসার পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদেও বেশ কিছুটা সময় যায়। ভাগ্যক্রমে গ্রেটার কৈলাশ থানার ইন্সপেকটরটিও বাঙালি, রবীন তরফদার। মাস ছয়েক আগে পাশের চিত্তরঞ্জন পার্ক থানা থেকে বদলি হয়ে এসেছেন। এবং সবথেকে বড় কথা তিনি ফেলুদার নাম জানেন। জিজ্ঞাসাবাদের শেষে হ্যান্ডশেক করে বলে গেলেন ফেলুদার দিল্লী থাকাকালীন কোনো অসুবিধা হলে সবার আগে ওনাকে জানাতে।
সমস্যা হল দিল্লীতে আর ক’দিন থাকা হবে, আদৌ থাকা হবে কিনা সেটা নিয়েই ফেলুদা নিশ্চিত নয়। জয়সওয়াল উধাও হওয়ার ফলে আগের সব প্ল্যানই ভেস্তে গেছে। দুপুরবেলা যিনি রিসেপশনে ছিলেন তিনি কনফার্ম করেছেন দুপুর একটা নাগাদ জয়সওয়ালকে হোটেল থেকে বেরোতে দেখা গেছিল।
সকাল সাড়ে এগারোটা নাগাদ নাগাদ ফেলুদার নামে ফোন এল হোটেলে। ফেলুদা ঘুরে এসে ধপ্ করে বিছানায় বসে পড়ল।
‘কি হল মশাই? কার ফোন?’, উদ্বিগ্ন গলায় জিজ্ঞাসা করলেন জটায়ু।
‘ইন্সপেকটর রবীন তরফদারের, জানালেন খুনটা হয়েছে দুপুর বারোটা থেকে সাড়ে বারোটার মধ্যে।’
‘সর্বনাশের মাথায় বাড়ি। আপনি তো প্রায় ওই সময়েই জয়সওয়ালকে ফোন করেছিলেন, তাই না?’
‘সে তো বটেই। কিন্তু জয়সওয়াল আমার ফোনটা ধরতেই বা গেল কেন সেটা তো বুঝতে পারছি না? যে লোকটা সদ্য একটা খুন করেছে তার তো ফোন ধরার কোনো কারণই নেই।’
‘আর জয়পুরের টিয়া?’
‘সেটাও আরেকটা প্রশ্ন। জয়সওয়ালের নিজেরই যখন টিয়াটা ছিল সেটার জন্য নিশ্চয় যোশীকে খুন ও করবে না। তাহলে ধরে নেওয়া যায় যে টিয়াটা সত্যিই চুরি হয়েছে। এবং করেছে অন্য কেউ, যে কলকাতা থেকে ওদের ফলো করেছে। এবং একই ট্রেনে দিল্লী অবধি এসেছে।’
লালমোহনবাবু হেঁচকি তো্লার মতন একটা আওয়াজ করে বললেন ‘এ যে রহস্যের খাসমহল মশাই। আমার মাথা এখনই ভোঁ ভোঁ করছে।’
লাঞ্চের পর ফেলুদা বলল কনট প্লেসের কেমব্রিজ বুক স্টোরে ওর কি দরকার আছে, সেটা সেরে রবীনবাবুর সঙ্গেও একবার দেখা করতে যাবে। ফিরতে ফিরতে বিকেল। যাওয়ার আগে বলে গেল, ‘তুই চাইলে জটায়ুকে নিয়ে আরেকবার চিত্তরঞ্জন পার্কের পুজোয় ঘুরে আসতে পারিস।’
জটায়ু কালকের ভয়াবহ ঘটনাটা দেখার পর থেকে কিরকম চুপসে আছেন। ফেলুদার কথা শুনে মনে হল চিত্তরঞ্জন পার্কে ওনাকে নিয়ে গেলে মন্দ হয় না, হয়ত একটু চাঙ্গা হয়ে উঠবেন। লালমোহনবাবু যদিও বললেন তার আগে একবার সফদরজং এনক্লেভের কালীবাড়িতে ঘুরে আসতে চান। ‘এত দূর এসে কালীবাড়ির দুর্গাপুজোটা না দেখলে বড় আফশোস থেকে যাবে ভাই। সময় তো অফুরন্ত, একবার ঘুরেই আসা যাক, কী বলো?’
আমারও আপত্তির কোনো কারণ নেই। আর হোটেলের ম্যানেজার জানালেন হোটেলের সামনে থেকেই ৫০৫ নম্বর বাস সোজা যায় সফদরজং এনক্লেভ, সেখান থেকে অল্প একটু হাঁটা।
ষষ্ঠীর দিন হলেও দুপুর বলেই বোধহয় খুব একটা বেশী ভিড় নেই কালীবাড়িতে। লালমোহনবাবু কালীমূর্তি দেখে মহা আহ্লাদিত, দেখলাম প্রায় সাষ্টাঙ্গে একটা প্রণাম করলেন। প্রণাম করে ওঠার সময় যদিও দেখা গেল ব্যাপারটা অল্প বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে; ‘আহহ্’ বলে এমন কাতরে উঠলেন তাতে বেশ বোঝা গেল বেকায়দায় উঠতে গিয়ে কোমরে লেগেছে।
ভদ্রলোককে ধরে ধরে বাইরে নিয়ে আসছি, হঠাৎ শুনি ‘কী ব্যাপার মিস্টার গাঙ্গুলি?আপনি ঠিক আছেন?’
মুখ তুলে দেখি সামনে দাঁড়িয়ে সত্যেন্দ্র সোলাঙ্কি।
লালমোহনবাবু বোধহয় ভাবতেই পারেননি সোলাঙ্কির সঙ্গে আবার দেখা হয়ে যাবে, একটু থতমত মুখে বললেন, ‘এই কোমরটায় একটু……হেঁ হেঁ……ওই আর কী।’
‘আমার গাড়ি দাঁড় করানো আছে। আপনাদের অসুবিধা না থাকলে আমি কিন্তু আপনাদের হোটেল অবধি ছেড়ে দিতে পারি। আমার ভেতরে জাস্ট পাঁচ মিনিটের কাজ আছে।’
লালমোহনবাবুর কোমরের যা অবস্থা দেখছি তাতে চিত্তরঞ্জন পার্ক যাওয়াটা ঠিক হবে বলে মনে হল না। ভালোই হয়েছে সোলাঙ্কির সঙ্গে দেখা হয়ে গিয়ে। সোলাঙ্কি মন্দিরের ভেতরে যাওয়ার পর জটায়ু বললেন, ‘লোকটিকে বড় পছন্দ হয়েছে তপেশ। এরকম হেল্পফুল সোল আজকালকার দিনে আর ক’টা পাওয়া যায় বলো?’
পাঁচ মিনিটও অবশ্য লাগল না, সোলাঙ্কি দু’মিনিটের মধ্যেই ফিরে এলেন। মুখটা অসম্ভব গম্ভীর।
গাড়িতে উঠে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর সোলাঙ্কি বললেন, ‘আমি ভাবতেই পারিনি আপনাদের সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে। আমার প্ল্যান ছিল আজকে সন্ধ্যার দিকে চিত্তরঞ্জন পার্কের পুজোয় যাওয়ার।’
‘আপনিও সাহিত্যমেলা নিয়ে ইন্টারেস্টেড বুঝি?’, শুধোলেন জটায়ু।
‘মেলা নয় মিস্টার গাঙ্গুলি, আমার দরকার মিস্টার মিটার কে। ওনার প্রফেশনাল হেল্প চাই আমার।’
জটায়ু আড়চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কী ব্যাপার বলুন তো?’
‘আজ দু’দিন হল আমার বিজনেস পার্টনারকে পাওয়া যাচ্ছে না’, একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন সত্যেন্দ্র সোলাঙ্কি।
‘মি…মিসিং?’ জটায়ুর প্রায় বাক্যস্ফূর্তি হচ্ছিল না।
‘হ্যাঁ। প্রথমে ওর হোটেলে টেলিফোন করেছিলাম, পেলাম না। কাল রাত্রে গিয়ে শুনলাম হোটেলে ফেরেনি। আজকে সকাল থেকে বসে ছিলাম হোটেলে, দেখা নেই। শেষে হোটেলের ম্যানেজার সাজেশন দিল কালীবাড়িতে এসে একবার খুঁজতে, ও দিল্লী এলেই নাকি একবার কালীবাড়ি ঘুরে যাবেই।’
‘কালীবাড়িতেও পেলেন না?’
‘নাহ, এখানেও আসে নি। থ্যাঙ্কফুলি ওর একটা পাসপোর্ট ফটো আমার কাছে ছিল, সেটাই দেখালাম। কেউই আইডেন্টিফাই করতে পারল না।’
‘আঁ…আঁ…আঁ’।
আমি জানি জটায়ুর গলা থেকে কেন আর্তনাদ ছিটকে বেরোচ্ছে। ফটোর মধ্যে থেকে যে ভদ্রলোক আমাদের দিকে তাকিয়ে আছেন তাঁকে কালীবাড়ির কেউ না চিনলেও আমরা বিলক্ষণ চিনি।
হোটেল মেট্রোপলিটানের ঘরের মেঝেতে কাল এনারই নিঃস্পন্দ শরীর আমরা খুঁজে পেয়েছিলাম, ইনিই মাধবরাও যোশী।
৬
সোলাঙ্কি আমাদের হোটেলে নামিয়ে দিয়ে চলে গেলেন গ্রেটার কৈলাশ থানায়, যাওয়ার আগে বলে গেলেন পরের দিন দুপুরে আসবেন ফেলুদার সঙ্গে দেখা করার জন্য। ভদ্রলোক শকড বললেও কিছুই বলা হয় না, আমাদের কাছ থেকে খারাপ খবরটা পাওয়ার পর বাকি রাস্তা আর কথাই বলতে পারলেন না। বিড়বিড় করে দু’তিনবার খালি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আর ইউ অ্যাবসোলিউটলি সার্টেন? ঠিক দেখেছেন আপনারা?’
ঘরে ঢুকে দেখি ফেলুদাও ফিরে এসেছে। বিছানার ওপর একটা মস্ত বই ফেলে মন দিয়ে কি যেন দেখছে।
‘মশাই, এদিকে কী সর্বনেশে কান্ড ঘটেছে আপনি ভাবতেই পারবেন না’, ফেলুদাকে দেখেই চেঁচিয়ে উঠলেন লালমোহনবাবু। ‘একের পর এক থ্রিলিং ব্যাপারস্যপার ঘটে চলেছে’ বলতে বলতে ভদ্রলোক প্রায় লাফিয়ে উঠেছিলেন, তারপর ‘উফ্’ বলে কোমর ধরে বিছানাতেই বসে পড়লেন।
লালমোহনবাবুকে একটু ধাতস্থ হতে দিয়ে ফেলুদা মন দিয়ে আমাদের কাছে শুনল পুরো ঘটনাটা। তারপর একটা সিগারেট ধরিয়ে বলল, ‘থ্রিলিং নিঃসন্দেহে, তবে এবারে হয়ত আরেকটু আলো দেখা যাবে। সোলাঙ্কি কেন যোশীকে মীট করতে দিল্লী এসেছেন সেটাও একটা প্রশ্ন বটে।’
লালমোহনবাবু হাত তুলে বললেন, ‘ওই যে বললাম, ওনারা দু’জনে বিজনেস পার্টনার ছিলেন।’
ফেলুদা টেবলে রাখা অ্যাশট্রেটা তুলে নিয়ে সিগারেটের ছাই ঝাড়তে ঝাড়তে বলল, ‘বিজনেসটা কী নিয়ে সেটাই ভাবাচ্ছে লালমোহনবাবু। যোশী নয় এসেছিলেন জয়সওয়ালের থেকে টিয়াটা কিনতে, সোলাঙ্কির আসার কারণটা কি?’
আমি এর মধ্যে বিছানায় রাখা বইটার নামটা দেখে নিয়েছি, ‘প্রিন্সলি রাজস্থান : আর্ট অ্যান্ড স্কালপ্চর’।
‘তুমি এই বইটা কিনতেই কনট প্লেস গেছিলে?’
‘ঠিক ধরেছিস। সেদিনকে সিধুজ্যাঠার পড়ার টেবলে এই বইটাই দেখেছিলাম, কাল থেকে কেন জানি মনে হচ্ছিল এই বইটা একবার দেখা দরকার। গাট ফীলিং টা আদৌ অমূলক ছিল না, ২৩৫ নম্বর পাতায় গিয়ে দ্যাখ।’
ঠিক কথা। ২৩৫ থেকে শুরু করে ২৪৫, এই দশ পাতা জুড়ে লেখকের আলোচনার বিষয়বস্তু একটাই। জয়পুরের মহারাজার দ্য রুবি আইড প্যারট। লেখক গর্ডন উইলসন, লন্ডনের ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড অ্যালবার্ট মিউজিয়মের কিউরেটর – জয়পুরের টিয়াপাখি নিয়ে কেন এতটা উৎসাহ সেটা এবার বেশ বোঝা যাচ্ছে।
ফেলুদা সিগারেটটা শেষ করেই ফের বইটা পড়তে শুরু করল। আমি আর লালমোহনবাবু ফল-ফুল-পাখি-নাম-দেশ খেলতে শুরু করলাম। চার রাউন্ড খেলার পর পাঁচ নম্বর রাউন্ডে অক্ষর পড়ল ট। লালমোহনবাবু ট দিয়ে পাখির নাম কি লিখবেন সেটা মোটামুটি জানাই ছিল, আমাকে তাই অন্য নাম ভাবতে হল।
‘ট দিয়ে আমার পাখি টুনটুনি। লালমোহনবাবু, আপনার কি টিয়া?’
লালমোহনবাবু ভারিক্কী চালে বললেন, ‘অত বোকা আমাকে পাওনি তপেশ। আমি অবশ্য ভাবছিলাম তুমিই টিয়া লিখবে।’
এই রে, আমিও দেখছি বেকুব বনেছি। ‘তাহলে আপনার পাখির কি নাম?’
‘টেরোড্যাকটিল।’
টেরোড্যাকটিল শুনে বেজায় হাসি পাচ্ছিল, কিন্তু ভদ্রলোক কিছুতেই মানবেন না যে টেরোড্যাকটিল পাখি নয়। শেষে ঠিক হল ফেলুদাকেই জিজ্ঞাসা করা হবে।
ফেলুদাকে ডাকতে গিয়ে দেখি ও কপালের রগ ধরে বসে আছে, শিরাগুলো দপদপ করছে। এখন ওর হাতে বইটা নেই, বরং আছে জয়পুরের টিয়ার সেই ছবি যেটা ও সিধুজ্যাঠার থেকে নিয়ে এসেছে।
‘ফেলুদা, ফেলুদা’।
ফেলুদা কিরকম একটা ঘোরের মধ্যে থেকে বলল, ‘সমস্ত হিসেব গন্ডগোল হয়ে যাচ্ছে। সিধুজ্যাঠাকে এক্ষুনি একটা ট্রাঙ্ককল করা দরকার। লালমোহনবাবু, আপনি ঘরেই থাকুন। তোপসে, তুই চট করে হাওয়াই চপ্পলটা গলিয়ে আমার সঙ্গে নীচে চল, আর সঙ্গে একটা কাগজ – পেন্সিল রাখিস।’
ফেলুদা প্রায় ঊর্ধ্বশ্বাসে দু’টো করে সিঁড়ি একসঙ্গে টপকাতে টপকাতে নীচে নামল। ট্রাঙ্ককল পেতে বিশেষ অসুবিধা হল না। ফোনে অবশ্য এক দিকের কথাই শুনতে পাওয়া গেল, আর সেটাই সুবিধের জন্য এখানে তুলে দিলাম –
‘সিধুজ্যাঠা, ফেলু বলছি দিল্লী থেকে। আপনার সঙ্গে একটা জরুরী দরকার আছে।’
———
‘বলছি, প্রিন্সলি রাজস্থান বইটার ২৪৩ নম্বর পাতার সেকন্ড প্যারাটা একটু পড়ুন। আমি ফোন হোল্ড করছি।’
———
‘সে কী? আপনি অলরেডি জানেন!
———
‘কিন্তু আপনার লেখাটা যখন বেরোয় তখন এই খবরটা জানা ছিল না?’
———
‘তাই নাকি? আপনি অলরেডি ফোন করে জানিয়েছিলেন? সেদিন সকালেই?’
———
‘ওহ, জয়সওয়াল কি বলল?’
———
‘আচ্ছা, জয়সওয়ালকে কেমন দেখতে বলুন তো?’
———
‘না, এখনো দেখা হয়নি। আমি পরে বিশদে জানাচ্ছি আপনাকে।’
———
‘হ্যাঁ, এক সেকন্ড ধরুন…’, বলে মাউথপিসে হাত চাপা দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল ‘সিধুজ্যাঠা জয়সওয়ালের ডেসক্রিপশন দিচ্ছেন। আমি রিপিট করব কথাগুলো, তুই লিখে রাখবি। ঠিক হ্যায়?’
আমি ঘাড় নাড়তে ফের ফোন ধরে বলল, ‘হ্যাঁ, বলুন সিধুজ্যাঠা।’
‘লম্বায় পাঁচ-নয়? আচ্ছা। পেন্সিল গোঁফ? ইন্টারেস্টিং!’
———
‘চোখের রঙ কটা বললেন? ওকে। চোখে চশমা ছিল?’
———
‘ছিল না? ওহ, সানগ্লাসটা পকেটে রাখা ছিল বলছেন?’
———
আচ্ছা, অনেক ধন্যবাদ সিধুজ্যাঠা। আমি কাল পরশুর মধ্যেই আবার ফোন করব আপনাকে।’
‘কী ব্যাপার মশাই? হঠাৎ এরকম তড়িঘড়ি ফোন করতে ছুটলেন যে?’, আমাদের ঘরে ঢুকতে দেখে জটায়ু উঠে বসেছেন।
ফেলুদা পাতাটা খুলে লালমোহনবাবুকে বলল, ‘সেকন্ড প্যারাগ্রাফটা পড়ে ফেলুন চট করে।’
মিনিট পাঁচেক পর লালমহনবাবু মুখ তুলে বললেন, ‘তাই নাকি মশাই?এ খবরটা তাহলে আগে আপনার কাছে ছিল না?’
‘নাহ, বইটা পড়েই তো জানলাম। এবার আপনি ছবিটা নিয়ে মেলান।’
ফেলুদা এবার আমার দিকে ঘুরে বলল, ‘উইলসন সাহেব জানাচ্ছেন ১৯০৮ সালে টিয়াটি চুরির চেষ্টা হয়, নিরাপত্তারক্ষীরা টের পেয়ে চোরকে গুলি করে এবং চোরের রক্ত ছিটকে রুবি আইড প্যারটের ডানার একটি হীরেতে লাগে। অমঙ্গলের আশঙ্কায় জয়পুর স্টেটের তৎকালীন মহারাজা সেই হীরেটিকে রিপ্লেস করেন হীরের মতন দেখতে কিন্তু হীরের থেকেও দামী এক টুকরো ময়সেনাইট ক্রিস্টাল দিয়ে। ময়সেনাইট এখন গবেষণাগারে তৈরি হলেও সে সময় প্রাকৃতিক ময়সেনাইট একবারই পাওয়া গেছিল, তাও একটা উল্কার মধ্যে। বুঝতেই পারছিস কতটা রেয়ার এই ক্রিস্টাল।’
ফেলুদা একটু থেমে বলল, ‘হীরে আর ময়সেনাইটের তফাৎ চট করে খালি চোখে ধরা পড়া মুশকিল। কিন্তু আলোর মধ্যে ধরে দেখলে দেখা যাবে ময়সেনাইটের একটা হাল্কা সবজে আভা আছে।’
‘লালমোহনবাবু, কিছু দেখতে পেলেন?’
‘পেলাম বই কি, ওপর থেকে চার নম্বর পাথরটায় সত্যি একটা সবজে আভা দেখা যাচ্ছে। ওইটেই তাহলে ময়সেনাইট?’
‘ঠিক। কিন্তু আসল খবর তো সেটা নয় লালমোহনবাবু। আসল খবরটা কী বলুন?’
লালমোহনবাবু চুপ কিন্তু আমি চেঁচিয়ে উঠলাম, ‘তার মানে…তার মানে…তিন নম্বর টিয়া?’
‘এক্সেলেন্ট, তোপসে। মানে দাঁড়াচ্ছে, যে টিয়ার ছবি আমরা দেখছি সেটা এসেছে জয়পুর প্যালেস থেকেই। অর্থাৎ তিন নম্বর টিয়া নেই, বানানোই হয় নি।’
লালমোহনবাবু অবাক হয়ে বললেন, ‘কিমাশ্চর্যম! তাহলে জয়সওয়াল?’
‘একটি চীট এবং একটি চোর। মাধবরাও যোশীকে চোরাই মাল বেচার চেষ্টা করছিল জয়সওয়াল। আমাদের এখন অবিলম্বে পুলিশকে খবর দিতে হবে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ভেরিফাই করা দরকার জয়পুর প্যালেসে অরিজিনাল টিয়া বলে যেটি এখন শোভা পাচ্ছে সেটি নকল কিনা।’
লালমোহনবাবু এত ইনফরমেশনের ধাক্কাতে একটু কাবু হয়ে পড়েছিলেন, হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে বললেন, ‘কিন্তু তিন নম্বর টিয়া না থাকুক, এক নম্বরটাও এখনো মিসিং। সেটা কার কাছে গেল?’
‘সেটাই তো লাখ টাকার প্রশ্ন । ওখানেই একটা বড় খটকা রয়ে যাচ্ছে। জয়সওয়াল তো নিজেই টিয়াটা যোশীকে বেচার চেষ্টা করছিল। সে একটা চিটিংবাজ হলেও নিজের জিনিস তো আর নিজে চুরি করবে না? এনিওয়ে, আমি ফোন করতে গেলাম। রবীনবাবুকে খবরটা দিতে হবে।’
৭
পরের দিন দুপুর একটা নাগাদ সোলাঙ্কি দেখা করতে এলেন। ভদ্রলোককে বিধ্বস্ত লাগছিল, যোশীর খুনের খবরটা এখনো সামলে উঠতে পারেন নি। ফেলুদার সঙ্গে হাত মিলিয়ে বললেন, ‘ভাবতেই পারছি না মিস্টার মিটার এরকম কিছু ঘটে যেতে পারে। কে খুন করল, কেন খুন করল কিছুই তো বুঝতে পারছি না।’
ফেলুদা সহানুভূতির স্বরে বলল, ‘আমাদের সবার মনেই সেই এক প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে মিস্টার সোলাঙ্কি। কিন্তু আপনি ঠিক কি কারণে দিল্লী এসেছিলেন?’
সোলাঙ্কি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, ‘যোশীর থেকে একটা পেমেন্ট পাওয়ার কথা ছিল আমার। বেশ কয়েক হাজার টাকা।’
ফেলুদা একদৃষ্টে সোলাঙ্কির দিকে তাকিয়ে, ‘কয়েক হাজার টাকা?’
‘হ্যাঁ, তাই। যোশী আমার অনেকদিনের ক্লায়েন্ট, দু’তিন বছর আগে অবধিও রীতিমতন ভালো বিজনেস পেতাম ওনার থেকে। তারপর থেকে বোধহয় ওর ফাইন্যান্সিয়াল কন্ডিশন খুব একটা ভালো যাচ্ছিল না। মাস ছয়েক আগে এসে আমাকে একটা আইটেম ডেলিভার করতে বললেন। এও বললেন যে আইটেমটা বানিয়ে দিলে উনি ফিফটি পারসেন্ট টাকা দিয়ে দেবেন। বাকি ফিফটি পারসেন্ট পাওয়া যাবে তার মাস দুয়েক পরে। টাকার অ্যামাউন্টটাও খারাপ ছিল না, প্লাস পুরনো ক্লায়েন্ট, আমিও রাজি হয়ে গেলাম। সেই ফিফটি পারসেন্ট নেওয়ার জন্যই দিল্লী আসা।’
ফেলুদার কি শরীর খারাপ লাগছে? মাথা নিচু করে বসে আছে কেন?
‘কি বোকাই না বনলাম রে তোপসে’, ফেলুদা আবার সোজা হয়ে বসেছে। টেবলের ওপর রাখা টিয়ার ছবিটা এক ঝটকায় টেনে নিয়ে সোলাঙ্কির দিকে ছুঁড়ে দিল।
‘মিস্টার সোলাঙ্কি, ভালো করে দেখুন তো। যোশী আপনাকে এই ধরণের কিছু বানাতে দিয়েছিলেন কিনা?’
সোলাঙ্কি ছবিটা দেখে উত্তেজনার চোটে দাঁড়িয়ে পড়লেন। ‘এই তো, এই তোতা পাখিটাই তো বানিয়ে দিলাম যোশীকে। অফ কোর্স, এত দামী কাজ ছিল না। কিন্তু আপনি কি করে জানলেন?’
ফেলুদা সে কথার জবাব না দিয়ে তাকিয়ে রইল সোলাঙ্কির দিকে। ‘আপনি কি জানতেন আপনার ক্লায়েন্টটি ঠিক সাধুপুরুষ নন?’
সোলাঙ্কি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, ‘সে কথা আমারো মাঝে মাঝেই মনে হয়েছে। কিন্তু আমার এখানে কি যায় আসে মিস্টার মিটার? উনি টাকা দিচ্ছেন, আমি আমার কাজ করে দিচ্ছি। এর বাইরে গিয়ে আমি কেন ভাবব বলুন তো?’
‘ভাবা উচিত ছিল মিস্টার সোলাঙ্কি। আর কিছু না হোক, টাকার লোভটা না করে যোশীর হয়ে কাজ না করাই উচিত ছিল। এখন যে আপনাকে বহু জবাবদিহি দিতে হবে। আমার ধারণা মাধবরাও যোশী আপনাকে দিয়ে জয়পুর প্যালেসের একটি মহামূল্যবান শিল্পকর্মের নকল বানিয়ে আসল জিনিসটিকে কোনো ভাবে সরিয়েছেন।’
সোলাঙ্কির মুখটা ছাইয়ের মতন সাদা হয়ে গেছে। ‘কি বলছেন প্রদোষ বাবু, আমি এর বিন্দু বিসর্গ জানতাম না।’
ফেলুদা ছবিটা ফেরত নিতে নিতে বলল, ‘আমি আপনাকে বিশ্বাস করার চেষ্টা করছি কিন্তু পুলিশ সে কথা মানলে হয়। যাই হোক, আপনি আপনার হোটেলের ঠিকানাটা দিয়ে যান, আর দিল্লী থেকে এখন বেরোবেন না। বুঝতেই পারছেন দিল্লী এবং জয়পুরের পুলিশের প্রচুর প্রশ্ন থাকবে আপনার কাছে, আমার সাজেশন হল যা জানেন সব স্পষ্টাস্পষ্টি বলে দিন।’
সোলাঙ্কিকে দেখে মনে হচ্ছে হার্ট অ্যাটাক হতে চলেছে। অতি কষ্টে মাথা নাড়ালেন ফেলুদার কথায় সায় দেওয়ার জন্য।
সোলাঙ্কি বেরোতে যাবেন এই সময়ে ফেলুদা একটা অদ্ভুত প্রশ্ন করল, ‘আমার বন্ধুটিকে বোধ হয় আপনি আগে থেকেই চিনতেন, তাই না?’ সোলাঙ্কি থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছেন, ‘আপনার বন্ধু?’
ফেলুদার আঙুল লালমোহনবাবুর দিকে, ‘এই ইনি। স্বয়ং লালমোহন গাঙ্গুলি।’
সোলাঙ্কি আমতা আমতা করে বললেন ‘মিস্টার মিটার, আপনাদের সবার সঙ্গেই তো প্রথম দেখা রাজধানী এক্সপ্রেসে। এর আগে সত্যিই আমাদের দেখা হয়নি কোথাও।’
‘চেনার জন্য কি সব সময় দেখা হওয়া জরুরী? আমার ধারণা আপনি শ্রী জটায়ুকে মুখে না চিনলেও নামে চেনেন। নাহলে জটায়ু যে থ্রিলার লেখেন সে কথা আপনি জানবেন কেমন করে? মনে পড়ছে ট্রেনে আলাপ হতে না হতেই কি বলেছিলেন? লাইফে কোনো থ্রিল নেই মশাই। যিনি জটায়ুকে চেনেনই না তিনি হঠাৎ থ্রিলের প্রসঙ্গ টানবেন এটা একটু বড় ধরণের কো-ইনসিডেন্স নয় কি? তা ছাড়া ট্রেন অ্যাটেন্ডান্টের সঙ্গে কথা বলে আমি জেনেছি আপনি শেষ মুহূর্তে আপনার অরিজিন্যাল কামরা বদল করে আমাদেরটাতে এসে ঢোকেন।’
সোলাঙ্কি চুপ করে দাঁড়িয়ে। ফেলুদা বলল, ‘আমার ধারণা আপনি এখনো সব কথা খুলে বলছেন না। মিথ্যাচারণ করে আপনার কোনো লাভ নেই মিস্টার সোলাঙ্কি, এখন একমাত্র সত্যি কথাই আপনাকে বাঁচাতে পারে।’
ভদ্রলোক এবার সম্পূর্ণ ভেঙ্গে পড়লেন, ‘মিস্টার মিটার, আমাকে বাঁচান। আমি চুরি করিনি।’
‘কিন্তু চুরির টাকার ভাগ পাবেন এরকমই কথা হয়েছিল, তাই নয় কি? যোশীর প্ল্যান আপনি জানতেন?’
‘জানতাম। গোটা আইডিয়াটাই ও পেয়েছিল একটা হিন্দি বই থেকে। অথরের ছবি সেই বইয়েই ছিল। সেদিন তাই হাওড়া স্টেশনে অথরকে দেখে আর কৌতূহল সামলাতে পারিনি।’
জটায়ু এতক্ষণ টেনিস ম্যাচ দেখার মতন এদিক থেকে ওদিক আর ওদিক থেকে এদিক ঘাড় ঘোরাচ্ছিলেন। এবার খাটের ওপর একটা বিশাল থাপ্পড় মেরে বললেন, ‘আরররে…কহানী ঝুটি হীরা কি।’
তারপর প্রচন্ড উত্তেজিত হয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আমার ‘হিড়িম্বা মন্দিরের হীরে’র হিন্দি অনুবাদ মশাই, এই ফেব্রুয়ারীতে বেরিয়েছে। ভিলেন হিড়িম্বা দেবীর মন্দিরে রাখা আসল হীরেটা গায়েব করে দেবে, বদলে রেখে আসবে একটা নকল হীরে। পুরো কাজটাই করবে রাত্রিবেলা স্কাইলাইটের ভেতর দিয়ে গলে, দড়িতে ঝুলতে ঝুলতে।’
সোলাঙ্কি বিদায় নিয়েছেন বেশ কিছুক্ষণ, ভদ্রলোকের চোখমুখের অবস্থা দেখে মায়াই হচ্ছিল। ফেলুদা লালমোহনবাবু কে বলল, ‘আপনার উপন্যাসগুলো বান্ডিল ধরে সব রজনী সেন রোডের বাড়িতে রেখে যাবেন তো। কলকাতায় ফিরেই প্রত্যেকটা বই ধরে ধরে পড়তে হবে। আপনার গাঁজা যে হারে বাস্তব হয়ে উঠছে, ঐ গাঁজাতেই দম না দিলে ফেলু মিত্তিরে ভাত জুটবে না।’
‘মাই প্লেজার ফেলুবাবু’, জটায়ু এবার টেনশন মাখানো গলায় বলে উঠলেন ‘কিন্তু এদিকে কী হয়ে চলেছে বলুন তো?কিচ্ছুটি মাথায় ঢুকছে না।’
ফেলুদা চাপা গলায় বলে উঠল, ‘আমরা আসলে প্রথম থেকেই ভুল পথে চলছিলাম লালমোহনবাবু, সেটাই সমস্যা। সিধুজ্যাঠা বলুন বা আমি, সবাই প্রথম থেকেই জেনে আসছি যে এ টিয়া বেচছিল জয়সওয়াল আর কিনছিল যোশী। এখন তো বুঝতেই পারছেন যে ঘটনাটা উল্টো, কিনছিল আসলে জয়সওয়ালই আর বেচছিল যোশী। জয়পুর প্যালেস থেকে আসল টিয়াটি বাগানোর সময় মনে হয় প্যালেসের এক বা একাধিক কর্মচারীকে হাত করেছিলেন যোশী।’
‘কিন্তু খুনটা?’
ফেলুদা খাটের সঙ্গে লাগোয়া একটা চেয়ারে বসে পড়েছে, ওর নজর এখন সিলিং এর দিকে। ‘সিধুজ্যাঠা কাল ফোনে বললেন আমরা যেদিন দিল্লী রাজধানীতে উঠলাম উনি সেদিন রাত্রেই উইলসন সাহেবের বইটা পড়তে গিয়ে ময়সেনাইটের ব্যাপারটা লক্ষ্য করেন। পরের দিন সাতসকালেই উনি জয়সওয়ালকে ফোন করেন। জয়সওয়াল পুরো ব্যাপারটা অস্বীকার করে ফোন কেটে দেয়। উনি ভাবছিলেন আমাকে টেলিগ্রাম করবেন কিন্তু তখনই আমার ফোনটা যায়।’
আমি বললাম, ‘জয়সওয়ালও নিশ্চয় জানত যে টিয়াটা জয়পুর থেকে চুরি করা হয়েছে?’
‘সেটা হওয়াই সম্ভব, যোশীর মতন জয়সওয়াল-ও যখন একটি নিখাদ চিটিংবাজ। কিন্তু খুনটা কেন করতে যাবে সেটাই তো স্পষ্ট হচ্ছে না?’
লালমোহনবাবু বললেন, ‘এরকম একটা খুনী লোক দিল্লীর রাস্তায় ওপেন ঘুরে বেড়াচ্ছে এটা ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিচ্ছে কিন্তু।’
‘সে কি আর নিজের চেহারায় ঘুরে বেড়াচ্ছে লালমোহনবাবু? সম্ভবত কোনো ছদ্মবেশ নিয়েছে। ছদ্মবেশ…… মূর্খ, মূর্খ!’
শেষের কথাটায় লালমোহনবাবু একটু ঘাবড়ে গিয়ে বললেন, ‘আজ্ঞে?’
‘আপনাকে বলিনি লালমোহনবাবু, কথাটা নিজেকে বললাম। ফেলুদার চোখ জ্বলজ্বল করছে, ‘কি আশ্চর্য, এই কথাটা আগে মাথায় আসেনি।’
‘কোন কথাটা মশাই?’ লালমোহনবাবু আরোই হতভম্ব, আমিও।
‘পরে বলছি আপনাদের। তোপসে, চট্ করে আমার ওয়ালেটটা দে তো।কলকাতায় আরো একটা ট্রাঙ্ককল করা দরকার।’
‘কাকে ফোন করবে ফেলুদা?’
ফেলুদা ঝড়ের গতিতে বেরোতে বেরোতে বলল, ‘আমার বন্ধু দেবরাজকে, দেবরাজ গোস্বামী। রবীন্দ্রভারতীর ফাইন আর্টস ডিপার্টমেন্টের অধ্যাপক।’
৮
দেবরাজ গোস্বামীকে ফোন করার পর পরেই বোধহয় রবীন তরফদারকেও ফোন করেছিল ফেলুদা। আধ ঘন্টার মধ্যেই দেখি জীপে চড়ে রবীন বাবু আমাদের হোটেলে এসে হাজির, সঙ্গে আবার দু’জন কনস্টেবল। ফেলুদাকে দেখে বললেন, ‘পাখি উড়ে গেছে বলেই মনে হচ্ছে।’
‘কিন্তু উড়ে বেশি দূর যেতে পারবে না। তার জন্য ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সেরও একটা ধন্যবাদ প্রাপ্য।’
ফেলুদা একটা ট্যাক্সি ডাকতে যাচ্ছিল, তাতে রবীনবাবু বললেন জিপেই তিনজনের জায়গা হয়ে যাবে। লালমোহনবাবু বেশ কিছুক্ষণ ধরে উসখুস করছিলেন, জিপে উঠে বললেন, ‘কোথায় যাচ্ছি মশাই?’
‘সবুর, লালমোহনবাবু সবুর। একটু পরেই দেখতে পাবেন।’
লালমোহনবাবু অবশ্য পাঁচ মিনিটও চুপ করে থাকতে পারলেন না, ‘আপনার বন্ধুর সঙ্গে কথা হল?’
‘দেবরাজের কথা বলছেন? হ্যাঁ, কথা হয়েছে। দু’টো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইনফরমেশন দিয়েছে সে।’
জিপটা যখন যন্তর মন্তরকে বাঁ দিকে রেখে গোল চক্করে পড়ল তখনই একটা সন্দেহ হচ্ছিল। ফেলুদাকে বললাম ‘আজমেরি গেটের দিকে যাচ্ছি, তাই না?’
ফেলুদা আমার পিঠে একটা চাপড় দিতে যাচ্ছে আর ঠিক সেই সময় জিপটা বিশ্রী একটা ব্রেক কষল। ফলে চাপড়টা যতটা জোরে আসার কথা ছিল তার প্রায় দ্বিগুণ জোরে এসে পিঠে পড়ল।
‘কী হল রবীনবাবু?’
‘এই দেখুন না, সামনে অযথা ঝঞ্ঝাট।’
ঝঞ্ঝাট বলে ঝঞ্ঝাট! কোথা থেকে একটি ষাঁড় এসে রাস্তার ওপর বসে পড়েছে। ষাঁড়বাবাজীবনের যা চেহারা দেখা গেল, রবীনবাবু ওনার কনস্টেবলদের পাঠাতেও বিশেষ ভরসা পেলেন না। চারপাশ থেকে বাইক, বাস এবং গাড়ির অসংখ্য হর্নেও দেখা গেল তার ভ্রুক্ষেপ নেই।
মিনিট কুড়ি অপেক্ষা করার পর ফেলুদা বলল, ‘রবীনবাবু, হাত থেকে সময় বেরিয়ে যাচ্ছে। অন্য রাস্তা নেই?’
‘আছে, পঞ্চকুইয়া রোড ধরে গিয়ে পাহাড়গঞ্জ দিয়ে ঢোকা যেতে পারে। কিন্তু তাতে আরো আধ ঘন্টা মতন লাগবে ধরুন।’
‘সর্বনাশ’, ফেলুদা বার বার রিস্টওয়াচের দিকে দেখছে, ‘ড্রাইভার সাব, হামে পাঁচ বাজে তক পঁহচনা হ্যায়। জারা জলদি চলিয়ে।’
‘জি, জরুর।’ একে পুলিশের জিপ, তায় ফেলুদার অনুরোধ। আমাদের গাড়ি এত জোরে চলতে শুরু করল যে মিনিট খানেকের জন্য জটায়ুর মুখ থেকে সব রক্ত সরে গেল। ‘কী চালাচ্ছে ভাই তপেশ, পেটের মধ্যে মনে হচ্ছে হাজারখানা প্রজাপতি ওড়াউড়ি করছে।’
ফেলুদা একবার আমাদের দিকে তাকিয়ে চাপা গলায় বলল, ‘আরতুরো কারতোফোলি।’
‘কার কথা বলছেন মশাই? আড় কে?’
আমি জানি ফেলুদা কার কথা বলছে। টিনটিনের অ্যাডভেঞ্চার ‘দ্য ক্যালকুলাস অ্যাফেয়ার’ এর সেই ইটালিয়ান ড্রাইভার যার গাড়িতে করে টিনটিন প্রায় উড়ে উড়ে বরডুরিয়ান এজেন্টদের ধাওয়া করেছিল। কিন্তু জটায়ুকে অত কিছু বোঝানোর মতন সময় নেই এখন।
নিউ দিল্লী স্টেশনে যখন আমরা পৌঁছলাম, তখন পাঁচটা বাজতে মিনিট কুড়ি মতন বাজে।
রবীনবাবু জিপ থেকে নামতে নামতে বললেন, ‘রাজধানী আট নম্বর প্ল্যাটফর্ম থেকে ছাড়ছে।’
‘হ্যাঁ, আর কাকে খুঁজতে হবে আপনি জানেন নিশ্চয়। মনে রাখবেন স্বনামে সে থাকবে না। সুতরাং রিজার্ভেশন লিস্ট চেক করে লাভ নেই, অযথা সময় নষ্ট’ ফুটব্রিজে উঠতে উঠে জিজ্ঞাসা করল ফেলুদা।
‘কোনো চিন্তা করবেন না, তপেশের লেখা কাগজটাও তো আমাকে দিয়েই রেখেছেন।
সেই ডেসক্রিপশনওলা চিরকুট? তাহলে কী জয়সওয়ালের খোঁজ পাওয়া গেছে?
ফেলুদাকে অবশ্য সে কথা জিজ্ঞাসা করার উপায় নেই; ফেলুদা আট নম্বর প্ল্যাটফর্মে নেমে অদ্ভুত ক্ষিপ্রতায় ঠেলাগাড়ি, কুলি, কলার খোসা সব কাটিয়ে কাটিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়চ্ছে। প্ল্যাটফর্মে নামার আগে চিৎকার করে বলে গেল, ‘আমি সামনের কামরা থেকে উঠছি, রবীনবাবুরা শেষেরটা থেকে। চেয়ারকারগুলো মাঝে আছে, তুই ওখান থেকে দেখতে শুরু কর তোপসে। মনে রাখিস চোখের রঙ কটা।’
আমিও দৌড়চ্ছি, একজন কুলিকে জিজ্ঞাসা করাতে বলল সাত নম্বর কামরা থেকে চেয়ারকার শুরু। লালমোহনবাবু পেছন থেকে হাঁফাতে হাঁফাতে বললেন, ‘তোমরা এগিয়ে যাও তপেশ, আমি আসছি।’
একের পর এক কামরা পার হয়ে যাচ্ছি, না চোখে পড়ছে পেন্সিল গোঁফ, না কটা চোখ। তাও ভাগ্য ভালো রাজধানী বলে এক কামরা থেকে অন্য কামরায় খুব সহজেই যাওয়া যায়। দশ মিনিটের মাথায় উল্টো দিক থেকে ফেলুদাকে আসতে দেখা গেল।
ফেলুদা দু’দিকে তাকাতে তাকাতে আসছে।
আমাকে দেখতে পেয়েছে, হাত নাড়ল।
আমি চট করে ঘড়ির দিকে তাকালাম, আর পাঁচ মিনিট মতনই হাতে আছে। কোথায় বসে আছে জয়সওয়াল? রবীনবাবুই বা কোথায়?
ফেলুদা বোধহয় রবীনবাবুর কথাই জিজ্ঞাসা করতে যাচ্ছিল আমাকে। কিন্তু ওর দৃষ্টি এখন অন্য দিকে। যে দিক থেকে এসেছিল সেদিকেই আবার ঘুরে গেছে।
তিন নম্বর সিট থেকে এক ভদ্রলোক উঠে দরজার দিকে এগোচ্ছেন। হাতে অ্যাটাচি কেস।
আমরা দু’জনেই ভদ্রলোকের পেছনে, কিন্তু এক ঝলকে দেখতে পেলাম ভদ্রলোকের চোখে সানগ্লাস।
আমি এখন ফেলুদার পাশে, ফেলুদা একটা চাপা হিসহিসে স্বরে বলল, ‘বিকাল পাঁচটার সময় ট্রেনের ভেতর কে সানগ্লাস পরে?’
ভদ্রলোক কি ট্রেন থেকে নামার চেষ্টা করছেন? বাথরুমের দজার সামনে পৌঁছেছেন, ফেলুদা পেছন থেকে ডাকল, ‘এক্সকিউজ মী, মিস্টার জয়সওয়াল?’
ভদ্রলোক ঘুরে তাকিয়েছেন। এনার মুখের সঙ্গে জয়সওয়ালের মুখ মিলছে না, পেন্সিল গোঁফের বদলে এনার মুখে ফ্রেঞ্চ কাট দাড়ি। সানগ্লাস থাকার জন্য অবশ্য চোখের রঙটা বোঝা যাচ্ছে না। আমি জানি এনাকে কোনোদিন আমি দেখিনি কিন্তু তাও যেন মনে হচ্ছে চিনি।
ঘড়ঘড়ে গলায় ইংরেজিতে জবাব এল, ‘আপনি ভুল করছেন। আমার নাম মোহনলাল সোমানি।’
ফেলুদা স্বর ইস্পাতের মতন কঠিন, ‘আমি জানি আপনি জয়সওয়াল নন। কিন্তু আপনি যে সোমানিও নন।’
সানগ্লাসের পেছনে চোখটা কি একটু নড়ে উঠল?
‘আমি জানি না আপনি কি বলছেন, আমি জানতেও চাই না। কিন্তু আমাকে এবারে ট্রেন থেকে নামতে হবে। উড ইউ মাইন্ড?’
‘সার্টেনলি আই উড।’
ফেলুদা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে।
‘মেকআপটা ভালোই করেছিলেন, কিন্তু তাড়াহুড়োয় সিঁথিটা ডান দিক থেকে আর সরানো হয়নি।’
চোখের নিমেষে ভদ্রলোকের হাতে একটা পিস্তল উঠে এসেছে।
‘আমি দুঃখিত প্রদোষবাবু, আপনি চান কী না চান তাতে আমার কিছু যায় আসে না। এ ট্রেন থেকে নামতেই হবে আমাকে।’
‘কিন্তু খুন? খুনটা করলেন কেন?’
প্রায় একটা চাপা গর্জন বেরিয়ে এল ভদ্রলোকের মুখ থেকে, ‘এক ভুল কতবার সইতে পারে মানুষ? যে ভুলের জন্য আপনি অতীতে সব কিছু খুইয়েছেন? সব কিছু! টাকাপয়সা, মান ইজ্জত – সব। দ্যাট স্কাউন্ড্রেল, আমার কোনো আফশোস নেই ওর জন্য।’
রাজধানীর ইঞ্জিনের ভোঁ শোনা গেল, ট্রেন ছাড়ার সময় হয়েছে।
কিন্তু সেই আওয়াজ ছাপিয়ে ফেলুদার কথা শোনা যাচ্ছে, ‘সেটা যে পুরোপুরি সত্যি কথা নয়। মাধবরাও যোশীর দ্বিতীয়বার বিশ্বাসঘাতকতার খবর আপনি পেয়েছেন মাত্র দু’দিন হল। অথচ চুরির গল্প ফেঁদেছিলেন তার কত আগেই, তাই না? আপনি যে খুনের মতলব অনেক দিন ধরেই ভেঁজে রেখেছেন, না হলে আগ বাড়িয়ে কেন ফেলু মিত্তিরকে চুরির গল্প বলে ডেকে পাঠাবেন? কিন্তু ঘোলা জলে যে মাছ আপনি ধরেছেন সে যে নেহাতই রেড হেরিং তা বুঝতে আমার বাকি নেই।’
‘আপনি অনেক বড় বড় কথা বলেছেন মিস্টার মিটার। আপনাকে আর কথা বলতে আমি দেব না। সরুন সরুন, যান ওদিকে। যান বলছি। এক পা এগোলেও গুলি করতে আমার হাত কাঁপবে না।’
ফেলুদাকে ধমক দিতে গিয়ে ভদ্রলোকের সেই ঘড়ঘড়ে গলার স্বর উধাও হয়ে গেছে। আর এই নতুন গলার স্বর আমি চিনি।
ভদ্রলোক পিস্তল উঁচিয়ে এক পা এক পা করে পিছোচ্ছিলেন। ট্রেনের দরজাটা খুলবেন বলে হ্যান্ডলে হাত রেখেছেন আর ঠিক এই সময়ে বাইরের দিক থেকে দরজাটা দমাস করে খুলে গেল। দরজাটা এত জোরে এসে লাগল ভদ্রলোকের মাথায়, ভদ্রলোক ট্রেনের ভেতরে মুখ থুবড়ে পড়লেন। যদিও তার আগে ভদ্রলোকের আঙ্গুল পিস্তলের ঘোড়ায় চাপ দিয়ে গেছে। আমাদের ভাগ্য ভালো সে গুলি ট্রেনের সিলিং এ গিয়ে লেগেছে।
কামরার দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলেন শ্রী লালমোহন গাঙ্গুলি।
আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কোথায় ছিলেন আপনারা? কতক্ষণ ধরে প্ল্যাটফর্ম ধরে ছুটতে ছুটতে জানলার ভেতর দিয়ে দেখছি। কিছুতেই পাই না। এই কামরার প্রথম জানলাটাতে উঁকি মারতে গিয়ে মনে হল ফেলুবাবুর গলা শুনছি। তাই কপালে যা থাকে বলে উঠে পড়লাম।’
ফেলুদা আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এবারের ঘটনাটা যখন লিখবি পাঠকদের আগেভাগে জানিয়ে দিস ফেলু মিত্তিরের কোনো রোলই এবার নেই। সবই জটায়ুর দয়া।’
লালমোহনবাবু হেঁঃ হেঁঃ করে হাসতে গিয়ে বিষম খেলেন, ওনার এতক্ষণে নজর পড়েছে মেঝের দিকে। গুলির আওয়াজ শুনেই রবীনবাবুরাও এসে পড়েছেন।
‘ইনিই জয়সওয়াল?’
‘ওরফে মোহনলাল সোমানি। তবে আপনারা এনাকে অন্য আরেকটি নামে চেনেন, অনুকূল ভদ্র। রবীনবাবু, সানগ্লাসটা খুলে নিলে দেখবেন কটা রঙের একটি কনট্যাক্ট লেন্স আছে ওনার চোখে। অত হাই পাওয়ারের চশমা লুকনোর জন্য লেন্স ছাড়া উপায় ছিল না।’
জটায়ুর হাঁ-মুখ আর বন্ধ হল না।
৯
রবীনবাবুর কনস্টেবলরা অনুকূলবাবুকে নিয়ে গেছে ওনার বাড়িতেই, সেখানে খানাতল্লাশী হওয়ার পর যাবে হোটেল মেট্রোপলিটান।
আমরা এখন দিল্লীর বাঙালি অ্যাসোশিয়েনের অফিসঘরে বসে। আমরা তিনজন ছাড়াও আছেন রবীনবাবু এবং প্রণব পাইন। প্রণব পাইন শুনে বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না। ‘এ তো মাথা ঘুরিয়ে দেওয়া খবর মশাই। কে বিশ্বাস করবে অনুকূল ভদ্র খুনী আসামী? আমরা তো ওনাকে শিল্পী মানুষ বলেই জানতাম, তা ছাড়া আড্ডাবাজও ছিলেন, প্রত্যেক বছর নাটক মঞ্চস্থ করতে সাহায্য করতেন।’
ফেলুদা প্রণববাবুর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘যার কথার সূত্রে এই কেসে আমার জড়িয়ে পড়া সেই সিদ্ধেশ্বর বোস ওরফে আমার সিধুজ্যাঠা জানিয়েছিলেন অনুকূল ভদ্র বরোদার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ছিলেন কিন্তু আচমকা রিটায়ারমেন্ট নিয়ে দিল্লীতে এসে সেটল করেন। আজ কলকাতায় আমার এক বন্ধুকে ফোন করে জানতে পারি অনুকূল ভদ্র বরোদা এমনি এমনি ছাড়েন নি। বরোদার পুলিশে খাতায় ওনার নাম উঠেছিল স্মাগলিং এর কারণে।’
‘স্মাগলিং?’ চমকে উঠলেন প্রণববাবু।
‘হ্যাঁ, আর্ট আইটেম স্মাগলিং। তবে অনুকূল বাবু আর্ট স্মাগলার ছিলেন না। আমার ধারণা ওনাকে এই স্মাগলিং চক্রের চাঁই মোটা টাকার অফার দিয়েছিল একটি চোরাই মাল বেচে দেওয়ার জন্য। প্রফেশনাল কারণেই ভদ্রলোকের বহু বিদেশী আর্ট কালেক্টরের সঙ্গে আলাপ ছিল। অনুকূল বাবু জানতেন না যে জিনিসটি চোরাই, ভেবেছিলেন উনি স্রেফ মিডিয়েটরের কাজ করছেন। এবং এই ভেবে না জেনেই জড়িয়ে পড়েছিলেন এই চক্রের সঙ্গে। ওনার দুর্ভাগ্য যে বরোদা পুলিশ এই চোরাই মালের কারবারটি ধরে ফেলে। যথেষ্ট সাক্ষ্যপ্রমাণের অভাবে আদালতে ওনার এগেন্সটে কেস টেঁকেনি, কিন্তু ওনার চাকরিটি যায়। বলা বাহুল্য যে ভদ্রলোকের কলীগ এবং বন্ধুরাও ওকে একঘরে করেন। ফলে বরোদার পাট উঠিয়ে চলে আসতে হয় ওনাকে।’
ভালো কথা, এই স্মাগলিং চক্রের চাঁইটিকে কিন্তু আপনারা চেনেন।’
ফেলুদা দম নেওয়ার জন্য একটু থেমেছিল, আমি সেই ফাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘মাধবরাও যোশী?’
‘ভেরি গুড তোপসে, হ্যাঁ মাধবরাও যোশী-ই। সেই যোশী যে দিল্লী এলেই কালীবাড়ি ছুটত। হুডিনির কথাটা মনে পড়ছে তোর?’
আমি ঘাড় নাড়লাম। সত্যিই, যে যত ভণ্ড তার ভক্তিও তত বেশী।
‘বরোদার পাট চুকিয়ে দিল্লী আসার পরেও যোশীর সঙ্গে অনুকূল ভদ্রের যোগাযোগ ছিন্ন হয়নি, সম্ভবত যোশীর কথাতেই ওনার দিল্লী আসা। যোশীর এনে দেওয়া আর্ট আইটেম বিক্রি করেই ওনার থাকাখাওয়ার খরচ উঠে আসত। অনুকূল বাবুকে জিজ্ঞাসা করলে সবই জানা যাবে তবে আমার ধারণা এগুলো চোরাই মাল নয়।’
রবীনবাবু বললেন, ‘তার মানে বলছেন বরোদার ঘটনা নিয়ে যোশী এবং অনুকূল ভদ্রের মধ্যে কোনো মনোমালিন্য ঘটেনি?’
‘মনোমালিন্য ঘটেনি কিন্তু সেটা অনুকূল বাবু কিছু বুঝতে দেননি বলেই। যোশীর শয়তানিতে অনুকূল ভদ্রের জীবন প্রায় শেষ হয়ে গেছিল, উনি চরম প্রতিহিংসা নেবেন বলে ঠিকই করে রেখেছিলেন। খালি সুযোগ খুঁজছিলেন সঠিক সময় এবং সুযোগের। এদিকে যোশীর সময়ও ভালো যাচ্ছিল না, সেও একটা মোটা দাঁও মারার অপেক্ষায় ছিল। এমন সময়ে যোশীকে অজান্তে প্ল্যান দিয়ে বসলেন লালমোহন বাবু।’
লালমোহনবাবুকে দেখে মনে হল দুষ্কর্মটি করার জন্য তিনি সত্যিই লজ্জিত। প্রণব পাইন ঘটনাটা জানতেন না, তাঁকে বলার পর এতক্ষণে মুখে হাসি ফুটে উঠল।
‘যোশীর এবারের আর্ট আইটেমটি দেখে অনুকূল বাবুর প্রথম থেকেই সন্দেহ হয়। সন্দেহ আরো ঘনীভূত হয় যখন যোশী ওনাকে স্পেশ্যালি আমেরিকান আর্ট কালেক্টরদের অ্যাপ্রোচ করতে বলে। অনুকূল বাবু নিজেও তিন নম্বর টিয়ার কথা বিশ্বাস করেন নি। ফ্যামিলি ফিজিসিয়ানের গল্পটা যোশীরই বানানো, অনুকূল সেটা বুঝেওছিলেন। কিন্তু যোশীকে কিছু না বলে তিনি একটা ডিটেইলড প্ল্যান ভাঁজেন। নিয়ে আসেন তাঁর নতুন অবতার পবনদেও জয়সওয়ালকে, যে নাকি জয়পুরের মহারাজার ফ্যামিলি ফিজিসিয়ানের বংশধর। যোশীকে সম্ভবত বুঝিয়েছিলেন যে পুরনো ঘটনার জন্যই অনুকুল ভদ্রকে তিনি সবার চোখের আড়ালে রাখতে চান। যোশীর স্বভাবতই আপত্তি করার কিছু ছিল না।’
‘কিন্তু টিয়াটা জয়সওয়াল চুরি করলেন কখন?’, জিজ্ঞাসা করলেন জটায়ু।
‘টিয়া তো চুরিই হয়নি মশাই।’
লালমোহনবাবু হাঁ করে তাকিয়ে আছেন দেখে ফেলুদা বলল, ‘সে কথাতেই আসছিলাম। কলকাতা থেকে ফিরে আসার পর অনুকূল ভদ্র জয়সওয়াল সেজে ফের ফোন করেন সিধুজ্যাঠাকে। সিধুজ্যাঠার পক্ষে অফ কোর্স এত কিছু জানা সম্ভব নয়। তিনি চুরির কথা সম্পূর্ণভাবে বিশ্বাস করলেন, অথচ সেই টিয়া তখন বহাল তবিয়তে যোশীর কাছেই আছে।’
প্রণব পাইন এবার হাত তুলে বললেন, ‘কিন্তু যেচে একজন গোয়েন্দাকে এর মধ্যে টেনে আনার কারণ কী মিত্তির মশাই?’
‘এটাই তো অনুকূল ভদ্রর সবথেকে বড় চাল। তিনি খুনে মোটিভটা দেখাতে চেয়েছিলেন লোভ। যোশীকে খুন করে জয়সওয়াল উধাও হলে প্রথমেই মোটিভের প্রশ্ন আসবে। রাজধানী এক্সপ্রেসে চুরির ঘটনাটা থাকলে সেখানে মনে হওয়া স্বাভাবিক যে ব্যক্তিই চুরি করে থাকুক, জয়সওয়ালের তার সঙ্গে সাঁট ছিল। সিধুজ্যাঠাকে যে গল্পই দু’জনে বলে আসুক না কেন, অনুকূল জানতেন যে তদন্ত শুরু হলে এ কথা প্রকাশ পাবেই যে টিয়াটা কেনার কথা ছিল জয়সওয়ালের। সিধুজ্যাঠাকে যদিও বলা হয়েছে জয়সওয়াল সেই চিকিৎসকের বংশধর, কিন্তু তদন্ত শুরু হলে দেখা যাবে সেটা ভুয়ো খবর। তাহলে এই জয়সওয়াল আসলে কে? কোনো একজন অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তি, যে যোশীকে ঠকিয়ে এবং খুন করে পালিয়েছে।’
ঘরে দমবন্ধকরা উত্তেজনা, জটায়ুর কপালে দেখলাম বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে।
‘কিন্তু অনুকূল তো খুন করছেন স্রেফ প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য, টিয়া তিনি পেলেন কি পেলেন না সেটা ম্যাটার করে না।’
ফেলুদা এবার থেমে আমার আর জটায়ুর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘সোলাঙ্কির বাড়ি কলকাতায় হওয়া সত্ত্বেও যোশী ওকে কেন দিল্লী আসতে বলেছিল বল্ দেখি? টাকাটা তো সে সোলাঙ্কিকে কলকাতায় দিলেই পারত।’
আমি বোকার মতন মাথা নাড়লাম, সত্যিই কোনো উত্তর নেই আমার কাছে।
ফেলুদা বলল, ‘দুঃখ করিস না, এটা যে একটা ইম্পরট্যান্ট পয়েন্ট সেটা আমার মাথাতেও আসেনি। আজ সকালে দেবরাজ বলল দিল্লীতে নাকি গত শুক্রবার থেকে এক বিশাল আর্ট কনভেনশন শুরু হয়েছে, দেশ বিদেশের অসংখ্য আর্ট কালেক্টর সেখানে এসেছেন।’
‘যোশী এই কনভেনশনটাকেই টার্গেট করেছিল। প্ল্যান ছিল এখানেই কোনো বিদেশী আর্ট কালেক্টরকে টিয়াটা বেচে দিয়ে সোলাঙ্কি এবং অনুকূলকে তাদের টাকার ভাগ দিয়ে দেবেন। অনুকূল অবশ্য সোলাঙ্কির ব্যাপারে কিছু জানতেন না।’
‘আচ্ছা, কুতব মিনারে তাহলে আমাদের ভয় কি অনুকূলই দেখিয়েছিলেন?’
‘সে কথা আর বলতে। অবশ্য তখন উনি ছিলেন জয়সওয়ালের অবতারে। একটা রিস্ক অবশ্যই নিয়েছিলেন কিন্তু চুরির মোটিভটাকে শক্ত করার জন্যই এই রিস্ক নেওয়া। মনে করে দেখুন সেই হুমকি চিরকুটে কি লেখা ছিল?’
‘রবীনবাবু, অনুকূল ভদ্রের বাড়ি থেকে একটা ট্যুইডের জ্যাকেট পাওয়ার কথা আপনাদের। জয়সওয়াল ওটা পরেই মেট্রোপলিটান হোটেল থেকে কুতব মিনার গেছিলেন আমাদের ভয় দেখাতে’, বলল ফেলুদা।
প্রণব পাইন একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়লেন, ‘কি শক্ত নার্ভ মশাই। জলজ্যান্ত একটা খুন করে এসে আপনাদের ভয় দেখালেন, তারপর পুজোর এখানে এসে সারাদিন কাটালেন, এমনকি পরের দিন নাটকের মঞ্চসজ্জা-মেকআপ সব কাজই করে দিলেন।’
‘খুনের দিনক্ষণ অনেক আগে থেকেই ঠিক হয়ে গেছিল প্রণববাবু। সিধুজ্যাঠার ফোনে আসা খবরটা ওনাকে একটা বাড়তি অ্যাডভান্টেজ দিয়েছিল মাত্র। দ্বিতীয়বার বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগ তুলে অনুকূল ভদ্র যোশীকে ডিসট্র্যাক্ট করে দেন, ফলে যোশীর অসতর্ক মুহূর্তে ওর বুকে ছোরা বসাতে আরোই সুবিধা হয়ে যায় অনুকূলের।’
‘ভালোই আটঘাট বেঁধেই কাজে নেমেছিলেন ভদ্রলোক’, বললেন জটায়ু।
‘বিলক্ষণ। শনিবার দিন জয়সওয়াল আর যোশীর একসঙ্গেই আর্ট কনভেনশনে যাওয়ার কথা ছিল। জয়সওয়াল যোশীকে খুন করে টিয়া পাখিটা নিয়ে ফের অনুকূল ভদ্র হয়ে গেলেন। যদিও টিয়া বিক্রি করার কোনো ইচ্ছে ওনার ছিল না। প্ল্যান ছিল প্রথম সুযোগেই এ শহর ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়া। শনিবারে খুন, রবিবারে নাটক, আজ অর্থাৎ সোমবার দিনই ওনাকে বেরোতে হত।’
‘কিন্তু ফেলুদা, উনি যে হাওড়া রাজধানীতেই যাবেন সেটা তুমি জানতে?’
‘এটা নেহাতই অনুমান। সবুজ তোতাকে নিয়ে নতুন কোন শহরেই বা আচম্বিতে হাজির হতেন অনুকূল বাবু? সেফ অপশন হল কলকাতায় ফিরে যাওয়া। সমস্ত অতীত ভুলে, নিজের শহরেই আবার নতুন করে জীবন শুরু করতে চাইছিলেন ভদ্রলোক। আর অত দামী একটা জিনিস নিয়ে সাধারণ কোনো ট্রেনে চড়বেন বলে মনে হয়নি আমার।’
জটায়ু শেষ কয়েক মিনিটে একটু কিন্তু কিন্তু ভাব করছিলেন। এবারে খানিকটা মরীয়া হয়েই বলে ফেললেন, ‘ফেলুবাবু সেই টিয়াটা একবার দেখা যাবে না?’
‘যাবে বই কি। থানায় নিয়ে যাওয়ার আগে আপনাদের দেখাবো বলেই তো এটা বয়ে নিয়ে এলাম’, বলে উঠলেন রবীন তরফদার। ওনার হাতে জয়সওয়ালের সেই অ্যাটাচি কেস। কম্বিনেশন লকের নম্বর অনুকূল ভদ্রই বলে দিয়েছেন, সেই অনুযায়ী পর পর নম্বর ডায়াল করে একটা মোক্ষম মোচড় দিতেই খুলে গেল অ্যাটাচি কেস।
রবীনবাবুর হাতে অবশেষে উঠে এসেছে রুবি আইড প্যারট। সবুজ টিয়ার ডানায় বসানো হীরের সারি ঝিকমিক করে উঠল, আর আধো অন্ধকার ঘরের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ল এক অপার্থিব সবুজ আভা। ফেলুদার দৌলতে আমি জানি এ সেই ময়সেনাইট, কত আলোকবর্ষ দূর থেকে উল্কায় করে একদিন এসে পড়েছিল পৃথিবীর বুকে।
ফেলুদা ফিসফিস করে বলল, ‘প্রাণ ভরে দেখে নে তোপসে, এ জিনিস দেখার আর স্কোপ পাবি না।’
আমাদের সবার চোখই উত্তেজনায় জ্বলজ্বল করছে। জ্বলজ্বল করছে টিয়ার চোখ দুটোও, সেও বোধহয় জানে একশ বছরের পুরনো আস্তানাতে ফিরে যাওয়ার সময় হয়েছে এবার।