সেই বাঙালি সন্ন্যাসী

DS1

বিক্রমশীল বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই বাঙালি সন্ন্যাসী চলেছেন তিব্বতের পথে, তিব্বতের রাজার বিশেষ অনুরোধে বৌদ্ধ ভিক্ষু জয়শীল এসেছেন তাঁকে নিয়ে যেতে। সঙ্গে আছেন আরেক ছাত্র ও সন্ন্যাসী বীরভদ্র। জয়শীলের আশা নেপালে কিছুদিন থাকতে হলেও তাঁদের গুরুকে নিয়ে বছরখানেকের মধ্যে তিব্বতে পৌঁছে যাবেন। কিন্তু বিধি বাম, একের পর এক অতিলৌকিক পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে তাঁদের। বাঙালি সন্ন্যাসীটিও জেদ ধরে আছেন, সমস্ত অতিলৌকিক রহস্যকেই যুক্তিজালে খন্ডিত না করা অবধি তাঁর শান্তি নেই।

অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান কে নিয়ে সে সব গল্প তো ইতিহাসে পাওয়া যাবে না, তাই কলম ধরতে হল। সিরিজের প্রথম গল্প ‘ডাকিনী ও সিদ্ধপুরুষ” পড়া যাবে টগবগ পত্রিকার ‘সরল দে সংখ্যা’য়, প্রকাশিত হতে চলেছে এই জুন মাসেই। বন্ধুরা নজর রাখুন টগবগের ফেসবুক পেজটিতে –https://www.facebook.com/groups/652430701572990/

সঙ্গের অনবদ্য ছবিটি এঁকেছেন শিল্পী শ্রী সুমিত রায়।

উগ্র জাতীয়তাবাদ, সমস্যা যখন গোটা পৃথিবীর

২৫শে মে’র আনন্দবাজার পত্রিকার উত্তর-সম্পাদকীয়তে আমার লেখা   এই প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছে (http://www.anandabazar.com/editorial/violent-nationalism-is-winning-everywhere-1.394601)।

Trump-Putin-1-1024x675

ভারতে মোদী, ইজরায়েলে নেতানইয়াহু, তুরস্কে এরদোয়ান, পোল্যান্ডে দুদা, রাশিয়ায় পুতিন – দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে পৃথিবী জুড়ে এতজন কট্টর জাতীয়তাবাদী নেতাকে প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতি রূপে তখতে বসে থাকতে বোধহয় আমরা আগে দেখিনি। অবশ্য পরিস্থিতির চাপে যেখানে আঙ সান সু চি রোহিঙ্গাদের বার্মিজ বলে মেনে নিতে অস্বীকার করছেন বা এঞ্জেলা মার্কেল জার্মানি তথা ইউরোপীয়ন ইউনিয়নকে সিরিয়ান শরণার্থীদের নাগালের বাইরে নিয়ে যাওয়ার জন্য তুরস্ককে কোটি কোটি ইউরো দান করছেন সেখানে মেনে নেওয়া ভালো যে আলো ক্রমে নিভিছে। আগামী নভেম্বরে ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন রাষ্ট্রপতির পদটি গ্রহণ করলেই বৃত্তটি সম্পূর্ণ হয়। এই জাতীয়তাবাদ দেশবাসী নয় দেশকে ভালো রাখার প্রতিশ্রুতি দেয়,  এবং দেশ নামক সেই বিমূর্ত ধারণাটিকে দেশবাসীর মাথায় গেঁথে দেওয়ার জন্য  এমন দিনের গল্প শোনায় যেখানে ইতিহাস, পুরাণ আর কল্পনা মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। এ যে নেহাত কথার কথা নয় সেটা দেশে বসে অধিকাংশ মানুষই বিলক্ষণ টের পান কিন্তু সে সমস্যা যে শুধু ভারতের নয় সেটা বোঝার সময় এসেছে।

আন্দ্রেই দুদার কথাই ধরুন। ভদ্রলোকের দয়ার শরীর, কোটি কোটি সিরিয়ান এবং আফ্রিকান শরণার্থীদের মধ্যে জনা দেড়শকে ঠাঁই দিয়েছেন পোল্যান্ডের মাটিতে; যারা ঢুকেছেন তাঁরাও অবশ্য প্রায়ই মারধোর খাচ্ছেন। কিন্তু দুদা শুধু শ্বেতাঙ্গ পোলিশদের ত্রাতা হিসাবেই দেখা দেননি, ইতিহাসকেও দস্তুরমতন নিজের পথে চালাতে চাইছেন। পোলিশ রাষ্ট্রপতি সম্প্রতি ঘোষণা করেছেন পোল্যান্ডের ইতিহাসের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হল হাজার বছর আগের এক পোলিশ রাজার ক্রিশ্চান ধর্মে দীক্ষিত হওয়া। ভেবে দেখুন একবার, এই সেই দেশ যেখানে নাজি অত্যাচারের দগদগে স্মৃতি নিয়ে এখনো দাঁড়িয়ে অসউইজ কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প, এই সেই দেশ যেখানে স্টালিন এবং তাঁর অনুগামী পোলিশ কম্যুনিস্টরা চল্লিশ বছর ধরে হাজার হাজার মানুষকে জেলে পুরে রেখেছেন, এই সেই দেশ যেখানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও ইহুদীরা বহু বছর ধরে নির্যাতিত হয়ে এসেছেন। কিন্তু না, এত ঘটনাবহুল আধুনিক ইতিহাসের কোনোকিছুই পোলিশ রাষ্ট্রপতির কাছে গুরুত্ব পায় নি (কিছু ঘটনা স্রেফ অস্বীকারও করেছেন), গুরুত্ব পেয়েছে শুধুই ধর্ম।

অতি জাতীয়তাবাদের একটি প্যাটার্ন বুনে দেওয়ার জন্য বহু মানুষ সমস্যাটিকে ধর্মের ক্যালাইডোস্কোপে দেখতে চান। বর্তমান পৃথিবী অবশ্য সঘোষে জানাচ্ছে অতি জাতীয়তাবাদ কোনো বিশেষ ধর্মের কুক্ষিগত অধিকার নয়। তাকানো যাক ধর্মনিরপেক্ষ কিন্তু মুসলিমপ্রধান তুরস্কের দিকে।  ধর্মনিরপেক্ষতা এবং উদারপন্থার নিরিখে মধ্যপ্রাচ্য এবং পূর্ব ইউরোপের সমস্ত  দেশগুলির মধ্যে তুরস্ক ছিল সর্বতোভাবে অগ্রগামী।  অটোমান সাম্রাজ্যের শেষের সময়ে আর্মেনিয়ান গণহত্যার বিভীষিকাময় দিনগুলির থেকে দেশটিকে উদারপন্থার দিকে নিয়ে যাওয়াটা মোটেই সহজ কাজ ছিল না কিন্তু কেমাল আতাতুর্ক সেটাই করে দেখিয়েছিলেন।  আতাতুর্ক ক্ষমতায় আসার পর প্রায় একশ বছর হতে চলল, খাতায় কলমে তিনি এখনো এ দেশের জনক অথচ তাঁর ধ্যানধারণার গুরুত্ব যেন ক্রমেই কমে আসছে। শেষ কয়েক বছর ধরে এ দেশের তাবড় নেতারা ঘটা করে পালন করছেন কনস্ট্যান্টিনোপলের পতনবার্ষিকী। তাঁদের বিশ্বাস গত শতাব্দীতে ঘটা তুরস্কের মুক্তিযুদ্ধ নয়,  ১৪৫৩তে বাইজ্যান্টাইন সাম্রাজ্যের পতনই নাকি উন্মেষ ঘটিয়েছে তুর্কী জাতীয়তাবাদের। মনে রাখা ভালো যে আদি অটোমানরা এসেছিলেন তুর্কমেনিস্তান থেকে, ইস্তানবুল থেকে যার দূরত্ব প্রায় হাজার দুয়েক মাইল। একবিংশ শতাব্দীতে পৌঁছেও তুরস্কের মতন আধুনিক একটি দেশে ঔপনিবেশিক জাতীয়তাবাদ প্রাধান্য পাচ্ছে, বিস্ময়াতীত ট্র্যাজেডি ছাড়া কি বলবেন বলুন? তবে সবসময় যে এত স্থূলপদ্ধতিতেই জাতীয়তাবাদ চাগিয়ে তোলা হয় সে কথা ভাবলে ভুল হবে। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। ১৯১৫-র আর্মেনিয়ান গণহত্যাকে তুরস্কের কোনো সরকারই গণহত্যা বলে স্বীকার করেনি, অথচ বর্তমান সরকারের কর্ণধাররা প্রায় আচম্বিতেই বলতে শুরু করেছেন যে তাঁরা সেই সুদূর অতীতের কথা ভেবে ব্যথিত। তাহলে কি আলো দেখা গেল? না। কারণ যে আর্মেনিয়ানরা খুন হয়েছিলেন তাঁদেরকে এখন বলা হচ্ছে অটোমান আর্মেনিয়ান, অথচ অটোমান রাজপরিষদরাই যেনতেন প্রকারেণ চেয়েছিলেন আর্মেনিয়ানদের  এ দেশ থেকে দূর করতে। সে কথা ভোলানোর চেষ্টা করা হচ্ছে এক বৃহৎ জাতীয়তাবাদের জিগির তুলে, যেন তুরস্ক রাষ্ট্রে জাতিধর্মবর্ণ নির্বিশেষে সবার চিরকাল অক্ষয় স্থান ছিল এবং পনের লাখ মানুষের মৃত্যু স্রেফ কেন্দ্রীয় শক্তির সঙ্গে আঞ্চলিক শক্তির  সংঘাতের ফল।

কেউ নরম গলায় মিষ্টি হেসে উগ্র জাতীয়তাবাদকেই ভবিতব্য বলে চালানোর চেষ্টা করছেন কেউ আবার পেশী ফুলিয়ে গরম বুলি আউড়ে প্রমাণ করতে চাইছেন জোর যার মুলুক তার। আজ আট মাসের বেশী সময় ধরে রাশিয়ার সেনাবাহিনী সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আসাদের রাজনৈতিক বিরোধীদের ধ্বংস করার  কাজে সহায়তা করছে অথচ কতজন শরণার্থীকে পুতিন আশ্রয় দিয়েছেন নিজের দেশে? গত বছর চারশ বিরাশি জন সিরিয়ানকে রাশিয়া অস্থায়ী শরণার্থী হিসাবে দেশে ঢুকতে দিয়েছে, আর স্থায়ী শরণার্থী এক জন মানুষও হতে পারেননি। অথচ সাম্প্রতিক একটি সমীক্ষা অনুযায়ী রাশিয়ার প্রায় সত্তর শতাংশ মানুষ পুতিনের  আগ্রাসনকে সমর্থন করছেন। ২০১৪তেও প্রায় ঊননব্বই শতাংশ রাশিয়ান জানিয়েছিলেন ইউক্রেনের উচিত ক্রিমিয়াকে রাশিয়ার হাতেই তুলে দেওয়া। পেরেস্ত্রৈকা এবং গ্লাসনস্ত উত্তর সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হওয়ায় মধ্য এশিয়া এবং বাল্টিক সাগরের পাশের সোভিয়েত কলোনিরা যতই খুশী হোক না কেন, খোদ রাশিয়ার জাত্যভিমানে যে বড়সড় একটা আঘাত পৌঁছেছিল সেটা বলা বাহুল্য। শুরুর দিকের চাকরি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য পরিষেবার অপ্রতুলতায় মানুষ  এসব নিয়ে বড় একটা মাথা ঘামাননি কিন্তু আস্তে আস্তে যেই দেশের অর্থনীতিতে স্থিতি আসতে শুরু করেছে, পশ্চিমী দুনিয়া ‘ইমার্জিং ইকোনমি’ তকমা লাগিয়েছে রাশিয়ার মানুষও হৃতগরিমা কি ভাবে ফিরে পাওয়া যায় সে নিয়ে অল্পবিস্তর ভাবনাচিন্তা শুরু করেছেন। দুঃখের ব্যাপার এই যে এমন এক মানুষের হাতে ততদিনে ক্ষমতা পৌঁছেছে যিনি হৃতগরিমা শুধুই খুঁজে পেয়েছেন উগ্র জাতীয়তাবাদের বিস্তারের মধ্যে। ওদিকে রাশিয়ার অর্থনীতি শেষ দু’তিন বছর ধরেই মুহ্যমান হয়ে আছে। পুতিন যতই তেলের দাম পড়ে যাওয়াকেই দায়ী করুন  না কেন এটা ঘটনা যে বিদেশী বিনিয়োগ আনতে ব্যর্থতা, দুর্নীতি, মাঝারি এবং ক্ষুদ্র শিল্প ক্ষেত্রে চরম ব্যর্থতা এই সবকিছু মিলে রাশিয়ার অর্থনীতি এখন ভেতরফোঁপরা। কিন্তু সে নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় বা ইচ্ছা পুতিনের আছে বলে মনে হয় না।

কিন্তু শুধু পোল্যান্ড, রাশিয়া বা তুরস্ক নয় গোটা ইউরোপ জুড়েই অতি রক্ষণশীল, উগ্র জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক দলগুলি মানুষের সমর্থন পাচ্ছে – ফ্রান্স, হল্যান্ড কি স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলিতে গড়ে মোট ভোটের দশ থেকে কুড়ি শতাংশ এখন এদের দখলে। সিরিয়া এবং আফ্রিকার শরণার্থী সমস্যা অবশ্যই ইউরোপের মানুষকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে, এঞ্জেলা মার্কেলের মতন তুলনামূলক ভাবে উদারপন্থী নেতাদের ওপরে আর ভরসা রাখতে পারছেন না তাঁরা। কিন্তু শুধু সেই কারণেই কি উগ্র জাতীয়তাবাদের এত বাড়বাড়ন্ত? মনে হয় না।  বিশ্বায়িত পৃথিবীতেও নিরানব্বই আর এক শতাংশের ফারাক বেড়ে চলতে দেখলে কোন মানুষের আর বিশ্বনাগরিক হিসাবে পরিচয় দিতে ভালো লাগে? একজন তুর্কী দেখছেন বুলগেরিয়া, এস্তোনিয়া কি মাল্টার মতন দেশও ইউরোপীয়ন ইউনিয়নের সদস্যপদ পাচ্ছে স্রেফ ধর্ম ও বর্ণ পরিচয়ে, একজন পোলিশ দেখছেন একমাত্র ইউরোপীয় দেশ হিসাবে মন্দার বাজারে সাফল্যের মুখ দেখলেও লভ্যাংশের সিংহভাগটা সেই চলে যাচ্ছে ইউরোপীয় সুপারপাওয়ারদের কাছেই, একজন সার্বিয়াান দেখছেন শুধু রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক বজায় থাকার জন্য যোগ্যতা সত্ত্বেও ইউরোপীয়ন ইউনিয়নে ঢুকতে পারছেন না। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা হোক বা আন্তর্জাতিক অর্থ ভান্ডার, রাষ্ট্রপুঞ্জ হোক  বা ইউরোপীয়ন ইউনিয়ন, সাধারণ মানুষের কাছে এই সংস্থাগুলি যে প্রতিশ্রুতি নিয়ে এসেছিল তার অধিকাংশই পূর্ণ হয় নি। একথা অনস্বীকার্য যে বিশ্বায়নের মাধ্যমে উন্নয়নশীল দেশগুলির মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্ত সমাজ পেয়েছে অনেক কিছুই কিন্তু সেই এক কুমীরছানাকে বার বার দেখিয়ে উন্নত দেশগুলি তার ফায়দা তুলেছে হাজার গুণ। স্বভাবতই যে মানুষগুলির ভাগ্যে কিছুই জোটেনি (এবং তাঁরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ) তাঁরা নিজেদের প্রাথমিক পরিচয়েই ঘুরে দাঁড়াতে চাইছেন, আর জাতীয়তাবাদের শুরুর কথাও সেখানেই লুকিয়ে। ভুললে চলবে না এমনকি উন্নত দেশগুলিতেও আর্থিক বৈষম্য চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে, ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ার যে খনিশ্রমিকরা ডোনাল্ড ট্রাম্পকে জেতাবেন বলে পণ করেছেন তাঁদেরকেও কিন্তু ধোঁকার টাটি কম দেখানো হয়নি। মানুষের চরিত্রগত লোভ ও খলতা, হাজার হাজার বছরের সামাজিক ইতিহাস, গণতন্ত্রের সার্বিক বিকাশ না ঘটা এসবের কোনোকিছুকেই অস্বীকার করছি না কিন্তু আশাভঙ্গের আখ্যানটিরও একইরকম গুরুত্ব পাওয়া উচিত।

 

রাজনৈতিক লক্ষ্য, অর্থনৈতিক বাস্তব – প্রসঙ্গ যখন নির্বাচন

West Bengal Politics

বাহাত্তর সালে দ্রাবিড় মুন্নেত্রা কাজাগম থেকে বেরিয়ে এসে এম-জি- রামচন্দ্রন প্রতিষ্ঠা করেন নতুন দল অল ইন্ডিয়া আন্না দ্রাবিড় মুন্নেত্রা কাজাগম। তার ঠিক এক বছর আগে তামিলনাড়ুর পঞ্চম বিধানসভা নির্বাচনে ২৩৪ টি আসনের মধ্যে করুণানিধির দ্রাবিড় মুন্নেত্রা কাজাগম পেয়েছিল ২০৫ টি আসন, নিকটম প্রতিদ্বন্দ্বী কামরাজের জাতীয় কংগ্রেস (অর্গানাইজেশন) পেয়েছিল একুশটি আসন। আরো চার বছর আগে প্রথমবারের জন্য তামিলনাড়ুতে কংগ্রেসকে হটিয়ে বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসে এই ডি-এম-কে। রামচন্দ্রনের এ-আই-এ-ডি-এম-কে ও প্রতিষ্ঠিতে হওয়ার পর প্রথম বিধানসভা নির্বাচন (১৯৭৭) লড়েই ক্ষমতায় চলে আসে।

পাশের রাজ্য অন্ধ্রপ্রদেশে অবশ্য কংগ্রেস সত্তরের দশকেও পূর্ণ ক্ষমতা উপভোগ করে গেছে। কম্যুনিস্টদের প্রভাব থাকা সত্ত্বেও সে রাজ্যে সিপিএম এবং সিপিআই মিলে খান কুড়ির বেশী আসন কোনোদিনই পায় নি। ১৯৮৩তে প্রথমবারের জন্য রাজনৈতিক পালাবদল ঘটে যখন এন-টি রামারাও এর তেলেগু দেশম ২৯৪ টি আসনে মধ্যে ২০১ খানি জিতে ক্ষমতায় আসে। তেলেগু দেশমের প্রতিষ্ঠা ১৯৮২ সালে।

হালের আম আদমি পার্টিও প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর পরেই ক্ষমতায় আসে ২০১৩ তে, শেষ হয় দিল্লী বিধানসভা থেকে কংগ্রেসের পনেরো বছরের দীর্ঘ শাসন।

এই দলগুলির পাশাপাশি তৃণমূল কংগ্রেসকে রাখুন। বিধানসভা নির্বাচনে সাফল্য কিন্তু তৃণমূল শুরুতেই পায়নি, অপেক্ষা করতে হয়েছে তেরোটি বছর। কেন? জ্যোতি বসুর ক্যারিশমা কি কংগ্রেসের সাবোটাজ জাতীয় থিয়োরীগুলোকে উপেক্ষা করলে দু’টি আপাতসম্ভব ব্যাখ্যা্র ওপর আমরা জোর দিতে পারি – ১) রাজ্যের মানুষ বামফ্রন্টের কাজে সন্তুষ্ট ছিলেন, ২) তৃণমূল কংগ্রেসের রাজনৈতিক লক্ষ্যটি সাধারণ মানুষের কাছে পরিস্ফুট হয়নি। পুরো আশির দশকের স্থবির অর্থনৈতিক চিত্রটি উনিশশ নব্বইয়ের শেষে বা দু’হাজারের শুরুতেও পশ্চিমবঙ্গের মানুষের চোখে ধরা পড়েনি একথা বিশ্বাসযোগ্য নয়। উপরন্তু নব্বইয়ের দশক থেকেই প্রায় সমস্ত পরিসংখ্যানের মাপকাঠিতেই কলকাতা প্রথম সারির মহানগরীর মধ্যে জায়গা হারাতে শুরু করে, বেঙ্গালুরু বা হায়দ্রাবাদের উত্থানও সচেতন মানুষদের নজর এড়ায়নি বলেই আমার ধারণা। কলকাতাই পশ্চিমবঙ্গ নয় কিন্তু এ কথা দুর্ভাগ্যজনক ভাবে অনস্বীকার্য যে গরীব রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষা – স্বাস্থ্য – শিল্প জনিত সাফল্য প্রথম থেকেই কলকাতা নির্ভর, বিধান রায়ের আমল থেকে শুরু করে জ্যোতি বসুর আমল পর্যন্ত। জ্যোতিবাবুরা যে সাফল্যের সঙ্গে গ্রামবাংলায় ভূমিসংস্কার করতে পেরেছিলেন তার ছিটেফোঁটাও গ্রামের স্বাস্থ্য বা শিক্ষায় দেখাতে পারেননি। এহেন পরিস্থিতিতে একটি নতুন রাজনৈতিক দল যে ফায়দা তুলতে পারত তৃণমূল তা পারেনি। বলা বাহুল্য যে বহু বছর ধরেই মানুষ সিপিএম বিরোধিতার বাইরে তৃণমূলের রাজনৈতিক লক্ষ্য কিছু দেখতে পাননি।

দ্বিতীয়বারের জন্য বিপুল জনসমর্থন নিয়ে তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পরের দিন এ কথাগুলো কেন তুলছি সে নিয়ে অনেকে বিস্মিত হতে পারেন। একটাই কারণ, দু’হাজারের তৃণমূলের মতনই দু’হাজার ষোলর কংগ্রেস বা বামফ্রন্টেরও কিন্তু কোনো সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক লক্ষ্য আমরা দেখতে পাই নি, যেন তেন প্রকারেণ ক্ষমতায় আসা অবশ্যই কোনো রাজনৈতিক লক্ষ্য হতে পারে না এবং বাংলার মানুষ সেটা যে বিলক্ষণ জানেন সেটাও টের পাওয়া গেছে। অথচ দু’হাজার ষোল সালের অর্থনৈতিক বাস্তবটিকে মানুষের সামনে পৌঁছে দেওয়াটাই হতে পারত বিরোধীদের প্রধান রাজনৈতিক লক্ষ্য, এবং আমার বিশ্বাস সেটি সঠিকভাবে করতে পারলে এরকম ভাবে ধুয়েমুয়ে যেতে হত না। অর্থনৈতিক বাস্তবটি কি সেটি এবার একটু দেখে নেওয়া যাক। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের রাজ্যওয়াড়ি বাজেট নিয়ে সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে শেষ পাঁচ বছরের (২০১০ – ২০১৪) মতন ২০১৫ তেও ঋণ এবং রাজ্যের উৎপাদন সম্পদের (গ্রস স্টেট ডোমেস্টিক প্রোডাক্ট) আনুপাতিক হিসাবে পশ্চিমবঙ্গ special category (অর্থাৎ উত্তর পূর্বাঞ্চল, কাশ্মীর, হিমাচল প্রদেশ এবং উত্তরাখন্ড) রাজ্যগুলিকে বাদ দিয়ে সারা দেশের মধ্যে সবথেকে খারাপ অবস্থায় আছে। শুধু এটুকু তথ্যে অবশ্য পুরো চিত্রটি ফুটে উঠবে না – ২০১০ সালে যেখানে প্রতি এক টাকা সমতুল্য পণ্য সামগ্রী উৎপাদন করতে গিয়ে আমরা চুয়াল্লিশ পয়সা ধার করেছি, সেটা ২০১৫ সালে নেমে এসেছে সাড়ে পঁয়ত্রিশ পয়সায়। রঘুরাম রাজন এবং তাঁর সহকর্মীদের ধারণা ২০১৬ তে সেটা আরো নেমে তেত্রিশ পয়সা হবে। অর্থাৎ সংখ্যার হিসাবে বাম আমলের তুলনায় তৃণমূল সরকার ধার এবং আয়ের অনুপাত ক্রমান্বয়ে কমিয়ে আনতে পেরেছে। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সরকার যে বেশ বড় একটা ঋণের অঙ্ক খাতায় রেখে বিদায় নিয়েছিলেন সে নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তৃণমূলের নেতারা কারণে অকারণে সেটা মনে করিয়ে দেন বলে বিরক্তি আসতে পারে কিন্তু এটা ঘটনা যে ২০১১ সালে ক্ষমতা হস্তান্তরের সময় পশ্চিমবঙ্গের ধারের পরিমাণ ছিল এক লাখ চুরানব্বই হাজার কোটি টাকা। পাঁচ বছর পরে সেই সংখ্যাটা দাঁড়িয়েছে দু লাখ চুরাশি হাজার কোটিতে। কিন্তু রাজ্যের উন্নয়নের ক্ষেত্রে ঠিক কতটা প্রতিবন্ধকতা তৈরী করছে এই সংখ্যাগুলো?

একের পরে ছ সাতটা শূন্য বসলেই যেখানে আমরা সংখ্যাগুলি ধারণা করতে হিমশিম খাই সেখানে দু-তিন লাখ কোটি শব্দবন্ধ প্রায় পরাবাস্তব ঠেকতে পারে। কিন্তু আপনার আমার সংসারের জন্য যেটা সত্যি সেটা একটা রাজ্য বা দেশের ক্ষেত্রে নাও সত্যি হতে পারে। অর্থনীতিবিদরা জানাচ্ছেন ধারের পরিমাণ বেড়ে গেলেই যে অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার কমবে এরকম কোনো কথা নেই। ভারতবর্ষের নিজেরই ঋণ এবং জাতীয় আয়ের অনুপাত ৬৫% (অর্থাৎ ১ টাকার পণ্য উৎপাদন করতে ৬৫ পয়সা ধার করতে হচ্ছে) কিন্তু অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হারের (৭.৩%) হিসাবে চীন ছাড়া অন্য কোনো উন্নত বা উন্নয়নশীল দেশ ভারতকে ছুঁতে পারেনি। ঋণ এবং আয়ের অনুপাতের দিক থেকে এরকম কোনো ম্যাজিক নাম্বার নেই বলেই অধিকাংশ অর্থনীতিবিদ মনে করেন যা ছুঁয়ে গেলে বিপদ অবশ্যম্ভাবী। আই-এম-এফ এর ভূতপূর্ব রিসার্চ ডিরেক্টর কেনেথ রোগফের মতন হাতে গোনা যাঁরা বিপরীত মত পোষণ করেন তাঁরাও বলছেন অনুপাতটি উন্নত দেশের ক্ষেত্রে নব্বই এবং উন্নয়নশীল দেশের ক্ষেত্রে সত্তর ছুঁইছুঁই হলে তবেই একটা আশঙ্কা থেকে যায়। অবশ্য একটি দেশের ঋণের সিংহভাগটাই আসে বিদেশী সংস্থার থেকে যেটা পশ্চিমবঙ্গের মতন রাজ্যের জন্য প্রযোজ্য নয়। বিদেশী সংস্থা ঋণ দেওয়ার অর্থ দেশের অর্থনীতি নিয়ে তারা আশাবাদী এবং তাই ডলার, পাউন্ড বা ইয়েন আসতে সমস্যা হচ্ছে না। অবশ্য সব সময় যে কোনো এক সংস্থাই টাকা দেবে এরকম কোনো কথা নেই, অন্য দেশ বা অনাবাসী ভারতীয়রাও টাকা ধার দিতে পারেন। পশ্চিমবঙ্গের ঋণের খাতে কিন্তু চোখ বোলালে দেখা যাচ্ছে ওই দু লাখ চুরাশি হাজার কোটি টাকা ঋণের একাশি শতাংশ-ই এসেছে স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া, ন্যাবার্ড, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের মতন সংস্থার থেকে। এর সঙ্গে যদি কেন্দ্রীয় সরকারের দেওয়া ধারের পরিমাণটাও জোড়েন তাহলে দেখা যাবে অনুপাতটি ছিয়াশি শতাংশ ছুঁই ছুঁই অর্থাৎ ধারের অধিকাংশটাই অভ্যন্তরীণ। কিন্তু এ ঘটনা শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, সব রাজ্যের ক্ষেত্রেই সত্যি। ঋণের উৎসগুলি জানার পর স্বভাবতই প্রশ্ন উঠবে ঋণের বোঝা ঘাড়ে নিয়েও পশ্চিমবঙ্গ অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হিসাবে কিরকম করছে? রাজ্যভিত্তিক অর্থনৈতিক বৃদ্ধির তালিকা জানাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ সমস্ত রাজ্যগুলির মধ্যে বারো নম্বরে, বৃদ্ধির হার ৭.১৫%। মহারাষ্ট্র, কর্ণাটক, পাঞ্জাবের মতন বেশ কিছু তথাকথিত গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের থেকে পিছিয়েই আছে।

কিন্তু অর্থনৈতিক বৃদ্ধি আর উন্নয়ন সমার্থক নয়, আর তাই জন্যই শুধু ৭.১৫% সংখ্যাটি ধরে বসে থাকলে চলবে না। দেখা যাক উন্নয়নের খাতে বাকি রাজ্যগুলির তুলনায় পশ্চিমবঙ্গ কতটা বেশী বা কম খরচ করছে। ২০১৪ সালে রাজ্যগুলির সর্বমোট খরচের শতাংশের হিসাবে শিক্ষা এবং সংস্কৃতি খাতে পশ্চিমবঙ্গের স্থান মহারাষ্ট্র ও বিহারের পরেই। স্বাস্থ্যের খাতেও দেখা যাচ্ছে প্রথম পাঁচটি রাজ্যের মধ্যে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ। দুটি চিত্রই আশাব্যঞ্জক যদিও সংস্কৃতির খাতে কিছুটা কমিয়ে শিক্ষার খাতে খরচটা আরো বাড়ালে রাজ্যের মানুষ হয়ত অখুশি হবেন না। কিন্তু যে মুহূর্তে রাস্তা, সেতু বা বিদ্যুৎ সংক্রান্ত পরিকাঠামোর খরচের দিকে নজর পড়বে, বোঝা যাবে এই ভালো লাগাটা নেহাতই তাৎক্ষণিক। বিবেকানন্দ উড়ালপুল বা উল্টোডাঙ্গা উড়ালপুলের মতন দুর্ঘটনার পেছনে যে বেশ একটা কার্যকারণ সম্পর্ক আছে সেটা ঠাহর হয় রিজার্ভ ব্যাঙ্কের রিপোর্ট টি দেখলে। প্রধান সতেরোটি রাজ্যের মধ্যে রাস্তা বা সেতু খাতে সবথেকে কম খরচ করেছে পাঞ্জাব, আর তার পরেই রয়েছে আমাদের রাজ্য। রাস্তা, সেতু বা বিদ্যুৎকেন্দ্র বানানোর প্রারম্ভিক খরচটিই মাথা ঘুরিয়ে দেওয়ার মতন, আর তারপর তো ‘কস্ট ওভাররান’ অর্থাৎ সময়ের মধ্যে শেষ করতে না পারার গুনাগার আছেই। তাই এই ধরণের গুরুত্বপূর্ণ ভৌত পরিকাঠামোগুলি গড়ে তোলার জন্য দরকার বড় বিনিয়োগের। আর ঠিক সেই জায়গাটিতেই রাজ্য সরকার ব্যর্থ।

কিন্তু কেন?

রিজার্ভ ব্যাঙ্কের দেওয়া তথ্য নিয়ে কিছু মৌলিক বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে উন্নয়ন খাতে রাজ্য সরকার যা টাকা রাখতে পারত তার অনেকটাই চলে যাচ্ছে ওই অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ মেটাতে। একথাটা আমাদের কাছে নতুন নয়, তৃণমূলের নেতারা বেশ কয়েক বছর ধরেই এ নিয়ে অভিযোগ জানিয়ে আসছেন। কিন্তু অবস্থাটা যে কত খারাপ সেটা তথ্যগুলো না দেখলে বোঝা যায় না। গত আর্থিক বছরে প্রতি ১০০ টাকা রাজস্ব আদায়ের থেকে শুধুমাত্র সুদের খরচ মেটাতেই গেছে ২০ টাকারও বেশী। তার আগের দুই বছরে ওই সংখ্যাটি ছিল তেইশ থেকে পঁচিশের মধ্যে। পশ্চিমবঙ্গকে বাদ দিয়ে ভারতের অন্য রাজ্যগুলির গড় সুদের খরচ সেখানে মাত্রই ১০ টাকা। অর্থ দফতরের কর্তারা যা বলছেন তাতে মনে হয় না অদূর ভবিষ্যতে অন্য কোনো চিত্র দেখা যাবে। ব্যয় যেখানে বেড়েই চলেছে সেখানে অবস্থা সামাল দেওয়ার জন্য আয় বাড়াটাও জরুরী, কিন্তু সেখানেই বা আশার আলো কোথায় দেখা যাচ্ছে? এ বছরের ফেব্রুয়ারীতেই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, তৃণমূলের ঘরের লোক সুগত মারজিত ‘ইকোনমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলি’ তে প্রকাশিত এক প্রবন্ধে জানিয়েছেন রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের দুরবস্থা চোখে পড়ার মতন। যদিও সুগতবাবুর প্রবন্ধটি ২০১১-১২ আর্থিক বছরের তথ্যের ভিত্তিতে লেখা, কিন্তু শেষ তিন বছরে এমন কিছু গঠনমূলক পরিবর্তন এ রাজ্যে দেখা যায়নি যাতে সে প্রবন্ধের মূল সিদ্ধান্তগুলিকে উড়িয়ে দেওয়া যায়। সুগতবাবু এবং তাঁর সহ-লেখকদের বক্তব্য অনুযায়ী শিল্পায়ন প্রক্রিয়ায় বহু বছর ধরে পিছিয়ে থাকার জন্য শুল্ক আদায়ের জায়গাটিই সঙ্কুচিত হয়ে এসেছে। অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গের মানুষের মধ্যে সঞ্চয় করার প্রবণতাও অনেকটাই বেশী, ভোগ্যবস্তু তাঁরা কম কিনছেন বলে সেখানেও শুল্কের মাধ্যমে রাজস্ব বিশেষ আদায় করা যাচ্ছে না। কেন পশ্চিমবঙ্গের মানুষ খরচ কম করছেন সেটা এ প্রবন্ধ থেকে বোঝা না গেলেও ‘ন্যাশনাল স্যাম্পল সার্ভে’ তে চোখ বোলালে কিছুটা আন্দাজ করা যায়। ২০১৪ সালের প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের শহর এবং গ্রামে ভোগ্যবস্তুর পেছনে খরচের ব্যবধান একশ শতাংশেরও বেশী। পশ্চিমবঙ্গ ধনী রাজ্য নয়, এমনকি মাঝারি আয়ের বাকি রাজ্যগুলির তুলনাতেও বহু বছর ধরে আমরা ভালো ফল দেখাতে পারিনি কিন্তু তার পরেও অর্থনৈতিক বৈষম্যের এই তীব্রতা আমাদেরকে স্তম্ভিত করে তোলে। আর এই তীব্র অর্থনৈতিক বৈষম্যের জন্যই পশ্চিমবঙ্গের গ্রামের মানুষরা দীর্ঘদিন ধরে চিট ফান্ডগুলির শিকার হচ্ছেন। চাকরি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য সবেতেই শহরের তুলনায় গ্রামবাংলায় এতটাই দৈন্য যে মানুষগুলি প্রাণপাত করে সঞ্চয় করে চলেছেন একটা মিরাকলের আশায়। আর ওই যে ৭.১৫% হারে অর্থনৈতিক বৃদ্ধির কথা বলছিলাম সেটিও কিন্তু এই বৈষম্যের কথা বলে না। সংখ্যাটা একটা ওপর ওপর আশ্বাস দেয় বটে কিন্তু ওই পর্যন্তই।

ঋণের বোঝা আবশ্যিক ভাবে খারাপ নয় কিন্তু ঋণ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে উন্নয়নের ঘরে কিছুই জমা না পড়লে ঘোর দুর্দিন আসতে বাধ্য। পূর্ব এশিয়া বা দক্ষিণ আমেরিকার অর্থনৈতিক ইতিহাস দেখায় এই একই পরিস্থিতিতে একটি দেশ বা রাজ্যের আর্থসামাজিক স্থিতিটুকু নষ্ট হয়ে যায়, দেখা দেয় তুমুল রাজনৈতিক অস্থিরতা। পশ্চিমবঙ্গের অর্থনৈতিক গতিপ্রকৃতি দেখলে আশাবাদী হওয়ার বিশেষ কিছু থাকে না, তৃণমূলের আমলে যৎসামান্য উন্নতিটুকুও নেহাত জলের উপর নাকটুকু ভাসিয়ে রাখতে সাহায্য করেছে। বিদেশী বা দেশী বিনিয়োগ আনতে পারলে একটা কাজের কাজ হয় বটে কিন্তু সেক্ষেত্রে বর্তমান এবং ভূতপূর্ব সরকারদ্বয়ের ব্যর্থতার ইতিহাস কোনো বাঙ্গালীরই অজানা নয়। তাহলে করণীয় কি? ঋণ মকুব অবশ্যই একটি আপৎকালীন উপায়। মুখ্যমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী সহ তৃণমূলের সমস্ত নেতারা বারম্বার কেন্দ্রের কাছে আবেদন জানিয়েছেন ঋণ মকুবের জন্য, একে শুধু হতাশার প্রতিফলন হিসাবে দেখলে ভুল হবে। ওই যে শুরুতেই জানিয়েছিলাম পশ্চিমবঙ্গের ঋণের প্রায় ছিয়াশি শতাংশই অভ্যন্তরীণ ঋণ, তাই কেন্দ্রের পক্ষে ঋণ মকুব করা সত্যিই সম্ভব। ভুললে চলবে না যে শেষ তিন বছরে প্রায় সওয়া এক লাখ কোটির মতন কর্পোরেট ঋণ মকুব হয়েছে এই ভারতবর্ষেই। এই একটা জায়গায় সমস্ত রাজনৈতিক দলের এককাট্টা হওয়া উচিত। জাতীয় গড়ের থেকে দশ শতাংশেরও বেশী হারে যেখানে আমরা সুদ মেটাচ্ছি সেখানে অবান্তর রাজনৈতিক বিরোধিতা থাকা উচিত নয়। যে দলই ক্ষমতায় আসুক না কেন এ নিয়ে মতবিরোধের আদৌ সুযোগ আছে কি? কিন্তু ঋণ মকুব নেহাতই ঘুরে দাঁড়ানোর প্রারম্ভিক স্ট্র্যাটেজি মাত্র, ঘুরে দাঁড়ানোটা বাস্তবায়িত করতে গেলে দরকার আশু অর্থনৈতিক সংস্কারের। সেই সংস্কার কিভাবে আসতে পারে সে নিয়ে বিশেষ আলোকপাত বিদায়ী সরকার করতে পারেননি। আগামী সরকারও তো সেই proverbial নতুন বোতলে পুরনো মদ, সুতরাং সেই এক লোকেরাই আচম্বিতে দিশা দেখাবেন এটা আমি অন্তত ভাবতে পারছি না।

কিন্তু মূল সমস্যা অন্য জায়গায়। অর্থনৈতিক বাস্তবকে সবার সামনে আনতে গেলে বামফ্রন্টকে তাঁদের ব্যর্থতার দায় স্বীকার করতেই হবে। ২০১৬-র নির্বাচনী প্রচার থেকে এটা স্পষ্ট হয়ে গেছে যে সেরকম কোনো ইচ্ছাই তাঁদের ছিল না, হয়ত ভবিষ্যৎ-এও হবে না। জোটসঙ্গী হিসাবে কংগ্রেসকেও বাধ্য হয়ে একই রাস্তা নিতে হয়েছে। বাকি থাকে বিজেপি, তাঁরা নরেন্দ্র মোদীকে জগৎভূষণ, বিপত্তারণ রূপে দেখাতেই এমন ব্যস্ত যে পশ্চিমবঙ্গের নির্দিষ্ট সমস্যাগুলো নিয়ে মাথা ঘামানোর সুযোগই পান নি।

পরের পাঁচ বছরে বামফ্রন্ট, কংগ্রেস কি বিজেপির রাজনৈতিক স্ট্র্যাটেজী কি হবে তা আমি জানি না। এও জানি না যে তৃণমূলের নেতৃবৃন্দ কি লং টার্ম প্ল্যানিং এর কথা ভাববেন। শুধু এইটুকু বলতে পারি যে এটাই যদি পশ্চিমবঙ্গের ‘স্টেডি স্টেট ইকুইলিব্রিয়াম’ হয়ে থাকে তাহলে নতুন কোনো রাজনৈতিক শক্তির উঠে আসার জমি কিন্তু প্রস্তুত। রামচন্দ্রন, রামারাও বা কেজরিওয়ালের মতন কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব উঠে আসবেন কিনা, উঠে এলেও কর্পোরেট অর্থশক্তি ছাড়া দাঁড়াতে পারবেন কিনা, অর্থের সুরাহা হলেও মমতার মতন টেনাসিটি দেখাতে পারবেন কিনা সেসব প্রশ্নের উত্তর এখনই মিলবে না কিন্তু আঞ্চলিক রাজনৈতিক শক্তির ভারতীয় ইতিহাসটিকে দেখলে এহেন ভবিষ্যৎকে আষাঢ়ে গল্প বলে হয়ত উড়িয়ে দেওয়া যাবে না।

ফিদেল, বারাক এবং বর্ণবাদের উত্তরাধিকার

Fidel-Castro-vs-Barack-Obama

অশোক মিত্র সম্পাদিত ‘আরেক রকম’ পত্রিকায় সম্প্রতি একটি প্রবন্ধ লিখেছিলাম, মার্কিন রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামার ঐতিহাসিক হাভানা সফর উপলক্ষ্যে। বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ, আরো আলোচনার অবকাশ রাখে, সেই ভেবেই ব্লগে তুলে দিলাম লেখাটি। সাড়ে বত্রিশ ভাজার পাঠকদের মতামত এবং আলোচনা পেলে বড়ই ভালো লাগবে। ধন্যবাদ প্রাপ্য বন্ধু এবং আনন্দবাজার পত্রিকার  সাংবাদিক অমিতাভ গুপ্তকে, ওর উৎসাহ ছাড়া লেখাটি হয়ত আদৌ লিখে উঠতে পারতাম না । আরেক বন্ধু, অর্থনীতিবিদ শুভনীল চৌধুরীকেও ধন্যবাদ লেখাটি সযত্নে স্ক্যান করে পাঠানোর জন্য।

(ফিদেল কাস্ত্রো এবং বারাক ওবামার স্থিরচিত্র উৎস – Google images)

1

2

3

ইস্তাহারের প্রহসন, প্রহসনের ইস্তাহার

Cong-left_2767317f

‘The writing on the wall’

বাক্যবন্ধটি নেহাতই বাগধারা তবে দেওয়াল লিখন দেখে কখনো সখনো ভবিষ্যৎ সম্পর্কে একটা আঁচ পাওয়া যায় বটে। ‘বন্দে ইনকিলাব’ হলেও একটা কথা ছিল, ‘মাতরম জিন্দাবাদ’ বললেও একটা ছাড় দেওয়া যেতে পারত কিন্তু ‘ইনক্লাব মাতারম’ (বিপ্লবী মা? মা-কে নিয়ে বিপ্লব? কেই বা জানে!) দেখলে মনে হয় যে অশিক্ষার রাজনীতি বহু বছর ধরে বাংলাকে ভেতরফোঁপরা করে ছেড়ে দিয়েছে তার থেকে আরো বহু যুগ আমাদের মুক্তি নেই, সামনের দিনগুলোয় রাজনৈতিক পরিবর্তন হোক কি না হোক। তবে সে আঁধারের গভীরতাকে ঠাহর করতে গেলে দেওয়াল লিখন ছেড়ে ছাপার অক্ষরে একবার চোখ বোলানো দরকার।

ভোট‘যুদ্ধ’ শুরু হওয়ার কিছুদিন আগে থেকেই পশ্চিমবঙ্গের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলির ইস্তাহার খুঁটিয়ে দেখছিলাম। বাংলার ভবিষ্যৎ নিয়ে দলগুলির বিশেষ তাপউত্তাপ ছিল এমন অপবাদ কেউ দেবেন না, তবে এই ইস্তেহারগুলির ছত্রে ছত্রে যে পরিমাণ আলস্য, প্রতারণা এবং অবান্তর বাক্যালাপ ঝরে পড়ছে তাতে মনে হওয়া স্বাভাবিক যে নেতারা ধরেই নিয়েছেন ‘লো লেভেল ইকুইলিব্রিয়াম ট্র্যাপ’ থেকে বেরোনোর কোনো রাস্তাই নেই। “কর্মসংস্থানের মূল লক্ষ্যে ছোট এবং মাঝারি শিল্পের ওপর গুরুত্ব বজায় থাকবে। বৃহৎ শিল্প গড়ারও চেষ্টা করা হবে”। এমনভাবেই শুরু হচ্ছে সিপি(আই)এম এর নির্বাচনী ইস্তাহারের শিল্পসংস্থান অনুচ্ছেদটি। টোনটা লক্ষ্য করুন, ‘বৃহৎ শিল্প গড়ারও চেষ্টা করা হবে’! একে নিছক সান্ত্বনাপ্রদান বলবেন নাকি সর্বহারার বাস্তববোধ? ষোল পাতার ইস্তাহারের প্রায় প্রতিটি লাইনের শেষে অবধারিত ভাবে থাকছে দুটি শব্দ – ‘হবে’ অথবা ‘হবে না’। কি ভাবে হবে, কেনই বা হবে না, কে হওয়াবে সেসব নিয়ে একটা শব্দও খরচ করেন নি এনারা। বাংলার অর্থনীতিবিদরা ‘ইকোনমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলি’তে লিখে লিখে হদ্দ হয়ে গেলেন যে রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ প্রভূত পিছিয়ে, বাম আমলের তুলনায় তৃণমূলের আমলে আদায় সামান্য বেড়েছে বলে জলের উপরে নাকটুকু কোনোমতে ভাসিয়ে রেখেছি মাত্র। সেই রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি নিয়ে কি ভাবছেন লেফট ফ্রন্ট? কোনো উত্তর নেই। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সর্বশেষ রিপোর্ট অনুযায়ী বিদ্যুৎ পরিকাঠামোর দিক থেকে সতেরোটি প্রধান রাজ্যের মধ্যে আমরা আছি ষোল নম্বরে। অসীম দাশগুপ্ত, নিরুপম সেনের উত্তরাধিকারীরা এ তথ্য আদৌ জানেন কিনা বোঝা গেল না কারণ বিদ্যুৎ পরিকাঠামো কি ভাবে গড়ে উঠবে সে নিয়ে এক সেকন্ডও বাজে খরচ করেন নি তাঁরা, সোজা লিখে দিয়েছেন ‘বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য পরিকল্পিত উদ্যোগে গ্রহণ করা হবে’। মুদ্রণপ্রমাদ টা নজর করবেন, ‘উদ্যোগ’ নয় ‘উদ্যোগে’! খসড়াটা তৈরী হওয়ার পর কেউ যে একবার পড়েও দেখেন নি সেটা বেশ বোঝা গেল।

শিক্ষা প্রসঙ্গে লেখা হয়েছে, ‘শিক্ষায় বেসরকারিকরণ, বাণিজ্যিকীকরণ এবং সাম্প্রদায়িককরণ বন্ধ করা হবে’। ভালো কথা কিন্তু মহারাষ্ট্র বা কর্ণাটকের ৩০০০ এর বেশী কলেজের সঙ্গে আমরা চারশ একুশটি সরকারী কলেজ নিয়ে (২০১৪-র হিসাব অনুযায়ী) কি ভাবে পাল্লা দেব সে নিয়ে কোনো হদিশ নেই।অন্য রাজ্যের অধিকাংশ কলেজেও শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন ওঠে কিন্তু নেই মামার থেকে কানা মামা যে কতটা বেশী গ্রহণযোগ্য সে নিয়ে আর নতুন করে কিছু বলার থাকে না। বেসরকারী কলেজ না থাকার কস্ট-বেনিফিট নিয়ে আলোচনাটুকু তো অন্তত শুনতে চাইবেন আপনি, তাই না? কাকস্য পরিবেদনা! নন্দীগ্রাম এবং সিঙ্গুরের ভূত যে আরো বহুদিন বামেদের তাড়া করে বেড়াবে তা ইস্তাহারে একবার চোখ বোঝালেই টের পাওয়া যায়, ‘শিল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণের বিষয়টি সম্পর্কে সতর্ক পদক্ষেপ নেওয়া হবে’। এহেন বালখিল্য কথার বাইরে প্রাপ্তি শূন্য। সরকারের ভূমিকাটা ঠিক কি হবে? মধ্যস্থতাকারীর নাকি ক্রেতার? LARR (Right to fair compensation and transparency in land acquisition, rehabilitation and resettlement act) নামক জাতীয় জমি অধিগ্রহণ নীতির সঙ্গে কতটা সাযুজ্য বা সামঞ্জস্য থাকবে রাজ্য সরকারের নীতির? শুধুমাত্র বেসরকারী প্রকল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণের নীতিই বা কি হওয়া উচিত? কোনো প্রশ্নেরই উত্তর তো পাবেনই না উল্টে মনে হওয়া বাধ্য যে অর্থনৈতিক ভাবে আগের ভুলত্রুটি থেকে কোনো শিক্ষাই এরা নেন নি।

বামেদের মতন চরম ঔদাসীন্য কিন্তু ঘাসফুলের মালীরা দেখাননি। যেটুকু ক্রেডিট তাঁদের প্রাপ্য তা অবশ্যই দিতে হবে। সিপি(আই)এম এর ষোল পাতার জায়গায় তৃণমূলের একশ বিয়াল্লিশ পাতার ইস্তাহার – সেখানে যথেষ্ট তথ্য আছে, ‘কমপেয়ার অ্যান্ড কনট্রাস্ট’ আছে, কি কি প্রতিশ্রুতি পূরণ করা হয়েছে তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা আছে। স্পষ্টতই তৃণমূলের ইস্তাহারটি যারা বানিয়েছেন তাঁরা বামেদের তুলনায় অনেক বেশী খেটেছেন। সমস্যা হল সেসব তথ্য বহুলাংশে অসম্পূর্ণ। তৃণমূলের ইস্তাহারের প্রতিটি চিত্রলেখে দু’টি করে স্তম্ভ – ২০১১’র শেষে মা কি ছিলেন আর ২০১৫’র শেষে মা কি হয়েছে। অথচ তুলনাটা হওয়া উচিত ২০১১’র শেষে বাকি রাজ্যগুলির তুলনায় আমরা কোথায় ছিলাম আর ২০১৫’র শেষে তাদের তুলনাতেই আমরা কোথায় আছি। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক – তৃণমূলের ইস্তাহারের একচল্লিশ নম্বর পাতায় দেখানো হচ্ছে ২০১১-তে যেখানে রাজ্যের উচ্চশিক্ষাক্ষেত্রে gross enrolment ratio ছিল ১২.৬% সেটাই ২০১৫-র শেষে বেড়ে হয়েছে ১৭.৫%। তাহলে ব্রাউনি পয়েন্টস দিই? সেখানেই যে গন্ডগোল। ২০১১তে ৩৫টি রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের মধ্যে gross enrolment ratio-র হিসাবে পশ্চিমবঙ্গের স্থান ছিল সাতাশ, আর ২০১৫ র শেষে সেটা দাঁড়িয়েছে ছাব্বিশ। সুতরাং পাঁচ বছরে বাকি ভারতের তুলনায় আমাদের উন্নতি বলতে গেলে ইতরবিশেষ, সংখ্যাতত্ত্বের পরিভাষায় যাকে হাইপথেসিস টেস্টিং বলে তার নিরিখে হয়ত আদৌ কোনো পরিবর্তনই ঘটেনি। আরো একটা তথ্য দেওয়া যাক যেটা তৃণমূলের ইস্তাহারে পাবেন না – প্রতি এক লাখ মানুষের জন্য ২০১১ সালে আমাদের ছিল ৮ টি কলেজ, ২০১৫ তে হয়েছে ৯টি; পাঁচ বছর আগেও আমাদের র‍্যাঙ্ক ছিল ৩২/৩৫, এখন ৩৩/৩৬।

আবার ধরুন বত্রিশের পাতায় দেখা যাচ্ছে ২০১১ সালে যেখানে বামফ্রন্ট সরকার মাত্র ১০৪০ কোটি টাকা খরচ করেছিলেন স্বাস্থ্য পরিষেবায়, তৃণমূলের আমলে চার বছরে সেটাই বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫১৫৯ কোটি টাকা। খুশী হবেন কি? প্লীজ না। যে মাপকাঠিতে দেখা উচিত সেটা হল রাজ্যের মোট বাজেটের কত শতাংশ আমরা স্বাস্থ্যের জন্য খরচ করছি? ২০১১-র শেষে সংখ্যাটা ছিল ৭.১৪%, ২০১৫তে সেটা দাঁড়িয়েছে ৫.২%। পাঁচ বছর আগে আমরা শতাংশের এই হিসাবে সারা ভারতের মধ্যে ছিলাম পাঁচ নম্বরে, এখন পিছিয়ে হয়েছি সাত (নতুন রাজ্য তেলেঙ্গানাকে না ধরেই)। প্রধান বিরোধী দল হিসাবে হয়ত ভাববেন বামফ্রন্ট এইখানে জোর চেপে ধরবে শাসক দলকে। সে গুড়ে বালি, ষোল পাতায় কোনোরকমে দায় মেটাতে হলে যা হয় তাই হয়েছে। কিছু অতীব সুপারফিসিয়াল কথা ছাড়া বামেদের স্বাস্থ্য সংক্রান্ত ইস্তাহারে ভাবিয়ে তোলার মতন একটা কথা পাবেন না – ‘নিষিদ্ধ ওষুধ বিক্রয় বন্ধ করতে হবে’, ‘সরকারি চিকিৎসকদের হয়রানি বন্ধ করা হবে’, ‘ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণ করা হবে’ ইত্যাদি ইত্যাদি…সেই একঘেয়ে ‘হবে’, ‘হবে’, ‘হবে’ অর্থাৎ কিচ্ছুটি হবে না।

জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় দেখেছিলাম ছাত্রনির্বাচনে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী জনৈক জাঠ ছাত্র ঘোষণা করেছিল তাকে নির্বাচিত করলেই প্রত্যেকটি হোস্টেল নিজস্ব সুইমিং পুল পাবে। বিজেপির নির্বাচনী ইস্তাহার দেখে ছোকরাটির কথা মনে পড়ে গেল। কেন্দ্রের বিজেপি সরকার যেখানে পশ্চিমবঙ্গের তিন লাখ কোটি টাকা ঋণের একটা নয়াও মকুব করছে না সেখানে রাজ্য নেতৃত্ব দাবী করছেন সমস্ত সরকারী হাসপাতালে অন্ততপক্ষে কুড়ি শতাংশ বেড বাড়ানো হবে, সঙ্গে থাকবে অত্যাধুনিক চিকিৎসাসামগ্রী। কে দেবে এই টাকা? গৌতম আদানি? তা না হলে মুশকিল আছে কারণ রাজস্ব আদায় কিভাবে বাড়বে সেই প্রসঙ্গে দিলীপ ঘোষ জানিয়েছেন, “we propose better tax compliance”। ব্রিলিয়ান্ট! স্বপ্নে পোলাও খেলে বেশী ঘি দিয়ে খাওয়াটাই দস্তুর, সুতরাং আরো জানিয়েছেন দু’বছরের মধ্যে রাজ্য কর্মচারীদের কেন্দ্রের সমতুল্য মহার্ঘ ভাতা দেওয়া হবে, মাইনে এবং পেনশন বাড়ানো হবে, রাজ্য জুড়ে তৈরী হবে নতুন নতুন রাস্তা এবং বিদ্যুৎকেন্দ্র, পঞ্চাশ শতাংশ বেশী পুলিশ থানা বসবে, রাজ্য জুড়ে কোল্ডস্টোরেজের ধারণ ক্ষমতা দ্বিগুণ করে ফেলা হবে, প্রত্যেক কন্যাসন্তানের জন্য পঞ্চাশ হাজার টাকার ফিক্সড ডেপোজিট রাখা হবে, প্রাইমারি স্কুলের সমস্ত ছাত্রছাত্রীদের বিনামূল্যে বই – পোষাক এবং জুতো দেওয়া হবে, ক্লাস টুয়েলভের পরীক্ষায় আশি শতাংশ মার্কস পেলেই পাওয়া যাবে বিনামূল্যের ল্যাপটপ…আরো কত কি! স্বয়ং মধুসূদন দাদাও দু’বার ভাবতেন এহেন প্রতিশ্রুতির বন্যা বইয়ে দেওয়ার আগে। এর সঙ্গে সঙ্গে আরো জানানো হচ্ছে যে বিদ্যুৎশুল্ক কমানো হবে, সার্বিক ভাবেই শুল্ক মাসুলের ক্ষেত্রে বন্ধুত্বপূর্ণ নীতি গ্রহণ করা হবে। অর্থাৎ আয় কি ভাবে হবে তা নিয়ে সম্যক কোনো ধারণাই নেই, এদিকে ব্যয়ের ক্ষেত্রে রীতিমতন পঞ্চবর্ষীয় পরিকল্পনা। এই ইস্তাহার নিয়ে বিজেপির অন্তত তিন লাখ কোটি দেনার ব্যাপারে মুখ খোলা উচিত নয় কারণ জাদুবলে যদি এই সব কিছু বাস্তবায়িত হয়ও রাজ্যের ঋণ অনায়াসে আরো তিন লাখ কোটি ছুঁয়ে যেতে পারে।

ইস্তাহারেই যেখানে এত অবহেলা, আসল সময়ে আরো কত দুর্দশা অপেক্ষা করছে কে জানে। দোষ তো আমাদেরও, সারদা – নারদ – নন্দীগ্রাম – কানহাইয়া কুমার – মুনমুন সেন – চাষার ব্যাটা এবং আরো হাজারখানা ফাঁড়া কাটিয়ে আজও জিজ্ঞাসা করে উঠতে পারছি না আলোচনাটা কবে হবে?

(স্থিরচিত্র – অশোক চক্রবর্তী, ‘The Hindu’)

দেবাশীষ দেবের আশ্চর্য জগত

২০১৬-র কলকাতা বইমেলায় কিঞ্জল পত্রিকা বার করলেন দেবাশীষ দেব সংখ্যা। চিত্রশিল্পী দেবাশীষ দেবের কাজ খুব কম বাঙ্গালীই হয়ত দেখেননি, আনন্দমেলা এবং দেশের যাঁরা নিয়মিত পাঠক তাঁরা আবার বিশেষ ভাবে পরিচিত ওনার কাজের সঙ্গে। দেবাশীষ দার গুণগ্রাহী আমি বহু বছর ধরে, তাই কিঞ্জলের সম্পাদক চন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের যখন লেখা চেয়ে পাঠালেন তখন সম্মানিত বোধ করেছি।

‘সাড়ে বত্রিশ ভাজা’র পাঠকদের জন্য সে লেখা তুলে দিলাম, তবে যাঁরা শিল্পী এবং মানুষ দেবাশীষ দেবকে আরো খুঁটিয়ে জানতে চান তাঁদের সংগ্রহে কিঞ্জলের এই বিশেষ সংখ্যাটি অবশ্যই থাকা উচিত।

ফেলুদা ও গেম থিয়োরী – পর্ব ১

মূল লেখায় যাওয়ার আগে জানাই যে এই পোস্টটি সাড়ে বত্রিশ ভাজা ব্লগে প্রকাশিত একশোতম ব্লগ। তিন বছর ধরে যে সব চেনা ও অচেনা বন্ধুরা পোস্টের পর পোস্ট পড়ে উৎসাহ দিয়ে এসেছেন তাঁদেরকে জানাই অকুন্ঠ ধন্যবাদ। আশা করি এ বছরে আরো নিয়মিত লিখতে পারব আপনাদের জন্য।

Laurel_100_1

১৩৭২ বঙ্গাব্দের অগ্রহায়ণ – পৌষ – মাঘ সংখ্যার সন্দেশে বেরিয়েছিল সত্যজিৎ রায়ের গল্প ‘ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি’, উৎসাহী বাঙ্গালী পাঠক মাত্রেই জানেন যে সেই প্রথম ফেলুদার আবির্ভাব। আর শুধু কি তিনি এলেন, অফ কোর্স  তাঁর স্রষ্টার মতনই এলেন, দেখলেন এবং জয় করলেন। বাঙ্গালী সালের হিসাবে এ বছরে তাই ফেলুদার আবির্ভাবের পঞ্চাশ বছর পূর্তি আর সেই উপলক্ষ্যে সাড়ে বত্রিশ ভাজায় ফেলুদাকে নিয়ে একাধিক লেখার পরিকল্পনা রইল। আজকে সেই সিরিজের প্রথম লেখা (ফেলুদা এবং গেম থিয়োরী নিয়ে আরো লেখা আসবে বটে তবে সিরিজটি শুধুই গেম থিয়োরী নিয়ে নয়) ।

এই ব্লগে এর আগে গেম থিয়োরী নিয়ে কিছু লেখা লিখেছি, মনে না পড়লে এখানে সেখানে দেখতে পারেন। গেম থিয়োরী চিন্তাবিদ মানুষের বিষয়,  একজন বুদ্ধিমান মানুষ একটি বিশেষ পরিস্থিতিতে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীদের সামলাতে কি সিদ্ধান্ত নেবেন সেই নিয়ে বিশ্লেষণের দরজা খুলে দেয়  গেম থিয়োরী। এই প্রতিদ্বন্দ্বী কে হতে পারেন? আপনার ব্যবসায় আর যাঁরা ভাগ বসাতে চাইছেন, আপনার প্রেমিকার দিকে অন্য যে মানুষটি নজর দিচ্ছেন, আপনার প্রোমোশনের পথে আপনার যে সহকর্মী জোর টক্কর দিচ্ছেন……বা বা…আপনার বাদশাহী আংটি টি যিনি মেরে দেওয়ার তাল করছেন, এঁরা সবাই। আপনার অভীষ্টসিদ্ধির জন্য আপনি যেমন কিছু স্ট্র্যাটেজি ঠিক করে রেখেছেন এনাদের কাছেও সেরকম স্ট্র্যাটেজির কমতি নেই, এই স্ট্র্যাটেজি – পাল্টা স্ট্র্যাটেজির লড়াইটা বুঝে আপনি (এবং আপনার প্রতিদ্বন্দ্বীও) কোন পথ বাছবেন সেটাই হল লাখ টাকার প্রশ্ন। এই ধরুন, আপনি একজন সম্মানীয় জননেতা, সক্কাল সক্কাল খবর পেলেন এক দক্ষিণ ভারতীয় সি-ই-ও  আপনার অ্যাপয়েন্টমেন্ট চেয়েছেন। সুখবরই বলা যায়, এরকম অ্যাপয়েন্টমেন্টের অর্থ কম করে পাঁচটি লাখ। বাসি মুখে কড়কড়ে পাঁচ লাখ টাকা পাওয়া মুখের কথা নয় (আপনার কলীগরা যতই বলুক না কেন পাঁচ লাখ বাচ্চা ছেলের হাতের ময়লা), কিন্তু সকালের মিঠে রোদ হেসে উঠতে গিয়েও ঝিমিয়ে গেল।  সাবকনশাসে গুনগুনানি শুরু হয়েছে ”বঙ্গারু লক্ষ্মণ, জর্জ ফার্নান্ডেজ”। কি করবেন আপনি? এদিকে যে সি-ই-ও আপনার সময় চেয়েছেন তাঁর মনেও ভালোই সংশয়, সোজাসাপটা তোয়ালে জড়িয়ে পাঁচ লাখ ফেলে দিলেই ল্যাঠা চুকে যাবে তা তো নাও হতে পারে। যদি জননেতাটি ভোটের ঠিক আগে এরকম রিস্ক না নিতে চান, তাহলে আবার সি-ই-ও কেই ঘুষ দেওয়ার দায়ে জেলে যেতে হবে না তো? তাঁরই বা করণীয় কি? আর ভদ্রলোকের যদি ছদ্মবেশী সাংবাদিক হওয়ার একটুও চান্স থাকে তাহলে তো আরোই চিত্তির, সাংবাদিকের আবার অন্য স্ট্র্যাটেজি সেট – ক্যামেরা বার করব না করব না? ধরা পড়লে তো প্রহারেণ ধনঞ্জয়, মানহানির মামলাও হতে পারে আবার ক্যামেরা ছাড়া টাকাটাই বেবাক গাপ হয়ে যাবে।

বুদ্ধিমানের মতন সিদ্ধান্ত নিতে গেলে প্রথমে দেখতে হবে কতটা ইনফরমেশন আছে আপনার কাছে, প্রতিটি ক্ষেত্রে আপনার পাওনাগন্ডা কি থাকবে  (মানে পাঁচ  লাখ টাকা  নাকি পাঁচ বছরের জেল নাকি হাতে রইল পেন্সিল এবং সম্মান) সেটা  জানারও আশু প্রয়োজন। তারপর দেখতে হবে আপনার প্রতিদ্বন্দ্বীর প্রতিটি স্ট্র্যাটেজির জন্য আপনার অপটিম্যাল স্ট্র্যাটেজিটি কি,  আবার আপনার সেই সব অপটিম্যাল স্ট্র্যাটেজির মধ্যে কোনটা সব থেকে বেশী ইউটিলিটি দিচ্ছে ইত্যাদি ইত্যাদি।

সমস্যা বলে সমস্যা।

কিন্তু সে সমস্যা শুধু রক্তমাংসের মানুষদেরই হবে এ কথা ভাবাটা বড় অন্যায়। গোয়েন্দাগল্পের চরিত্রদের তো সব থেকে বেশী করে এই স্ট্র্যাটেজি – প্রতিস্ট্র্যাটেজির খেলায় মেতে থাকা উচিত।

‘বাদশাহী আংটি’র বনবিহারীবাবুর কথাই ধরুন। ফেলু মিত্তিরের কাছে আংটি টা আছে জেনে নেওয়ার পর তাঁর কাছে দুটো রাস্তা খোলা ছিল – সামনাসামনি ফেলুকে কাউন্টার করা যাতে নিজের ব্যক্তিত্ব খাটিয়ে জবরদস্ত ভয় দেখানো যায় অথবা আত্মপ্রকাশ না করে গুন্ডা ভাড়া করে কিডন্যাপ করানো। ফেলুদারই বা কি কি অপশনস ছিল? বনবিহারীই যে পিয়ারিলালকে মাকড়সার ভয় দেখিয়ে মেরেছেন সেটা বোঝার পরে সবার সামনে তাঁকে চেপে ধরা অথবা অপেক্ষা করা কখন বনবিহারী নিজে থেকে ফেলু মিত্তিরের সামনে আসবেন। সবার সামনে চেপে ধরার মুশকিল হল যথেষ্ট সাক্ষ্যপ্রমাণ পেশ করা যাবে না আবার বনবিহারী নিজে থেকে উদয় হলে প্রাণ নিয়েই টানাটানি হতে পারে। ইন ফ্যাক্ট, ক্লাইম্যাক্সটা খেয়াল করুন – ভাগ্যে মহাবীর সঙ্গে ছিল এবং ছিল তার রিভলভারের অব্যর্থ টিপ, এর কোনোটাই না থাকলে কি হত ভাবুন। যাক গে, মূল কথাটা হল এখানে গেমটা ঠিক কি? নিচের ছবিটা একবার দেখা যাক।

BA

যেহেতু ব্ল্যাক উইডো স্পাইডারের থিয়োরীটি ব্রিলিয়ান্ট হলেও স্পেকুলেটিভ মাত্র, এ কথা ধরে নেওয়া যেতেই পারে যে ফেলু মিত্তির সবার সামনে বনবিহারীর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনলে তিনি সেটা সঙ্গে সঙ্গেই অস্বীকার করতেন। যেহেতু বনবিহারীর স্বীকারোক্তি ছাড়া এখানে গতি নেই তাই ফেলুদার পক্ষে বনবিহারীর চালের জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া গতি নেই, ঠিক যেরকমটি গল্পে ঘটেছে। বনবিহারীর কি করা উচিত ছিল সেটা বুঝতে গেলে আমাদের জানা দরকার একদম শেষে ফেলুর স্ট্র্যাটেজি কি হতে পারত। ভাড়াটে গুন্ডা লাগালে খুনের অভিযোগ আনাটা কষ্টসাধ্য ব্যাপার কারণ কে ভাড়াটে গুন্ডা লাগিয়েছে সেটা জানা সম্ভব নয়। সুতরাং, এ ক্ষেত্রে হয়ত নিজের প্রাণের কথা না ভাবলেও তোপসের কথা ভেবে ফেলুর আংটি ফিরিয়ে দেওয়া ছাড়া গতি নেই। কিন্তু বনবিহারী যদি আত্মপ্রকাশই করেন তাহলে কি করা উচিত? ইনি যখন ভিলেনি দেখাচ্ছেন তখন ফেলু মিত্তির খুনে কথা না তুলে কি পারেন? সমস্যা হল খুনের অভিযোগটি এনে ফেললে ফেলু এবং তোপসের জীবন বিপন্ন হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশী। কিন্তু   উল্টোদিকে আংটি ফিরিয়ে দেওয়া মানে আইনের চোখে বনবিহারীকে আর অপরাধী সাব্যস্ত করা যাবে না। সুতরাং, ফেলু মিত্তিরের হয়ত খুনের অভিযোগ আনা ছাড়া গতি ছিল না। তার মানে দাঁড়াচ্ছে এই যে, গেমের দ্বিতীয় স্টেজে বনবিহারীর আত্মপ্রকাশ করাটা হয়ত বা যুক্তিযুক্ত কাজ হয় নি।

কিন্তু তাই কি?

ভুলে গেলে চলবে না যে পিয়ারিলালের খুনের ব্যাপারটি যে ফের মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে সে ব্যাপারটি বনবিহারী ভাবতেই পারেন নি। অর্থাৎ, তাঁর কাছে আমাদের গেমের ব্যাপারে অসম্পূর্ণ  তথ্য রয়েছে। তাই বনবিহারী যখন এই গেম নিয়ে ভেবেছেন তখন গেমের তৃতীয় স্টেজে ফেলু মিত্তিরের দুটো অপশনের বদলে একটিই মাত্র চোখে পড়েছে। আর ফলত উনি ভেবেছেন যাই স্ট্র্যাটেজি উনি নিন না কেন, ফলাফলের হেরফের হবে না।

সম্পূর্ণ গেমটি বনবিহারী বুঝতে পারেননি সেটা ধরলে বলতেই হয় যে অপরাধীর বৌদ্ধিক ব্যর্থতা একটা আছেই  কিন্তু যে গেম ধরে উনি এগোচ্ছিলেন তার হিসাবে হয়ত ্খুব বোকার মতন খেলাটা খেলেননি।

1
সব গল্পেই যে স্ট্র্যাটেজির ঘনঘটা তা কিন্তু নয়, এক্ষেত্রে খুব ভালো উদাহরণ হতে পারে ‘ঘুরঘুটিয়ার ঘটনা’। ফেলুদার ওপর দায়িত্ব পড়েছিল ‘ত্রিনয়ন ও ত্রিনয়ন একটু জিরো’ কোডটির ডিকোডিকরণের, ফেলু মিত্তির সেটাই করে যায়। কোডটি বুঝতে পারলেও অপর প্রোটাগনিস্টকে তা বলা হবে কি হবে না সে নিয়ে কোনো দ্বিধা বা ট্রেড-অফ এর চিহ্নই দেখতে পাওয়া যায় না এ গল্পে। রাস্তায় বেরিয়ে অন্য গাড়ির টায়ারের ছাপ দেখতে না পেয়ে ফেলুদার সন্দেহ হয়; গল্পের শেষে অপরাধী ধরা পড়েছে বটে কিন্তু না ধরা পড়লেও কিছু বলার ছিল না। লজিক্যালি ভাবলে বলাই চলে এ গল্পে অপরাধীর ধরা পড়াটা নেহাতই কাকতালীয়।

টিনটিনের গল্পের মতনই ফেলুদার একাধিক গল্পেও নিয়তির সহায় কিন্তু বড় ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়িয়েছে। সে নিয়ে বিশদ আলোচনায় পরে যাব, এখন ফিরে যাই গেম থিয়োরীতে।

‘সোনার কেল্লা’কে পুরোদস্তুর গোয়েন্দা গল্প বললে হয়ত একটা বিতর্কের সূত্রপাত হতে পারে কারণ এ উপন্যাসে অ্যাডভেঞ্চার রসেরও কমতি নেই। ‘সোনার কেল্লা’  বইয়ের দুখানি  টার্নিং পয়েন্ট – প্রথমটি হল যোধপুরে্র দোকানে সোনার পাথরবাটি খুঁজে পাওয়া, যে বাটি দেখে ফেলুদা প্রথমবারের জন্য জয়সলমীরের কথা ভাবতে শুরু করে আর দ্বিতীয়টি হল হাজরার ইংলিশ বানানে ‘j’ র বদলে ‘z’ দেখতে পাওয়া। সোনার কেল্লা বইতে (সিনেমায় নয়) যে ক্রমানুসারে ঘটনা ঘটেছে তা থেকে আমরা জানি যে হাজরার সই নিয়ে ফেলুদা ভাবতে শুরু করে মন্দার বোসের সঙ্গে রাতের ট্রেনে মোলাকাত হওয়ার পর। অর্থাৎ মন্দার বোস আক্রমণ না করলে হয়ত তখন এই ডক্টর হাজরা যে সেই ডক্টর হাজরা নন তা নিয়ে ফেলুদার ভাবার অবকাশ থাকত না। বইতে এটাও দেখা যাচ্ছে যে ফেলুদা যোধপুরে থাকাকালীন অন্তত ডক্টর হাজরার সঙ্গে জয়সলমীর নিয়ে কোনো আলোচনা করেনি। ডক্টর হাজরা ওরফে ভবানন্দ ফেলুদার জয়সলমীর যাওয়ার প্ল্যানের কথা জানতে পারে সম্ভবত মন্দার বোসে কাছ থেকেই, কারণ ফেলুদা সার্কিট হাউস ছাড়ার আগে মন্দার বোসকে বলছে, “একটু থর মরুভূমিটা দেখার ইচ্ছে আছে”।

সুতরাং, দুটো প্রশ্ন উঠে আসে – ১) ফেলুদাকে না জানিয়ে তড়িঘড়ি করে ডক্টর হাজরার বেরিয়ে যাওয়াটা কতটা যুক্তিযুক্ত? আর ২) মন্দার বোস রাত্রের ট্রেনে ফেলুদাদের আক্রমণ না করলে কি হত?

ধরে নেওয়া যাক ডক্টর হাজরার এখানে দুটো স্ট্র্যাটেজি অপশন – কো-অপারেশন এবং ফাইট। কো-অপারেশন অর্থে কলকাতা থেকে আগত টিকটিকির পাশ না কাটিয়ে তার সঙ্গেই চলা, অর্থাৎ একসঙ্গে জয়সলমীর যাওয়া আর ফাইট অর্থে টিকটিকিকে জয়সলমীর যেতে না দেওয়া। মনে রাখা ভালো ফেলুদার বিকানির থেকেই একটা সন্দেহ ডক্টর হাজরার ওপর ছিল, কারণ অভিজ্ঞ চোখে ধরা পড়ে গেছিল ভদ্রলোক নিজেই নিজেকে বেঁধেছেন।সুতরাং, নকল ডক্টর হাজরা ওরফে ভবানন্দ কো-অপারেট করলেও গোয়েন্দা এবং অপরাধীর একটা কনফ্রন্টেশনের সম্ভাবনা থেকেই যায়।

আবারো গেমটা দেখে নেওয়া যাক।

SK

দু’পক্ষই কো-অপারেট করলে কি হতে পারত? জয়সলমীরে গিয়ে দেখা যেত গুপ্তধন নেই, সম্ভবত ভবানন্দ ফেলুদাকে অনুরোধ করত মুকুলকে কলকাতায় পৌঁছে দেওয়ার জন্য। ফেলুদা কনফ্রন্টেশনে গেলেও ভবানন্দের ক্ষতি বিশেষ কিছু হত না কারণ নিজেই নিজেকে বেঁধে ভদ্রলোক টেকনিক্যালি নিজেকে ছাড়া অন্য কারোর ক্ষতি করেননি, সুতরাং সে পয়েন্টে তর্ক চালানো মুশকিল।আর ফাইট – ফাইটের পরিণতি কি হয়েছে সে তো আমরা জানিই। ভবানন্দকে যদি বুদ্ধিমান অপরাধী হিসাবে ধরে নেওয়া যায় তাহলে বলতেই হয় টিকটিকির সঙ্গে কো-অপারেট না করাটা কাজের কাজ হয়নি । মনে হতে পারে গুপ্তধন পাওয়ার ব্যাপারে ভবানন্দ প্রায় ১০০% নিশ্চিত ছিল বলেই বোধহয় ‘ফাইট’ এর বাইরে অন্য কিছু ভাবতে পারেনি। কিন্তু মনে রাখা ভালো এ হল সিকুয়েনশিয়াল গেম অর্থাৎ ফেলুদা কি করতে পারে সেটা ভেবে ভবানন্দ তার নিজের স্ট্র্যাটেজি ঠিক করবে, সে নিজে দ্বিতীয় স্টেজে কি পাবে সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়।

এবং তার মানে গুপ্তধনের ব্যাপারে ভবানন্দ নিশ্চিত ছিল কি ছিল না সেটা বড় কথা নয়, তাকে নিশ্চিত থাকতে হবে একটাই ব্যাপারে – মন্দার বোস ফেলু অ্যান্ড কোং কে মানে মানে সরিয়ে দিতে পারবে।

সোনার কেল্লার গেম কি শেষ হয়ে গেল ভাবছেন?

মোটেই না, তৃতীয় একজন প্লেয়ারের কথা তো বলাই হয়নি এখনো।

আসল ডক্টর হাজরা।

নকল ডক্টর হাজরা কো-অপারেশন স্ট্র্যাটেজি নিলেও হিসেবনিকেশ সবই গন্ডগোল হয়ে যেতে পারে এই তৃতীয় প্লেয়ারের স্ট্র্যাটেজি-সেটের ঠ্যালায়। কিন্তু সে গল্প তোলা থাকুক পরের বারের জন্য!

2

 

 

 

পরিচয়ের আড্ডায়

২০১৬-র কলকাতা বইমেলায় সৃষ্টিসুখ প্রকাশন থেকে বেরিয়েছে ‘পরিচয়ের আড্ডায়’। ‘সাড়ে বত্রিশ ভাজা’ ব্লগটি যাঁরা নিয়মিত ফলো করেন তাঁরা জানেন যে পরিচয় পত্রিকার সদস্যদের আড্ডার গল্পগুলো এই ব্লগেই প্রথম বেরোতে শুরু করে। বইটি এখন ই-বুক আকারেও প্রকাশিত হয়েছে, পাওয়া যাবে গুগল প্লে-স্টোরে।

https://play.google.com/store/books/details?id=REG7CwAAQBAJ

সাড়ে বত্রিশ ভাজার যে সব পাঠক ভারতে আছেন তাঁরা হার্ডবাউন্ড বইটি অ্যামাজন ইন্ডিয়া থেকে কিনতে পারবেন,

http://www.amazon.in/dp/8193214625

নিচে রইল দেশ পত্রিকার বইমেলা সংখ্যায় প্রকাশিত বিজ্ঞাপন এবং বইটির কিছু পাতার ছবি।

desh ad

PA

ভয়ের নাম গলগাথা

Tagbag

 

 

তিনশ বছর আগে শহর কলকাতা বিধ্বংসী ভূমিকম্পে ডুবে গেছিল মাটির নিচে; অবশ্য সে দূষিত শহরকে কলকাতা বলে আর কেউ ডাকত না, ডাকত গলগাথা নামে, আদি ওলন্দাজ ভাষায় যার আক্ষরিক অর্থ মৃত্যুপুরী। সেই ধবংসস্তুপ গলগাথার কাছাকাছিই এক ক্ষেতে আটকে পড়েছে টুপ আর টুং, দুই ভাই বোন, সঙ্গে টুপের বন্ধু সুহেল – ওরা জানে কালো ধুলোর মারণঝড় দিন দিন বেড়েই চলবে, এ প্রলয়ের হাত থেকে বাঁচার আর কোনো রাস্তাই নেই। মৃত্যুর সামনাসামনি দাঁড়িয়ে সুহেল টুপকে জানায় হয়ত ধ্বংসস্তুপ গলগাথার নিচেই আছে বাঁচার আশ্রয়, শোনা যায় অতি সঙ্গোপনে কারা যেন সেখানেই গড়ে তুলেছে কৃত্রিম শহর কলকাতা। কিন্তু সে শহর শুধু উচ্চকোটি মানুষের জন্য। টুপ আর টুং কি পারবে সে শহরে ঢুকতে?  

গত পুজোয় ছোটোদের পত্রিকা ‘টগবগ’ এ প্রকাশিত হয়েছিল কল্পবিজ্ঞানের গল্প ‘ভয়ের নাম গলগাথা’। সাড়ে বত্রিশ ভাজার পাঠকদের জন্য সেই লেখাটি তুলে দিলাম। লেখার ওপরে মতামত পেলে তো নিশ্চয় ভালো লাগবে কিন্তু তার থেকেও জরুরী মূল বিষয়টি নিয়ে কিছু আলোচনার, বন্ধুদের সঙ্গে সেই আলোচনা করার জন্য সোৎসাহে অপেক্ষা করব।

 

 

 

জল শুধু জল

মসৃণ-চিক্কণ-কৃষ্ণ-কুটিল-নিষ্ঠুর জলের কথা বলছি না অবশ্য যা দেখে রাখালের চিত্ত বিকল হয়ে পড়েছিল; আমি বলছি সবজে নীল, হাওয়ার পালে ঢেউ তুলে যাওয়া যাওয়া বহতা জলের কথা। সত্যেন্দ্রনাথের পূর্ণযৌবনা ঝর্ণা হয়ত নয়, ‘তুমি স্বপ্নের সখী বিদ্যুৎপর্ণা’ বলে পার্সোনিফাই-ও হয়ত করা যাবে না কিন্তু এ জল দেখে কিছুটা স্বপ্নমেদুরতা আসতে বাধ্য। রঙিন হয়েও সে রঙে প্রগলভতা নেই, স্রোতস্বিনী হয়েও যেন ভাসিয়ে নেওয়ার তাড়না নেই, যা আছে তা শুধুই মানুষপাড়ায় অধিবাসের আকাঙ্ক্ষা।

জাপানী শিল্পী হোকুসাই-এর নাম না শুনেও ওনার আঁকা সর্ববিখ্যাত ছবি ‘In the hollow of a wave off the coast at Kanagawa’ দেখে থাকার সম্ভাবনা প্রবল। দেখুন তো চিনতে পারেন কিনা!

Great_Wave_off_Kanagawa

ছবিটার একটা বড় বিশেষত্ব হল ঢেউয়ের গতিমুখ। আমরা সাধারণত ঢেউ আঁকতে গেলে শুরু করি বাঁদিক থেকে, অধিকাংশ সময়ে অবশ্য ছবি শেষ হওয়ার পর বোঝাও যায় না ঢেউ কোনদিক থেকে কোনদিকে যাচ্ছে। সেটা ঠিক শিল্পীর অক্ষমতা নয় – আমরা ঢেউকে দেখি, পড়ি না। হোকুসাই কিন্তু ঢেউকে পড়েছেন, আর তাই জন্যই জাপানী লেখা যেমন ডানদিক থেকে বাঁদিকে যায় ঠিক সেরকমভাবে ঢেউটি সম্পূর্ণ হচ্ছে বাঁদিক ডানদিক থেকে বাঁদিকে গিয়ে। ঢেউটির বিশালত্ব-ও লক্ষ্য করার মতন – একটা আন্দাজ পাওয়া যাবে ঠিক মাঝখানে তাকালে। ঠিক মাঝখানটিতে দেখা যাচ্ছে ফুজি পাহাড়কে, কিন্তু এই বিশাল ঢেউয়ের পাশে পাহাড়কেও মনে হচ্ছে নেহাতই বালখিল্য। ফুজির ঠিক পেছনেই কালো আকাশ দেখা যাচ্ছে বটে কিন্তু চোখ যত ওপরে উঠবে সে কালোর গভীরতা কমে আসতে থাকে। জলের রঙটিও দেখুন, সবজে নীল, অথচ একটা ভয়াবহ বিপদ বোঝানোর জন্য শিল্পী অনায়াসেই জলের রঙ-এও কালোর আধিক্য আনতে পারতেন। কিন্তু হোকুসাই সেটা চান নি, শুধু দেখাতে চেয়েছেন এই পাহাড়প্রমাণ ঢেউ-ও নিতান্তই জীবনের অংশ। সেটা আরোই বোঝা যায় ছবির তিনটে নৌকার সওয়ারীদের দেখে, নৌকার সঙ্গে প্রায় সমান্তরাল অবস্থায় তাঁরা শুয়ে পড়েছেন নৌকার ওপর, যেন ওরকম আসনেই তাঁরা অভ্যস্ত। কোনো তাড়া নেই, ভয়ের চোটে কেউ উঠে দাঁড়ান নি, কেউ ইষ্টনাম জপছেন না, যা ঘটছে সেটাই স্বাভাবিক।

আজকের ব্লগপোস্ট হোকুসাই-এর কিছু ছবি নিয়ে, আর এই সব ছবিতেই মৌলিক বিষয়বস্তু হিসাবে প্রাধান্য পেয়েছে জল।

‘কিয়োটাকি কান্নন’ দিয়ে শুরু করা যাক।

kiyotaki cannon

জলের রঙটি তো চোখ কেড়ে নেবেই, এত স্বচ্ছ, নির্মল জল আর এযুগে চোখে পড়ে কই? কিন্তু রঙের সঙ্গে আরো একটা জিনিস খুঁটিয়ে দেখার মতন –  ঝর্ণার উৎসস্থলটি। চোখের সঙ্গে একটা সাদৃশ্য পাওয়া যাচ্ছে না? বিশেষজ্ঞরা বলেন হোকুসাই বুদ্ধ অমিতাভর চোখের আদলেই এঁকেছেন এই উৎসস্থলটি।  বুদ্ধের অবশ্য বিভিন্ন অবতার, ধারণা করা হয় হিন্দু দেবতা কান্নন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের হাতে পড়ে হয়েছেন্ অবলোকিতেশ্বর যার শরীরের আদলও এরকমই গোলাকৃতি। ঝর্ণার পাশেই পাহাড়ের ওপর দেখা যাচ্ছে দুই বাবু এবং তাঁদের কাজের লোককে। কাজের লোকটি জল গরম করছেন আর বাবুরা চুপ করে বসে প্রাণভরে দেখে নিচ্ছেন জলের অপার্থিব রূপটিকে – প্রকৃতি এবং পুরুষের স্বাভাবিক সহাবস্থান।

পুরুষের বদলে প্রাণী বললেও অবশ্য অত্যুক্তি হয় না। নিচের ছবিটির নাম ‘Carp in the waterfall’, একটি মাছ ওপরে উঠছে আর অন্যটি নেমে আসছে, পুরো ছবিটি যেন জীবনচক্রের একটি প্রতীক।

Carp in a Waterfall Katsushika Hokusai

জলের চরিত্রটি একবার দেখুন এ ছবিতে, কি মসৃণ, কি মোলায়ম। অপেক্ষাকৃত রুক্ষ একটি পটভূমিতে এই ঝর্ণা ছবির মধ্যে একটা বৈপরীত্য এনেছে ঠিকই কিন্তু তার পরেও মনে হয় এটাই স্বাভাবিক, এই বৈপরীত্যের নামই জীবন।

স্বাভাবিক বৈপরীত্যর কথা যখন উঠলই তখন একবার দেখে নেওয়া দরকার ‘Whaling off the Goto islands’ ছবিটি।

whaling off

শোনা যায় তিমি শিকার নিয়ে হোকুসাই-এর উৎসাহের অন্ত ছিল না। দু’শ টনেরও বেশী ওজনের একটা প্রাণীকে শয়ে শয়ে নৌকা দিয়ে ঘিরে ফেলে মারা হচ্ছে, এও দৈনন্দিন জীবনেরই অংশ, তাই না? এ হত্যা তো আত্মরক্ষার খাতিরে নয়, এ হত্যা অর্থনৈতিক লাভের খাতিরে, আর তাই জন্যই বোধহয় এমনকি শিল্পীর কাছেও এ ঠিক ট্র্যাজেডি হয়ে ধরা পড়ে না! তাই দেখুন জলের রঙে এক ফোঁটা লাল-ও আসেনি, হোকুসাই বরং নীল আর সাদার বিভিন্ন শেডে দূরের জল, কাছের জল, চূর্ণিত জল, আলোকিত জল কত কিছু নিয়ে এসেছেন।

এই রং-তুলির খেলায় অবশ্য আমার পার্সোনাল ফেভরিটটি হল ‘Ono waterfall along Kisokaido ‘।

Ono waterfall
হোকুসাই-এর কলম আর তুলির ছোঁয়ায় বরফাবৃত পাহাড় আর জলের ধারা যেন এক হয়ে গেছে, সাদা-নীলের কোন জায়গাটিতে যে বরফ গলে অনাবিল ধারা বেরোতে শুরু করেছে তা ঠাহর করা মুশকিল। সেতুর তলা দিয়ে বয়ে যাওয়া জলের রঙেও মালিন্যের ছিটে টুকু নেই, শুধু পেছনে থেকে গেছে আছড়ে পড়ার মুহূর্তের সাদাটে জলকণাগুলি, সে জলকণাকে ধোঁয়া ভাবলেও হয়ত ক্ষতি নেই। তিন অবস্থাই ধরা পড়ল একটি ফ্রেমে।

কিন্তু হোকুসাইকে আদ্যন্ত রোম্যান্টিক ভাবলে ভুল হবে। তিমি শিকারটিকে যদি বাদও দি, তারপরেও একাধিক আঁকায় হোকুসাই নিয়ে এসেছেন এমন জলচরিত্র যার সঙ্গে রোম্যান্সের বিশেষ সম্পর্ক নেই।

যেমন?

যেমন ‘Washing in a river’।

Washing in a river

এখানেও জল নীলচে, কিন্তু তার মধ্যে দিয়েই বয়ে চলেছে কিছু ধূসর ধারা – মহিলারা কাপড় কাচছেন, পুরুষেরা মাছ ধরছেন, রজক এবং রজকিনীরা বয়ে নিয়ে যাচ্ছেন সাদা কিমোনো। ছবির মধ্যে দেখা যাচ্ছে একটি কবিতা (হাইকু নয়) যার বাংলা ভাবানুবাদ দাঁড়াবে,

“বসন্ত মনে হয় গেল,
ফিরেছে গরম পুনরায়;
সফেদ কিমোনোগুলো
ছড়িয়ে দাও, শুকোবে
অপার্থিব ঘ্রাণের চূড়ায়”

অপার্থিব ঘ্রাণটি সম্ভবত রসিকতা করে বলা!

হোকুসাই-এর জলের কথায় ফিরে যাই। নীল রঙের জল যতটা প্রাধান্য পেয়েছে শিল্পীর ছবিতে, আকাশ ততটা নয়, কিন্তু ‘Abe No Nakamaro gazing at the moon from a terrace’ ব্যতিক্রমগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য। আমি আলাদা করে ছবিটির কথা তুললাম কারণ আমার একটি প্রিয় বিষয়কে হোকুসাই ফ্রেমের মধ্যে নিয়ে এসেছেন।

দিকচক্রবাল।

Moon gazing

জাপানের বিশিষ্ট বিদ্বজন এবং কবি নাকামারো কূটনৈতিক কাজে রাজপ্রতিনিধিদের সঙ্গে চীনে গিয়েছিলেন, কোনো রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র হেতু বাকি প্রতিনিধিরা জাপানে ফিরে যেতে পারলেও তিনি পারেননি। চীনেই নাকামারোকে বাকি জীবন কাটাতে হয়; শুরুর দিকে গৃহবন্দী হয়ে থাকতে হলেও পরভূমে সম্মানের ঘাটতি পড়েনি এমনকি শেষের দিকে তিনি স্থানীয় শাসক হিসাবে কাজও করেছিলেন।

কিন্তু যত সম্মানই পান, ‘প্রবাসে দৈবের বশে’ সুলভ আক্ষেপ নিয়েই জীবন কাটাতে হয়েছে। সেই আক্ষেপ থেকেই হয়ত লিখেছিলেন, “স্বর্গের দিকে তাকিয়ে দেখি/ এই একই চাঁদ কি উঠেছে/ কাসুগার মিকাসা পাহাড়ের ওপরে?”

এই কবিতাকে ভিত্তি করেই হোকুসাই ছবিটি এঁকেছিলেন। কাছের নীল জল দূরে সাদা হয়ে যেতে যেতে কখন যে আকাশের সঙ্গে মিশে গেছে খেয়াল করা যায় না, দূর সমুদ্রের নৌকাগুলোকেও কেন জানি পরাবাস্তব ঠেকতে থাকে। ছবিতে রাজপুরুষ নাকামারোর পাশেই রয়েছেন একাধিক মানুষ, হয়ত তাঁর ফাইফরমাশ খাটতেই, কিন্তু দৃশ্যতই নাকামারো নিজের চিন্তায় বিভোর।

চেতন-অচেতন-অবচেতন যে জায়গায় গিয়ে মিশে গেছে সেটিই যেন হোকুসাইয়ের তুলিতে ধরা পড়েছে দিকচক্রবাল হয়ে।