ওয়াশিংটন ডিসি-র চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষর মতে ভারতীয় হাতি দিনে প্রায় দেড়শ কেজি খাবার খায়, তার মধ্যে একশ পঁচিশ কেজি খড়। ফল সেখানে নিতান্তই সাড়ে চার কেজি, আর তার পুরোটাই কলা নয়। পাকস্থলী দিয়ে হৃদয় জয়ের থিয়োরীটি যদি দেবতাদের জন্যও ভ্যালিড হয়, তাহলে বলতেই হচ্ছে যে প্রেয়সী পদে অধিকতর দাবী ছিল খড় বউয়ের। কিন্তু সে আর হল কই? শুকনো প্রায় পুড়ে যাওয়া চামড়ার খড়বউ নয়, গণেশের পাশে দিব্যি জায়গা করে নিলেন সতেজ, তন্বী, হরিৎবর্ণা কলাবউ। সাধে লীলা মজুমদার বলে গেছেন ‘পৃথিবীটাই অসাড়’।
পুরাণ জানাবে হস্তীমুন্ড গণেশের কিউটনেস নিয়ে এ যুগের বালখিল্যরা যতই লাফালাফি করুক না কেন, সে যুগে পাত্রী খুঁজে পেতে হয়রান হতে হয়েছিল। গার্গী, লোপামুদ্রা, অপালাদের সময়, সাত চড়ে রা কাড়বে না এরকম দেবী বা মানবী খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। আর সাত চড়ে রা না কাড়া পাত্রী ছাড়া কেই বা ওহেন কিম্ভূতকিমাকার বরকে পছন্দ করবে? পোটেনশিয়াল পাত্রীরা শাস্ত্র গুলে খেয়ে থাকলে আরোই সমস্যা, সেখানে কোনো পুঁথি জানাচ্ছে গণেশের আজীবন ব্রহ্মচারী হয়ে থেকে যাওয়ার কথা, কোথাও আবার লক্ষ্মী সরস্বতীর সঙ্গে গণেশের সম্পর্কটি আদৌ ভাই বোনের কিনা সে নিয়ে বিস্তর সন্দেহ প্রকাশ করা হয়েছে। সুতরাং, ব্রীড়াভারে দোদুল্যমান কলাবউ ছাড়া গতি কি? ও হ্যাঁ, ভাঙ্গা দাঁতটিকেও ভুলে গেলে চলবে না। দক্ষিণী শাস্ত্রর কথা অনুযায়ী অতিভোজনের ফলে পেট ফেটে মিষ্টি বেরিয়ে এলে চাঁদ সেই দেখে বিস্তর হাসাহাসি করছিল, চাঁদকে শায়েস্তা করার জন্যই নিজের দাঁত নিজে ভেঙ্গে ছুঁড়ে দেন গণেশ। পরিমিতিবোধের অভাব, অতি উত্তেজনা ইত্যাদি ইত্যাদি।
নৃতত্ববিদরা অবশ্য বলবেন নবপত্রিকার অপরিহার্য অঙ্গ কলাবউকে পুজো করা কৃষিপ্রধান গ্রামবাংলার স্বাভাবিক রিচুয়াল। শুধু তো কলাগাছ নয়, তার সঙ্গে পুজো পাচ্ছে কচু, বেল, ধান, মান, হলুদ, ডালিম, অশোক, জয়ন্তী গাছও। কিন্তু এত গাছ থাকতে কলাকেই কেন প্রাধান্য দেওয়া হল? লজিস্টিকস একটা কারণ অবশ্যই হতে পারে – একটা বেল বা ডালিম গাছকে তো মণ্ডপে তোলা যায় না, আবার ধান বা কচু এনে হাজির করলে তা চোখেই ধরবে না। সেদিক থেকে কলাবউ এর সাইজ ও শেপ (আহেম্) এর সঙ্গে টক্কর দেওয়া মুশকিল। কিন্তু শুধুই কি লজিস্টিকস? পুরাণ জানাচ্ছে কলাগাছের অধিষ্ঠাত্রী দেবীর নাম ব্রহ্মাণী। ব্রহ্মার মতনই দুর্গার এই অবতারেরও তিনটি মুখ – অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ এর পরিচায়ক। এবং হ্যাঁ, ব্রহ্মার মতনই ইনিও সৃষ্টির দেবতা।
সৃষ্টি এবং কলা?
‘Kali’s Child’ বইয়ে জেফ্রি ক্রিপাল লিখেছেন বাংলার তন্ত্রসাধনায় ব্রহ্মাণী পুজোয় বরাদ্দ থাকত রক্তমাখানো কলা। এখানে কলা যে পুরুষ লিঙ্গর প্রক্সি সে কথা বলাটাই বাহুল্য। কলা গাছ যেন বাংলার অর্ধনারীশ্বর, পুরুষ এবং প্রকৃতির অভূতপূর্ব সহাবস্থান। মনে রাখা ভালো পুরাণ হোক বা উপনিষদ, গণেশকে কিন্তু সবসময়ই স্বয়ম্ভূ হিসাবেই দেখানো হয়েছে। এমনকি যে সব পুরাণে বলা হয়েছে দুর্গা নিজেই গণেশকে বানিয়েছেন সেখানেও ফুটনোটে লেখা থাকছে চানের সময় ঝরে পড়া ধুলো থেকেই গণেশের জন্ম, অর্থাৎ গণেশের জন্মের উপাখ্যানটিও যেন আরেক প্রক্সি, উর্বর সুজলা সুফলা পৃথিবীর।
অবশ্য সৃষ্টিরহস্য নিয়ে মাথা যখনই ঘামানো হয়েছে, কলাকে সরিয়ে রাখা যায় নি। অন্তত যে সব দেশে কলাগাছ পর্যাপ্ত পরিমাণে পাওয়া যায়, সেই দেশের মানুষরা কলাকে ভুলে থাকতে পারেন নি।
পলিনেশিয়ান দ্বীপগুলির কথাই ধরুন, ডাঙ্গায় রইল কিছু ফলের গাছ আর তার বাইরে জল। সুতরাং, এই দ্বীপের মানুষগুলির অন্যতম প্রধান দেবতা কানালোয়া কি ভাবে পূজিত হবেন? জলে থাকলে অক্টোপাস হিসাবে। আর ডাঙ্গায় এলে? ঠিক ধরেছেন, কলাই বটে। মিশরের শিল্পকলায় প্রায়শই দেখা যেত পুনর্জন্মের দেবতা ওসিরিসের কপালে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে ছোট কলাপাতা, হ্যাঁ প্রাচীন মিশরেও কলাগাছ প্রজননক্ষমতার প্রতীক। উৎসাহীরা হয়ত এও জানবেন যে কলা নিয়ে আদিখ্যেতা স্রেফ পেগান পূজারীদের নয়। আধুনিক উদ্ভিদবিজ্ঞানের জনক সুইডিশ বৈজ্ঞানিক কার্ল লিনিয়াস বিশ্বাস করতেন সাপের সঙ্গে মোলাকাতের পর আদম আর ইভ যা পরেছিলেন তা নেহাতই কলা গাছের পাতা। লিনিয়াস অবশ্য আইডিয়াটি পেয়েছিলেন ইসলামিক মিথ থেকে, যেখানে আপেল নয় কলাকেই বলা হয়েছে স্বর্গের ফল।
কলাবউকে নিয়ে বেশ কিছু কথা হল, গণেশের কাছে একবার ফিরি। মনে রাখা ভালো বৈদিক সাহিত্যে গণেশের কোনোরকম উল্লেখ নেই। মহাভারতে যে গণেশকে আমরা দেখি তিনি শ্রুতিধর লেখক, যাকে ব্যস্ত রাখতে বেদব্যাস হিমশিম খেয়ে যাচ্ছিলেন। মহাভারত বিশেষজ্ঞদের মতে ব্যাসদেব এবং গণেশের এই গল্প আদি মহাভারতে ছিল না, অনেক পরে সংযোজিত হয়েছে। ইরাবতী কার্ভে-র অসাধারণ বই ‘যুগান্ত’ পড়লে একটা সম্যক ধারণা পাওয়া যায় কিভাবে হাজার হাজার বছর ধরে আর্য ভাষাগোষ্ঠীর মানুষরা ক্রমান্বয়ে মহাভারত (এবং রামায়ণ) কে নিজেদের মর্জি অনুযায়ী বাড়িয়ে গেছেন, গণেশের গল্প সেই অনৃতভাষণের অংশ বিশেষ। হয়ত মহা শ্রুতিধর কোনো লেখক (যাঁর নাম সত্যিই গণেশ) আদতেই লিখতে বসেছিলেন মহাভারতের গল্প, পারিশ্রমিক হিসাবে চেয়ে নিয়েছিলেন নিজের অমরত্ব। কি আর করা, যিনি বলছিলেন তাঁকে রাজি হতে হল। তবে অমরত্বের বায়নাক্কায় কথক বোধহয় সামান্য বিরক্তই হয়েছিলেন। নিজের উদ্ভাবনী শক্তিকে কাজে লাগিয়ে জুড়ে দিলেন হাতির মাথা (হাতিই কেন? সে আরেক থিয়োরী, পরে কখনো আড্ডায় বসা যাবে)। সম্ভবত মস্তিষ্কের সাইজ দেখে এবং বুদ্ধিধর, সিদ্ধিদাতা সুলভ প্রভূত বিশেষণের পাল্লায় পড়ে লেখক গণেশ এহেন ফ্যান্টাসি ফিকশন নিয়ে আর বাক্যব্যয় করেন নি।
গণেশ এলেন।
কিন্তু কলাবউয়ের আসতে তখনো ঢের দেরী।
পাণ্ডববর্জিত জায়গা নাম দিয়ে আর্যভাষীরা যে বাংলায় আসতে অস্বীকার করেছিলেন সেখানেই যে এরকম বিবাহবিভ্রাটে পড়তে হবে তা বোধহয় গণেশ বা ব্যাসদেব কেউই কল্পনা করতে পারেননি, নইলে বিয়েটা ওই হাজার বছর আগেই চুকিয়ে ফেলা যেত। আসলে দেখতে পেতেন আর্যভাষীদের পৌরুষতন্ত্র নয়, আমরা আপন করেছিলাম কালী ও ব্রহ্মাণীর নারীশক্তিকে। উড়ে এসে জুড়ে বসা গণেশের জন্য আমাদের পছন্দের পাত্রীকে অন্তত লজিক দিয়ে হঠানো যাবে না।
সুতরাং?
আর কি, যাঃ কলা!
(স্থিরচিত্র – আনন্দবাজার পত্রিকা, চিত্রগ্রাহক – রণজিৎ নন্দী)