মসৃণ-চিক্কণ-কৃষ্ণ-কুটিল-নিষ্ঠুর জলের কথা বলছি না অবশ্য যা দেখে রাখালের চিত্ত বিকল হয়ে পড়েছিল; আমি বলছি সবজে নীল, হাওয়ার পালে ঢেউ তুলে যাওয়া যাওয়া বহতা জলের কথা। সত্যেন্দ্রনাথের পূর্ণযৌবনা ঝর্ণা হয়ত নয়, ‘তুমি স্বপ্নের সখী বিদ্যুৎপর্ণা’ বলে পার্সোনিফাই-ও হয়ত করা যাবে না কিন্তু এ জল দেখে কিছুটা স্বপ্নমেদুরতা আসতে বাধ্য। রঙিন হয়েও সে রঙে প্রগলভতা নেই, স্রোতস্বিনী হয়েও যেন ভাসিয়ে নেওয়ার তাড়না নেই, যা আছে তা শুধুই মানুষপাড়ায় অধিবাসের আকাঙ্ক্ষা।
জাপানী শিল্পী হোকুসাই-এর নাম না শুনেও ওনার আঁকা সর্ববিখ্যাত ছবি ‘In the hollow of a wave off the coast at Kanagawa’ দেখে থাকার সম্ভাবনা প্রবল। দেখুন তো চিনতে পারেন কিনা!

ছবিটার একটা বড় বিশেষত্ব হল ঢেউয়ের গতিমুখ। আমরা সাধারণত ঢেউ আঁকতে গেলে শুরু করি বাঁদিক থেকে, অধিকাংশ সময়ে অবশ্য ছবি শেষ হওয়ার পর বোঝাও যায় না ঢেউ কোনদিক থেকে কোনদিকে যাচ্ছে। সেটা ঠিক শিল্পীর অক্ষমতা নয় – আমরা ঢেউকে দেখি, পড়ি না। হোকুসাই কিন্তু ঢেউকে পড়েছেন, আর তাই জন্যই জাপানী লেখা যেমন ডানদিক থেকে বাঁদিকে যায় ঠিক সেরকমভাবে ঢেউটি সম্পূর্ণ হচ্ছে বাঁদিক ডানদিক থেকে বাঁদিকে গিয়ে। ঢেউটির বিশালত্ব-ও লক্ষ্য করার মতন – একটা আন্দাজ পাওয়া যাবে ঠিক মাঝখানে তাকালে। ঠিক মাঝখানটিতে দেখা যাচ্ছে ফুজি পাহাড়কে, কিন্তু এই বিশাল ঢেউয়ের পাশে পাহাড়কেও মনে হচ্ছে নেহাতই বালখিল্য। ফুজির ঠিক পেছনেই কালো আকাশ দেখা যাচ্ছে বটে কিন্তু চোখ যত ওপরে উঠবে সে কালোর গভীরতা কমে আসতে থাকে। জলের রঙটিও দেখুন, সবজে নীল, অথচ একটা ভয়াবহ বিপদ বোঝানোর জন্য শিল্পী অনায়াসেই জলের রঙ-এও কালোর আধিক্য আনতে পারতেন। কিন্তু হোকুসাই সেটা চান নি, শুধু দেখাতে চেয়েছেন এই পাহাড়প্রমাণ ঢেউ-ও নিতান্তই জীবনের অংশ। সেটা আরোই বোঝা যায় ছবির তিনটে নৌকার সওয়ারীদের দেখে, নৌকার সঙ্গে প্রায় সমান্তরাল অবস্থায় তাঁরা শুয়ে পড়েছেন নৌকার ওপর, যেন ওরকম আসনেই তাঁরা অভ্যস্ত। কোনো তাড়া নেই, ভয়ের চোটে কেউ উঠে দাঁড়ান নি, কেউ ইষ্টনাম জপছেন না, যা ঘটছে সেটাই স্বাভাবিক।
আজকের ব্লগপোস্ট হোকুসাই-এর কিছু ছবি নিয়ে, আর এই সব ছবিতেই মৌলিক বিষয়বস্তু হিসাবে প্রাধান্য পেয়েছে জল।
‘কিয়োটাকি কান্নন’ দিয়ে শুরু করা যাক।

জলের রঙটি তো চোখ কেড়ে নেবেই, এত স্বচ্ছ, নির্মল জল আর এযুগে চোখে পড়ে কই? কিন্তু রঙের সঙ্গে আরো একটা জিনিস খুঁটিয়ে দেখার মতন – ঝর্ণার উৎসস্থলটি। চোখের সঙ্গে একটা সাদৃশ্য পাওয়া যাচ্ছে না? বিশেষজ্ঞরা বলেন হোকুসাই বুদ্ধ অমিতাভর চোখের আদলেই এঁকেছেন এই উৎসস্থলটি। বুদ্ধের অবশ্য বিভিন্ন অবতার, ধারণা করা হয় হিন্দু দেবতা কান্নন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের হাতে পড়ে হয়েছেন্ অবলোকিতেশ্বর যার শরীরের আদলও এরকমই গোলাকৃতি। ঝর্ণার পাশেই পাহাড়ের ওপর দেখা যাচ্ছে দুই বাবু এবং তাঁদের কাজের লোককে। কাজের লোকটি জল গরম করছেন আর বাবুরা চুপ করে বসে প্রাণভরে দেখে নিচ্ছেন জলের অপার্থিব রূপটিকে – প্রকৃতি এবং পুরুষের স্বাভাবিক সহাবস্থান।
পুরুষের বদলে প্রাণী বললেও অবশ্য অত্যুক্তি হয় না। নিচের ছবিটির নাম ‘Carp in the waterfall’, একটি মাছ ওপরে উঠছে আর অন্যটি নেমে আসছে, পুরো ছবিটি যেন জীবনচক্রের একটি প্রতীক।

জলের চরিত্রটি একবার দেখুন এ ছবিতে, কি মসৃণ, কি মোলায়ম। অপেক্ষাকৃত রুক্ষ একটি পটভূমিতে এই ঝর্ণা ছবির মধ্যে একটা বৈপরীত্য এনেছে ঠিকই কিন্তু তার পরেও মনে হয় এটাই স্বাভাবিক, এই বৈপরীত্যের নামই জীবন।
স্বাভাবিক বৈপরীত্যর কথা যখন উঠলই তখন একবার দেখে নেওয়া দরকার ‘Whaling off the Goto islands’ ছবিটি।

শোনা যায় তিমি শিকার নিয়ে হোকুসাই-এর উৎসাহের অন্ত ছিল না। দু’শ টনেরও বেশী ওজনের একটা প্রাণীকে শয়ে শয়ে নৌকা দিয়ে ঘিরে ফেলে মারা হচ্ছে, এও দৈনন্দিন জীবনেরই অংশ, তাই না? এ হত্যা তো আত্মরক্ষার খাতিরে নয়, এ হত্যা অর্থনৈতিক লাভের খাতিরে, আর তাই জন্যই বোধহয় এমনকি শিল্পীর কাছেও এ ঠিক ট্র্যাজেডি হয়ে ধরা পড়ে না! তাই দেখুন জলের রঙে এক ফোঁটা লাল-ও আসেনি, হোকুসাই বরং নীল আর সাদার বিভিন্ন শেডে দূরের জল, কাছের জল, চূর্ণিত জল, আলোকিত জল কত কিছু নিয়ে এসেছেন।
এই রং-তুলির খেলায় অবশ্য আমার পার্সোনাল ফেভরিটটি হল ‘Ono waterfall along Kisokaido ‘।

হোকুসাই-এর কলম আর তুলির ছোঁয়ায় বরফাবৃত পাহাড় আর জলের ধারা যেন এক হয়ে গেছে, সাদা-নীলের কোন জায়গাটিতে যে বরফ গলে অনাবিল ধারা বেরোতে শুরু করেছে তা ঠাহর করা মুশকিল। সেতুর তলা দিয়ে বয়ে যাওয়া জলের রঙেও মালিন্যের ছিটে টুকু নেই, শুধু পেছনে থেকে গেছে আছড়ে পড়ার মুহূর্তের সাদাটে জলকণাগুলি, সে জলকণাকে ধোঁয়া ভাবলেও হয়ত ক্ষতি নেই। তিন অবস্থাই ধরা পড়ল একটি ফ্রেমে।
কিন্তু হোকুসাইকে আদ্যন্ত রোম্যান্টিক ভাবলে ভুল হবে। তিমি শিকারটিকে যদি বাদও দি, তারপরেও একাধিক আঁকায় হোকুসাই নিয়ে এসেছেন এমন জলচরিত্র যার সঙ্গে রোম্যান্সের বিশেষ সম্পর্ক নেই।
যেমন?
যেমন ‘Washing in a river’।

এখানেও জল নীলচে, কিন্তু তার মধ্যে দিয়েই বয়ে চলেছে কিছু ধূসর ধারা – মহিলারা কাপড় কাচছেন, পুরুষেরা মাছ ধরছেন, রজক এবং রজকিনীরা বয়ে নিয়ে যাচ্ছেন সাদা কিমোনো। ছবির মধ্যে দেখা যাচ্ছে একটি কবিতা (হাইকু নয়) যার বাংলা ভাবানুবাদ দাঁড়াবে,
“বসন্ত মনে হয় গেল,
ফিরেছে গরম পুনরায়;
সফেদ কিমোনোগুলো
ছড়িয়ে দাও, শুকোবে
অপার্থিব ঘ্রাণের চূড়ায়”
অপার্থিব ঘ্রাণটি সম্ভবত রসিকতা করে বলা!
হোকুসাই-এর জলের কথায় ফিরে যাই। নীল রঙের জল যতটা প্রাধান্য পেয়েছে শিল্পীর ছবিতে, আকাশ ততটা নয়, কিন্তু ‘Abe No Nakamaro gazing at the moon from a terrace’ ব্যতিক্রমগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য। আমি আলাদা করে ছবিটির কথা তুললাম কারণ আমার একটি প্রিয় বিষয়কে হোকুসাই ফ্রেমের মধ্যে নিয়ে এসেছেন।
দিকচক্রবাল।

জাপানের বিশিষ্ট বিদ্বজন এবং কবি নাকামারো কূটনৈতিক কাজে রাজপ্রতিনিধিদের সঙ্গে চীনে গিয়েছিলেন, কোনো রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র হেতু বাকি প্রতিনিধিরা জাপানে ফিরে যেতে পারলেও তিনি পারেননি। চীনেই নাকামারোকে বাকি জীবন কাটাতে হয়; শুরুর দিকে গৃহবন্দী হয়ে থাকতে হলেও পরভূমে সম্মানের ঘাটতি পড়েনি এমনকি শেষের দিকে তিনি স্থানীয় শাসক হিসাবে কাজও করেছিলেন।
কিন্তু যত সম্মানই পান, ‘প্রবাসে দৈবের বশে’ সুলভ আক্ষেপ নিয়েই জীবন কাটাতে হয়েছে। সেই আক্ষেপ থেকেই হয়ত লিখেছিলেন, “স্বর্গের দিকে তাকিয়ে দেখি/ এই একই চাঁদ কি উঠেছে/ কাসুগার মিকাসা পাহাড়ের ওপরে?”
এই কবিতাকে ভিত্তি করেই হোকুসাই ছবিটি এঁকেছিলেন। কাছের নীল জল দূরে সাদা হয়ে যেতে যেতে কখন যে আকাশের সঙ্গে মিশে গেছে খেয়াল করা যায় না, দূর সমুদ্রের নৌকাগুলোকেও কেন জানি পরাবাস্তব ঠেকতে থাকে। ছবিতে রাজপুরুষ নাকামারোর পাশেই রয়েছেন একাধিক মানুষ, হয়ত তাঁর ফাইফরমাশ খাটতেই, কিন্তু দৃশ্যতই নাকামারো নিজের চিন্তায় বিভোর।
চেতন-অচেতন-অবচেতন যে জায়গায় গিয়ে মিশে গেছে সেটিই যেন হোকুসাইয়ের তুলিতে ধরা পড়েছে দিকচক্রবাল হয়ে।