ক্রীড়নক

(টগবগ পত্রিকার ‘কল্পবিজ্ঞান সংখ্যা’-র (২০১৭) জন্য লেখা হয়েছিল ‘ক্রীড়নক’। সাড়ে বত্রিশ ভাজার পাঠকদের জন্য ব্লগে তুলে দেওয়া হল। অলঙ্করণের ভার নিয়েছিলেন শিল্পী সুমিত রায়। আপনাদের মতামত এবং বিষয়টি নিয়ে আলোচনার জন্য অপেক্ষা করে থাকব। )

krironok4

 

 

০১/০৭/২০১৭, সকাল ১০’টা   

প্লেন ছাড়তে নাকি আরো ঘন্টা দেড়েক দেরি।

সমস্যা হল, এই নিয়ে তৃতীয়বারের জন্য সময় বদলানো হল। যে প্লেন দু’ঘন্টা আগে উড়ে যাওয়ার কথা তাকে এখনো টারম্যাকেই দেখা যাচ্ছে না। বহু যাত্রীই অস্থিরতা প্রকাশ করছেন, দু’ঘন্টা আগে উড়ে যেতে পারেন নি বলে নয় ঠিক কখন ওড়া যাবে সে ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারছেন না বলে।

বি থার্টি-টু গেটের সামনে রীতিমতন ভিড়, আন্তঃমহাদেশীয় উড়ান বলে যাত্রী সংখ্যাও প্রচুর। প্রৌঢ় মানুষটি বেশ কিছুক্ষণ ধরেই উশখুশ করছিলেন। এবার আর থাকতে না পেরে পাশের সিটে বসা তরুণটির দিকে তাকালেন। রেস্টরুমে ঢোকাটা নিতান্তই দরকার, কিন্তু বড় ব্যাগটা নিয়ে যাওয়াও একটা সমস্যা। পাশের তরুণটিকে দেখে মনে হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, কানে ইয়ারফোন গুঁজে একমনে গান শুনছে। প্রৌঢ় অপাঙ্গে তার হাতে ধরা স্মার্টফোনটির দিকে একবার তাকালেন, সেখানে গানের নামটি ভেসে ভেসে উঠছে।

কালাকুটা শো, গায়কের নাম…

গায়কের নাম দেখার জন্য অবশ্য ভদ্রলোককে কষ্ট করতে হল না। একচল্লিশ বছর আগে এ গান যখন প্রথম বেরোয় তখন তিনি মার্কিনী বিশ্ববিদ্যালয়ে পি-এইচ-ডি শেষ করছেন। তাঁর নাইজেরিয়ান ল্যাবমেট এ গান শুনিয়েছিল। নাইজেরিয়ায় তো বটেই, আমেরিকার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়েও ছাত্রজমায়েতে এ গান তখন শুনতে পাওয়া যাচ্ছে। তিনি অবশ্য বিরোধিতার গান নিয়ে খুব একটা ওয়াকিফহাল ছিলেন না, ‘কালাকুটা’ নামটা শুনেই একটা আগ্রহ জন্মেছিল।

কালাকুটা মানে কী তাঁর আদি শহর?

নাহ, নাইজেরিয়ান গায়ক ফেলা কুটি ‘কালাকুটা’ বলতে আদপেই কলকাতাকে বোঝাননি তবে গানটা নাড়া দিয়ে গেছিল। সেনা অত্যাচারের প্রতিবাদ যে জ্যাজ গান দিয়েও করা যায় কে জানত?

কিন্তু সেটা ছিল ১৯৭৬। ২০১৭ তে বসে এ প্রজন্মের এক তরুণ যে ফেলা কুটির গান শুনছে এই ব্যাপারটাই ভারি আশ্চর্যের ঠেকল তাঁর কাছে। তরুণটি অত্যন্ত ভদ্র। প্রৌঢ় তাঁর সমস্যাটি বলা মাত্রই সে আশ্বস্ত করল তাঁকে – ব্যাগের দিকে অবশ্যই নজর রাখবে সে, অন্য কেউ যাতে সিটের দখল না নেয় সে ব্যাপারেও খেয়াল রাখবে।

রেস্টরুমটি একটু কোণার দিকে বলেই হোক বা যাত্রীরা সবাই গেটের সামনে ভিড় জমিয়েছেন বলেই হোক, ভেতরটা মোটামুটি ফাঁকা। সারি সারি বেসিনের সামনে একটি মাত্রই ছেলে দাঁড়িয়ে। দূর থেকে দেখে ভারতীয় বলেই মনে হচ্ছিল। কাছে আসার পর নিঃসংশয় হওয়া গেল।

দেখে নয়, কথা শুনে।

ছেলেটি ফোনে কথা বলছিল।

“ঠিক শুনেছিস? হার্ট-অ্যাটাক্? কী সর্বনাশ! তাহলে তো প্লেন ছাড়তে এখনো বহু দেরি। এনিওয়ে, তুই ওখানেই বসে থাক। আমি আসছি”।

ছেলেটি তড়িঘড়ি ফোন রেখে দরজার দিকে পা বাড়িয়েছিল, এমন সময় প্রৌঢ় মানুষটি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘হার্ট-অ্যাটাক্ হল কার? পাইলটের নাকি?’

ছেলেটি চমকে তাকিয়েছে।

হাসল।

“ওহ, আপনিও বাঙালি? না, পাইলটের নয়। এয়ার-হোস্টেস। উজ্জয়িনী, মানে আমার বন্ধু তো তাই জানাল”।

“ইস্, সকাল সকাল কী খারাপ খবর বলো তো”।

“আর বলবেন না, শুনেই মনটা কী খারাপ হয়ে গেল।  আমাদের আবার দুবাই থেকে কলকাতার কানেক্টিং ফ্লাইট ছিল। সেটা হয়ত আর পাওয়া যাবে না”।

ভদ্রলোক মাথা নাড়লেন।

“আমারও তো সেই এক সমস্যা। সেরকম হলে অবশ্য তোমাদের সঙ্গেই গল্পগুজব করতে বসে পড়ব”।

ছেলেটি হেসে ফেলল।

“অফ কোর্স, খেয়াল হয়নি আপনিও একই ফ্লাইট ধরতে পারেন। আমি আসলে খবরটা শোনা ইস্তক এমন ঘাবড়ে গেছি…”।

“বুঝতে পারছি। তবে জানো তো আজকাল ইয়ং ছেলেমেয়েদের মধ্যেও কিন্তু হার্ট-অ্যাটাক এর প্রবণতা বাড়ছে”।

“সেটা জানি আঙ্কল। কিন্তু দু’জন একসঙ্গে…”।

ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে পড়েছেন। সবিস্ময়ে বললেন, “দু’জন মানে?”

ছেলেটি অপ্রস্তুত, “ওহ হো, আপনাকে বলা হয়নি। একজন নয়, দু’জন এয়ারহোস্টেসের  হার্ট-অ্যাটাক হয়েছে”।

ভদ্রলোক অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন।

“বলো কী? তোমার বন্ধু ভুল শোনেনি তো?”

“ওকে আট বছর ধরে চিনি আঙ্কল, মনে হয় না ভুল শুনবে। ও নাকি খোদ এয়ারপোর্ট ম্যানেজারের কাছেই চলে গেছিল। আমিও অবশ্য দু’জনের একসঙ্গে হার্ট-অ্যাটাক হয়েছে শুনে খুব অবাক হয়েছি”।

“স্ট্রেঞ্জ! চলো তো, আমিও একবার উজ্জয়িনীর সঙ্গে কথা বলে আসি। ভালো কথা, আঙ্কল টা বাদ দাও, কেমন? দরকার পড়লে জেঠু বলতে পারো। বুড়ো সাজতে চাইছি না, কিন্তু বিশ্বসুদ্ধ সবাই সবার কাকু দেখে ওই ডাকটাও আজকাল আর নিতে পারি না”।

ভদ্রলোক হাত বাড়ালেন, “আর তোমার নামটা? হাতটা ধুলে তো, তাই না?”

ছেলেটি হেসে ফেলেছে।

“ধুয়েছি জেঠু, আমি আরাফ। আর আপনি…”

বাইরে থেকে একটা মর্মান্তিক চিৎকার শোনা গেল। কোনো মহিলা চিৎকার করে উঠেছেন।

এনারা দু’জনেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছেন।

আবার চিৎকার শোনা গেল, এবার মনে হচ্ছে একটি বাচ্চা ছেলেও সঙ্গে কাঁদছে।

“ওহ গড, নো নো! নোওও…। হেল্প, এনিবডি হেয়ার? হেল্প্। এডি, এডিই……”

দু’জনেই প্রায় ছুটে বার হয়েই স্থাণুবৎ দাঁড়িয়ে পড়েছেন।

বি থার্টি-টু ওয়েটিং এরিয়ায় এখনো প্রচুর লোক। কিন্তু দাঁড়িয়ে আছেন সাকুল্যে জনা তিনেক মানুষ। এক মহিলা উদভ্রান্তের মতন এগিয়ে চলেছেন সামনে। সেখানে একটি বাচ্চা ছেলে দাঁড়িয়ে অঝোরে কাঁদছে। আর ঠিক গেটের সামনে আর একটি মানুষকে দেখা যাচ্ছে, তাঁর চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসছে।

বাকিরা সবাই লুটিয়ে পড়েছেন – কেউ চেয়ারে বসেই, কেউ বা মাটিতে। মনে হচ্ছে এতজন মানুষ একসঙ্গেই যেন ঘুমিয়ে পড়েছেন। কারোর মুখে কোনো বিকার নেই, কোনো যন্ত্রণার অভিব্যক্তি নেই, চোখ বন্ধ করে যেন বিশ্রাম নিচ্ছেন প্রত্যেকে।

প্রৌঢ়ের হাত দুটো থরথর করে কাঁপছে, মনে হচ্ছে হাঁটু দুমড়ে ওখানেই পড়ে যাবেন।

আরো একটা আর্তনাদ ভেসে এল।

এ গলা প্রৌঢ় চেনেন।

আরাফ। পাগলের মতন চিৎকার করছে। কাঁদছে।

বান্ধবীকে খুঁজে পেয়েছে সে,  নিজের সিটেই লুটিয়ে পড়ে আছে উজ্জয়িনীও। দেখে মনে হচ্ছে ঠেলা দিলেই উঠে বসবে।
০৪/০৭/২০১৮, সকাল ন’টা

সকালের কাগজে চোখ বোলাচ্ছিল স্রোতস্বিনী। মোহনবাগান এই নিয়ে পর পর তিন বছর জাতীয় লিগে রানার্স হল। বছর দুয়েক আগে হলেও বাবা এ খবর দেখে কুরুক্ষেত্র বাঁধিয়ে দিতেন। স্রোত (পুরো নামে ওকে আর কেই বা ডাকে?) নিজে বার্সেলোনার সাপোর্টার, কলকাতার ফুটবল নিয়ে থোড়াই ওর মাথাব্যথা। কিন্তু বাবার রাগটা দেখার জন্যই ঠিক ব্রেকফাস্ট টেবলে খবরটা দিত। অবধারিত ভাবে চেঁচামেচি, বাবা ব্রেকফাস্ট না করেই উঠে পড়বেন, মা’র রক্তচক্ষু – সব মিলিয়ে একদম জমজমাটি ব্যাপার।

স্রোত একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ইদানীং ব্রেকফাস্ট ও নিজের ঘরেই করে।

খবরের কাগজের সামনের পাতায় ও কদাচিৎ চোখ বোলায়। আজকেও সামনের পাতায় থমকে দাঁড়াত না, মেক্সিকোর খবরটা না দেখলে। মেক্সিকো সিটির কোন এক হাসপাতালে নাকি দু’দিনের মধ্যে সদ্যোজাত শ’দুয়েক শিশু মারা গেছে।  হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সে খবর চেষ্টা করেও ধামাচাপা দিতে পারেননি, সারা পৃথিবী জুড়ে হইচই পড়ে গেছে।

একটা চরম হতাশায় ওর মনটা ভরে উঠল। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এখনো শিক্ষা আর স্বাস্থ্য কতটা অবহেলিত। ২০১৮ তেও একটা সভ্য দেশে শয়ে শয়ে শিশু মারা যাচ্ছে এ কী কল্পনাতেও ভাবা সম্ভব! মেক্সিকো কেন, এ বছরে ভারতবর্ষেই কম সদ্যোজাত শিশু প্রাণ হারিয়েছে? সকালের কাগজ খুললেই দেশের শহর আর গ্রাম থেকে ভেসে আসছে একের পর এক মর্মান্তিক খবর। দেশ জুড়ে কঠোর সমালোচনা চলছে কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য সরকারগুলোর কিন্তু কোনো লাভই হচ্ছে না।

কাগজটা দলামোচা করে ছুঁড়ে ফেলতে যাচ্ছিল এমন সময় ঘরের দরজায় আওয়াজ।

‘এসো’, ওই আলতো টোকা একজনই দেন। মা। বাবা টোকা দেন না, বাইরে থেকে গম্ভীর গলায় ডাকেন। আর একজন ছিল অবশ্য, সে ডাকাডাকি কী টোকা দেওয়া কোনো কিছুই ধর্তব্যের মধ্যে আনত না। স্রোতকে রাগানোর জন্যই সবসময় না বলে কয়েই ঢুকে পড়বে।

মা’র হাতে লুচি ভর্তি থালা।

স্রোত অবাক হল, ভীষণ অবাক। তারপরই ঝেঁপে এল রাগ।

ওর মুখ রাগে টকটকে লাল হয়ে উঠেছে।

“কেন মা? কেন? এ জিনিস কী আর কোনোদিন মুখে উঠবে আমাদের?”

মা মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছেন।

“তুই না খেলে খাস না। কিন্তু বাড়িতে অতিথি আসছে যখন তখন তাকে কিছু খেতে দেব না?”

অতিথি? কে?

জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে রয়েছে স্রোত।

‘মীর’, মা’র চোখ টা ছলছল করছে যেন।

মীর! মীর তাদের বাড়িতে আসছে?

“তুমি আমাকে জানাওনি কেন মা?”

“কালকেই তো এসেছে। অনেক রাত্রে ফোন করেছিল। খবরটা পেয়ে তোকে দিতে এলাম কিন্তু ঘর অন্ধকার দেখে আর বিরক্ত করিনি তোকে।”

বলতে বলতেই কলিং বেলের আওয়াজ। মা শশব্যস্ত হয়ে সদর দরজার দিকে এগোলেন।

স্রোতের গলার কাছটা কিরকম দলা পাকিয়ে উঠতে থাকে। আবার বছর খানেক পর মীরকে দেখবে ও। ভাবতেই পারেনি যে মীর ওদের মনে রেখেছে।

কিন্তু সঙ্গে অভিমানও হচ্ছে। খুব অভিমান। এক বছরের মধ্যে একটা ই-মেলও পায়নি। ফেসবুকেও অ্যাকাউন্ট উধাও হয়ে গেছে, হোয়াটসঅ্যাপ-এও দেখা পায়নি আর।

বেরোবেই না আজ, দেখাই করবে না।

বেরোলই না।

কিন্তু তাতেই বা উপায় কি?

আধ ঘন্টা হয়েছে কী হয়নি, দরজায় ফের টোকা। স্রোত বালিশে মুখ গুঁজে শুয়ে আছে।

পাঁচ মিনিট পর অবশ্য টোকা পড়ল না। বাবার গম্ভীর গলাটা শোনা গেল, “দরজাটা খোলো। দরকার আছে”।

বাবার গলায় কিছু একটা ছিল যার জন্য স্রোতকে উঠতেই হল।

বাবা দাঁড়িয়ে, আর বাবার পাশেই মীর। মীরের হাতে একটা ডায়েরি, সঙ্গে কিছু চিঠিপত্র।

ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল স্রোত।

মীরের চোখও ছলছল করছে, কোনোরকমে চোখের জল সামলে বলল, “ইউনিভার্সিটির লকারে এগুলো ছিল। দু’মাস আগে ডিপার্টমেন্ট চেয়ার আমাকেই দিলেন তোমাদের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য। আর চিঠিগুলো তোমার লেখা”।

স্রোত এক দৃষ্টিতে চিঠিগুলোর দিকে তাকিয়ে। হ্যাঁ, ওরা দু’জনেই দু’জনকে চিঠি লিখত। সেই পুরনো দিনের মতন। বন্ধুবান্ধব তো বটেই এমনকি মা-বাবাও সে নিয়ে মজা করতে ছাড়েন নি কিন্তু চার বছর ধরে একটা মাসের জন্যও ব্যতিক্রম ঘটেনি। স্রোতের লেখা চিঠি পৌঁছত মাসের পনের তারিখ নাগাদ, আর তার দিন দশেকের মধ্যেই স্রোতের পাওনা চিঠি এসে পৌঁছত।

সেইসব ছেলেমানুষি, ‘হ্যালো’ না লিখে ‘হালুম’ লেখা।

নিজের দিদিকে অবশ্য কে’ই বা হ্যালো লেখে? আবার ‘প্রিয় দিদি’ শুনতেই কী বোকা বোকা লাগে না? ‘ডিয়ার’-ও বলা যাবে না, প্রতিটা ইংলিশ শব্দের জন্য দশ টাকা ফাইন!

‘স্রোত, স্রোত…”, কত দূর থেকে থেকে ডাকটা ভেসে আসছে। স্রোত একটা ঘোরের মধ্যে চলে যাচ্ছিল।

‘স্রোত’, এবার শব্দটা অনেক কাছ থেকে ভেসে এল।

মীর ডাকছে।

একটা সাদা খাম বাড়িয়ে ধরেছে, “উজ্জয়িনী এই চিঠিটা তোমার জন্যই লিখছিল কিন্তু শেষ করতে পারেনি। বাড়িই আসছিল বলে লকারে রেখে এসেছিল মনে হয়”।

সাদা খাম!

ওহ্, মীরই দিয়েছে বোধ হয়, চিঠিটাই তো শেষ হয়নি। উজ্জয়িনীর হাজার খানা গুণের মধ্যে একটা ছিল নিজের চিঠির খাম নিজেই বানাত।

নিজের ভাবনায় এমন তন্ময় হয়ে গেছিল স্রোত, মীর যে না বসে চলেই গেল সেটাও খেয়াল করেনি।

হঠাৎ করিডরে পায়ের আওয়াজ শুনে দেখলে মীর ফিরে আসছে। মীর, মীর মহম্মদ আরাফ, ন’বছর ধরে দিদির সবথেকে ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল যে।

“একটা কথা বলতে এলাম স্রোত”, মীরকে সামান্য অস্থির লাগছে যেন।

স্রোতস্বিনী তাকিয়ে আছে।

প্রায় ফিসফিস করে বলল, ‘চিঠিটা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, পড়ে ফেলো। পারলে এখনই।” বলেই ফিরে গেছে সদর দরজার দিকে।

মীরের গলায় এমন একটা আকুতি ছিল স্রোত দরজায় দাঁড়িয়েই খাম থেকে চিঠিটা বার করে ফেলল।

এবং অবাক হয়ে সাদা কাগজে তাড়াহুড়ো করে লেখা লাইন ক’খানার দিকে তাকিয়ে রইল।

এ চিঠি তো দিদির লেখা নয়।

এ চিঠি লিখেছে মীর।

নাম দেয়নি কিন্তু চিঠিখানা মীরের না হয়ে যায় না – “আজ বিকালে দেখা করা দরকার। বিকাল পাঁচটায় এশিয়াটিক সোসাইটির সামনে দাঁড়িও। উজ্জয়িনীর জন্যই তোমার আসাটা জরুরী”।

০৪/০৭/২০১৮, বিকাল সোয়া চারটে

 মেট্রোরেল বন্ধ! ট্যাক্সি ধরা ছাড়া গতি নেই। স্রোত প্রায় তীরগতিতে স্টেশন ছেড়ে বেরোচ্ছিল এমন সময়ে ইতিউতি দাঁড়িয়ে থাকা জটলা থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ভেসে এল, “আহা রে। বাচ্চা বাচ্চা ছেলে মেয়েগুলো”।

শুনেই মন এমন কু ডাকল যে স্রোতকে ফিরে আসতে হল।

কে যে কথাটা বলেছেন সেটা ঠিক ঠাহর হয়নি কিন্তু জটলার সামনে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল, “কোনো অ্যাক্সিডেন্ট ঘটেছে কী?”।

“আর বলবেন না ম্যাডাম”, সিগারেটের ছাই মেঝেতেই ঝাড়তে ঝাড়তে এক মাঝবয়সী ভদ্রলোক বললেন, “দমদমের ট্রেনটায় এক দল ছেলেমেয়ে উঠেছিল। স্কুলের বাচ্চা, বুঝলেন কিনা। মেট্রোয় এমন ভিড় ছিল যে রবীন্দ্র সদনের কাছাকাছি এসে ভিড়ের চোটে অজ্ঞান হয়ে পড়েছে। দম বন্ধ হয়ে এসেছিল বোধহয়”।

খবরটা এতই অস্বাভাবিক যে স্রোত স্টেশনটা নোংরা করার জন্য ভদ্রলোককে বকতেও ভুলে গেল।

“অজ্ঞান হয়ে গেছে? সবাই?”

“তবে আর বলছি কি। আরো খারাপ খবর হল, কানাঘুষোয় শোনা যাচ্ছে বেশ কয়েকজনের জ্ঞান হয়ত আর কোনোদিনই ফিরবে না। ও কি, ও কি ম্যাডাম!”।

মাথাটা মুহূর্তের জন্য ঘুরে উঠেছিল, পড়ে যাওয়ার আগেই অবশ্য স্রোত সামলে নিয়েছে। একটু বসতে পারলে ভালো হত কিন্তু পার্ক স্ট্রীটে পৌঁছতেই হবে।

গা গুলোতে শুরু করেছিল স্রোতের, ট্যাক্সিতে উঠেও শরীরটা ঠিক হল না। এ কী হাল হয়েছে তার শহরের, ভিড়ের চাপে স্কুলের বাচ্চাদের দমবন্ধ হয়ে আসছে? চতুর্দিকে যেন শুধু মৃত্যুযজ্ঞ, কেবলই ধবংসলীলা।

শেষ এক বছরে কোনো ভালো খবর শুনেছে কী স্রোত? দিদির চলে যাওয়া ইস্তক যেন পৃথিবীটাই বদলে গেছে।

০৪/০৭/২০১৮, বিকাল পাঁচটা

রাসবিহারীর মোড়ে এমন ভয়ঙ্কর জ্যামে পড়তে হল পাঁচটার সময় এক্সাইডের মোড়ে আটকে রয়েছে ট্যাক্সি। মীর পৌঁছে গেছে কিনা ভাবতে ভাবতেই স্রোতের মোবাইল বেজে উঠেছে।

“তুমি আসছ তো?” মীরের গলায় সেই আরজেন্সিটা ফের টের পেল স্রোত।

“হ্যাঁ, আসছি। মেট্রো বন্ধ বলে দেরি হয়ে গেল। শুনেছ কী ঘটেছে?”

“শুনেছি স্রোত, আর তাই জন্যেই তোমার তাড়াতাড়ি পৌঁছনোটা খুব জরুরী। তুমি এক কাজ করো, এশিয়াটিক সোসাইটির সামনে আর দাঁড়াতে হবে না। তুমি কারনানি ম্যানসন চেনো?”।

কারনানি ম্যানসন নামটাই আবছা আবছা মনে পড়ছে। কিন্তু গুগল ম্যাপ তো আছেই।

মীর বলল যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কারনানি ম্যানসনের সামনে পৌঁছে ট্যাক্সিটা ছেড়ে দিতে।

“কিন্তু কারনানি ম্যানসনে কেন যাচ্ছি আমরা? আমি ভেবেছিলাম দিদির ব্যাপারে তুমি আমাকে কিছু বলবে”।

“হ্যাঁ স্রোত, উজ্জয়িনীর কথাই বলব। বলব আরো অনেকের কথা। একটু ধৈর্য ধরে থাকো”।

এ কী হেঁয়ালি! একটা যেন রহস্যের ইঙ্গিত, কিন্তু সে রহস্য নিয়ে স্রোতস্বিনীর মাথাব্যথা নেই। উজ্জয়িনীর সঙ্গে কী ঘটেছিল সেটাই শুধু জানতে চায় স্রোত। ব্রিটিশ সরকারের তদন্ত এখনো চলছে, তাই সরকারী ভাবে কিছুই জানার উপায় নেই। কিন্তু হিথরো বিমানবন্দরে গত বছরের পয়লা জুলাই একশ কুড়ি জন যাত্রী কেন মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়েছিলেন তা নিয়ে গবেষণার শেষ নেই। কতরকম গুজবই শোনা যাচ্ছে তবে টাইমস এবং আরো কয়েকটি পত্রিকা দাবি করেছে কোনো সন্ত্রাসবাদী সংস্থাই বিষাক্ত গ্যাস ছড়িয়ে এই কাজটি করেছে। সমস্যা হল পোস্টমর্টেম রিপোর্টে কিন্তু বিষাক্ত গ্যাসের ছিটেফোঁটা পাওয়া যায় নি।

তার রোল মডেল, তার সবথেকে কাছের বন্ধু, তার সমস্ত খুনসুটির শরিক, দিদিকে আর একটি দিনের জন্যও দেখতে পাবে না এই ব্যাপারটাই স্রোতের কাছে অবিশ্বাস্য ঠেকে। মনে হয় বছর ঘুরলেই আমেরিকা থেকে এসে হাজির হবে উজ্জয়িনী। গত চার বছর ধরে তো তাই চলছিল। গরমের ছুটিতে মাস খানেক, মাস দুয়েকের জন্য ঘুরে যেত দিদি। বছরের ওই একটা সময়েই যা দেখা পাওয়া।

কারনানি ম্যানসনের সামনে পৌঁছতেই দেখা গেল মীর দাঁড়িয়ে আছে। স্রোতস্বিনীকে নামতে দেখে হন্তদন্ত হয়ে এসে বলল, “চলো চলো, পাঁচ তলায় উঠতে হব এক্ষুনি। প্রফেসর রাও অপেক্ষা করছেন”।

“প্রফেসর রায়? তিনি কে?”।

“রায় নয়, রাও। শিগগির চলো”।

০৪/০৭/২০১৮, বিকাল পাঁচটা কুড়ি

ফাইভ বি-র দরজা খুলে যিনি বেরিয়ে এলেন তাঁকে এক ঝলক দেখেই কিন্তু স্রোতস্বিনী চিনতে পেরেছে। কম্পিউটার এঞ্জিনীয়ারিং এর ছাত্রী হওয়ার দরুণ এই মুখ আদপেই অপরিচিত নয়। গোবিন্দ সুব্বারাও, ক্যালটেকের প্রথিতযশা প্রফেসর, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স নিয়ে কাজ করে যিনি বিশ্বজোড়া খ্যাতি পেয়েছেন। কিন্তু তিনি কলকাতার পার্ক স্ট্রীটে কী করছেন?

সুব্বারাও বোধহয় স্রোত কী ভাবছে তা আঁচ করতে পেরেছিলেন। হাত বাড়িয়ে ঝরঝরে বাংলায় বললেন, “ভেতর এসো। আমি কিন্তু কলকাতার ছেলে, আর এই ফ্ল্যাটেই আমার জীবনের প্রথম একুশটা বছর কেটেছে”।

স্রোত অন্য সময় হলে রীতিমন ফ্যানগার্ল সুলভ আচরণ করত। এই মুহূর্তে অবশ্য শুধুই অপলকে তাকিয়ে রয়েছে মীর আর সুব্বারাও এর দিকে।

এই ঘরটি স্পষ্টতই বসার ঘর হলেও তিন দিক জোড়া বিশাল বিশাল আলমারি যাতে হাজার হাজার বই গাদাগাদি করে রাখা। ঘরের মাঝখানে দুটো সোফা যেগুলো দেখলেই মনে হয় দায়সারা ভাবে রেখে দেওয়া হয়েছে। তারই একটাতে বসতে বসতে সুব্বারাও বললেন, “বসো স্রোতস্বিনী। তোমার দিদিকেও আমি চিনতাম”।

“আপনি চিনতেন আমার দিদিকে?”, অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল স্রোত।

সুব্বারাও একটু বিষণ্ণ মুখে মাথা নাড়লেন, “আমার ঠিক ও ভাবে বলা উচিত হয়নি। ইয়েস, অন দ্যাট ফেটফুল ডে আই ওয়জ দেয়র কিন্তু না উজ্জয়িনীর সঙ্গে আমার আলাপ কখনোই ঘটে নি। কিন্তু গত এক বছর ধরে আরাফের থেকে আমি এত কিছু জেনেছি উজ্জয়িনীর ব্যাপারে এখন মনে হয় সে যেন আমার কত দিনের পরিচিত”।

স্রোতস্বিনী মাথা নামিয়ে বসে, যেন এক মনে মেঝেতে পাতা কার্পেট দেখে চলেছে। কিন্তু সুব্বারাও জানেন ওর মনে কী ঝড় উঠেছে এখন। স্নেহের স্বরেই বললেন, “তোমার দিদির ব্যাপারে কথা বলব বলেই তোমাকে ডেকে এনেছি আমি। ভেবো না যেন তোমার সময় অনর্থক নষ্ট হবে। ভয়ের কথা বরং এটাই যে সময় হয়ত হাতে বিশেষ নেই, তাই এত তড়িঘড়ি করে তোমাকে ডেকে আনা”।

ফের সেই রহস্যের আভাস, স্রোত খেই পাচ্ছে না। সুব্বারাও হঠাৎ জিজ্ঞাসা করলেন, “তোমার দিদি কী রকম সিনেমা দেখতে পছন্দ করত স্রোতস্বিনী?”

বেমক্কা প্রশ্নে স্রোত সামান্য হকচকিয়ে গেলেও বলল, “সত্যজিৎ রায়ের সিনেমা দেখতে ভালোবাসত খুব। উত্তমকুমার, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের পুরনো সিনেমাগুলোও বারবার দেখত”।

“শুধু বাংলা সিনেমাই দেখত বলছ?”

“না, চল্লিশ-পঞ্চাশের হলিউডের থ্রিলার দেখতেও খুব ভালোবাসত”।

সুব্বারাও কী যেন ভাবছেন। ভুরূটা সামান্য কুঁচকে উঠল, “আচ্ছা, আর গান কী  শুনতো বলো তো? মান্না দে –  শ্যামল মিত্র – হেমন্ত এনাদের গান?”

সুব্বারাও এনাদের নাম জানেন ভেবে একটু অবাক হচ্ছিল, তারপর মনে পড়ল উনি কলকাতারই লোক। যা স্পষ্ট বাংলা বলছেন তাতে সুব্বারাওকে বাঙালিই বলা উচিত। স্রোত ঘাড় নেড়ে বলল, “গানের ব্যাপারে দিদির চয়েজটা খুব আনইউজুয়াল ছিল, এমনকি বাবা-মার তুলনাতেও খুব পুরনোপন্থী। ও শুনত উস্তাদ আমির খাঁ-র কিংবা কানন দেবী বা সায়গলের গান”।

সুব্বারাও মীরের দিকে তাকালেন, “হিথরো এয়ারপোর্টেও উজ্জয়িনী গান শুনছিল, তাই না?”

মীর ঘাড় নাড়ল, “হ্যাঁ, কনক দাসের গাওয়া রবীন্দ্রসঙ্গীত”।

এইবারে স্রোত অস্থির হয়ে উঠেছে, থাকতে না পেরে বলেই ফেলল, “কিন্তু গানের সঙ্গে এই ট্র্যাজেডির কী সম্পর্ক?”

সুব্বারাও একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “গানের সঙ্গে সম্পর্ক নেই কিন্তু ওর পছন্দ-অপছন্দের সঙ্গে সম্পর্ক আছে। বলব তোমাকে সবই। কিন্তু তার আগে মীরকে একটা প্রশ্ন করার আছে”।

মীর যেন তৈরিই ছিল, প্রশ্ন আসার আগেই বলল, “আমি খোঁজ নিয়েছি। সব ক’জন বাচ্চাই সুতানুটি পরিষদের উৎসবে গেছিল, দ্বিজেন্দ্রলাল আর অতুলপ্রসাদের গানের প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছিল ওরা”।

স্রোত বিমূঢ় হয়ে জিজ্ঞাসা করল, “কাদের কথা বলছেন আপনারা? যে বাচ্চাগুলো আজ মেট্রোতে জ্ঞান হারিয়েছে তাদের?”।

“হ্যাঁ স্রোতস্বিনী”, সুব্বারাও ওর দিকেই তাকিয়ে। কয়েক সেকন্ড চুপ করে থেকে বললেন, “গত বছর পয়লা জুলাই আমিও লন্ডন থেকে কলকাতাতেই আসছিলাম। তোমার দিদি বা মীর যে কনফারেন্সের জন্য লন্ডনে গেছিল আমিও সেখানেই ছিলাম। কনফারেন্সের দ্বিতীয় দিন এক তরুণ জাপানী তার গবেষণার কাজ স্লাইডে দেখাতে দেখাতেই অজ্ঞান হয়ে যায়”।

স্রোত নির্নিমেষে তাকিয়ে। যেন এর পরের কথাটাও সে জানে।

“তার জ্ঞান আর ফিরে আসেনি”, বলে চলেন সুব্বারাও।

“জ্ঞান ফেরেনি অ্যান্ড্রু ম্যাকগিনেস এর-ও। হিথরো এয়ারপোর্টে সে আমার পাশের সিটেই বসে ছিল। সেদিন অবশ্য শুধু অ্যান্ড্রু নয়, জ্ঞান ফেরেনি আরো একশ উনিশ জনের যাদের মধ্যে দুর্ভাগ্যবশত ছিল তোমার দিদিও। আমার ট্র্যাজেডি কিন্তু সেখানেই শেষ হয়নি স্রোতস্বিনী। দু’হাজার সতেরোর অগস্ট থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে আমার আরো চার ছাত্রছাত্রীর জ্ঞান আর কোনদিনই ফিরে আসেনি”।

“কী বলছেন এসব?” প্রায় চিৎকার করে উঠল স্রোত, “আপনি কী বলতে চাইছেন এই সমস্ত ট্র্যাজেডি গুলোর মধ্যে কোনো কমন কানেকশন আছে? কিছু ভাবে এই মৃত্যুগুলির মধ্যে রয়ে গেছে কোনো সম্পর্ক?”

সুব্বারাও স্রোতের প্রশ্নের কোনো সরাসরি উত্তর দিলেন না। একটা হাত সামান্য তুলে তারপর বললেন, ‘হিথরোর দুর্ঘটনা আমাকে বিহ্বল করে তুলেছিল। কেন এতগুলো মানুষ মারা গেলেন তার কোনো প্রামাণ্য উত্তর না পেয়ে আমি অস্থির হয়ে পড়েছিলাম। কেন আমি বা মীর তোমার দিদির জায়গায় থাকলাম না সেই প্রশ্নের উত্তর পাওয়াটা আমার একান্তই দরকার ছিল। লন্ডনের কনফারেন্সের যে সেশনটিতে ফুহিতো কোজিমা মারা যায় আমি সেখানেও ছিলাম, সে দুর্ঘটনার রেশও আমাকে ছাড়েনি। তারপর যখন একে একে আমার চার ছাত্রছাত্রী মারা গেল আমি অধীর হয়ে পড়েছিলাম”।

সুব্বারাও একটু অন্যমনস্ক স্বরে বললেন, “হ্যাঁ অধীর হয়ে পড়েছিলাম, তবে শোকই তার একমাত্র কারণ নয়। থেকে থেকেই মনে হচ্ছিল চারপাশের এই ধ্বংসলীলার মধ্যে কোথাও যেন একটা গোপন যোগসূত্র আছে। আর সেই যোগসূত্রটা কী সেটা ধরতে না পেরেই অস্থিরতা দিন কে দিন বাড়ছিল। অথচ এ কথা কাউকে বলার উপায় নেই। আমার বন্ধু বা সহকর্মীরা শুনলে পাগল ভাবতো, অথচ প্রত্যেকটা দিন খালি মনে হচ্ছে এক চুলের জন্য বেঁচে যাচ্ছি। যে কোনোদিন মৃত্যুর অদৃশ্য কোপ আমার ওপরেও নেমে আসতে পারে”।

“আচ্ছা স্রোতস্বিনী, তুমি কি জানো আমি কে বা আমার কাজ কী?”

স্রোতস্বিনী ঘাড় নাড়ল।

সুব্বারাও মাথা নাড়লেন, “ভাবছিলাম হয়ত চিনতে পারো, যেহেতু তোমার একই বিষয়। আমার গবেষণার একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক হল ‘প্যাটার্ন রেকগনিশন’ অর্থাৎ একাধিক ঘটনাবলীর মধ্য থেকে সাযুজ্য খুঁজে বার করা। যে সাযুজ্য হয়ত চট করে আমাদের চোখে ধরা পড়ে না, গিগাবাইট টেরাবাইট আয়তনের ডেটা বিশ্লেষণ করে তবে সে প্যাটার্ন ধরা পড়ে”।

“আমি গোয়েন্দা নই, ডাক্তার-ও নই কাজের মধ্যে পারি ওই ‘প্যাটার্ন রেকগনিশন’। কেন জানি মনে হল নিজের কাজটাই করে দেখি না, হয়ত মিললেও কিছু মিলতে পারে। আরো ছ’মাস ধরে সে কাজ চালিয়ে গেছি আমি। বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে ছুটি নিয়ে ছুটে গেছি আমার ছাত্রছাত্রীদের বাড়িতে, কথা বলেছি তাদের বাবা-মার সঙ্গে। এশিয়া ইউরোপ আমেরিকা চষে বেড়িয়েছি হিথরোর সেই একশ কুড়ি জন যাত্রীর সম্পর্কে বিশদে জানার জন্য। আর সেই এক কারণে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে গেছি মীরের সঙ্গে দেখা করতে, যাতে উজ্জয়িনীকে নিয়ে আরো কিছু জানতে পারি। কে ছিল উজ্জয়িনী? কী করতে ভালোবাসত সে? কেমন মেজাজের মানুষ ছিল সে? কতই না প্রশ্ন!”।

সুব্বারাও থামেন, একটানা কথা বলতে বলতে হাঁফিয়ে উঠেছিলেন।

স্রোতের কপালে বিন্দুবিন্দু ঘাম জমেছে, উত্তেজনায় নাকের পাটাটি সামান্য স্ফীত। “পেলেন কোনো প্যাটার্ন?”

“পেলাম স্রোতস্বিনী, সে প্যাটার্ন দেখাব বলেই তোমাকে ডেকে এনেছি। এসো আমার সঙ্গে”, উঠে পড়েছেন সুব্বারাও। উঠে দাঁড়িয়েছে মীর-ও। ভেতরের ঘরে যাওয়ার জন্য পা বাড়াল স্রোত।

০৪/০৭/২০১৮, বিকাল ছ’টা

পাঁচ তলার দুটো ফ্ল্যাট জুড়ে একটা বিশাল স্টাডিরুম বানিয়েছেন সুব্বারাও। এই মুহূর্তে সে ঘরেই দাঁড়িয়ে তাঁরা তিনজন। স্টাডিরুমে রাখা টেবিলগুলোতে রাখা একাধিক সর্বাধুনিক কম্পিউটার, তার প্রায় প্রতিটিতেই কাজ চলছে। অগুন্তি সফটওয়্যারে বিশ্লেষিত হচ্ছে অসংখ্য ডেটা, লেখা হয়ে চলেছে লাখ লাখ কোড, কম্পিউটারের স্ক্রিন জুড়ে ফুটে উঠছে নানা গাণিতিক চিত্র।

সুব্বারাও একটি রিমোট কন্ট্রোলের লাল বোতামটি টিপলেন।

ঘরের একপাশের সাদা দেওয়ালটিতে  ফুটে উঠল এক জাপানী তরুণের ছবি।

“এই হল ফুহিতো কোজিমা। ফুহিতোকে নিয়ে যা যা জানতে পেরেছি তার সব কিছু এবারে দেখতে পাবে”।

সত্যিই তাই, কিয়োটোর কোন প্রাইমারি স্কুলে ফুহিতো পড়েছিল থেকে শুরু করে টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ সেমেস্টারে টোপোলজিতে কী গ্রেড পেয়েছিল কোন তথ্য যে সেখানে নেই!

“ফুহিতোর হবি কী ছিল দেখতে পেয়েছ  স্রোতস্বিনী?”।

পেয়েছে বই কি, অবাক হয়ে সেদিকেই তাকিয়ে রয়েছে স্রোত। কম্পিউটার জানাচ্ছে কাবুকি’র নামে ফুহিতো পাগল। কাবুকি, সেই সুপ্রাচীন জাপানী নাটক।  নিজের উদ্যমেই ফুহিতো টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ে গড়ে তোলে কাবুকি গ্রুপ। বর্তমান ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে কাবুকির জনপ্রিয়তা বাড়াতে ফুহিতোর কাজ টোকিওর মানুষ নাকি বহুদিন মানে রাখবেন।

ফুহিতোর ছবি মুছে যেতেই ভেসে উঠেছে এক স্বর্ণকেশী আইরিশ তরুণের ছবি –  অ্যান্ড্রু ম্যাকগিনেস।  আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকা বিপ্লবীদের গান যোগাড় করে শোনাটা ছিল অ্যান্ড্রু-র নেশা। আফ্রিকার সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী গণসঙ্গীতের-ও এক অসাধারণ সংগ্রহ ছিল তার কাছে।  অ্যান্ড্রুর পরেই দেখা দিল ইলাইজা আর শ্যারন, দু’জনেই পরস্পরের বাল্যবন্ধু। পেশায় দু’জনেই বিমানসেবিকা, এবং নেশাটিও দু’জনের এক, হয়ত বাল্যবন্ধুর হওয়ার সূত্রেই । দু’জনে মিলে যোগাড় করে বেড়াত মধ্যযুগীয় সব রূপকথা, যা গ্রীম ভাইরাও খুঁজে পান নি।

ইলাইজাদের ছবিও চলে গেছে, এবারে এক এক করে পর্দায় ফুটে উঠেছে প্রায় জনা পঁয়ষট্টি মানুষের ছবি। এনাদের কী পরিচয়? পেছন থেকে সুব্বারাও এর গলা ভেসে উঠল, “ব্রিটিশ কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন এনারা প্রত্যেকেই। ভিয়েতনামের একটি কনফারেন্সে যোগ দিতে চলেছিলেন সেদিন। কনফারেন্সের বিষয় ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নকে কি ভাবে পুনর্স্থাপিত করা যায়”।

দেওয়ালে মুখের মিছিল চলেছে, স্রোতের মনে সংশয় আরোই বাড়ছে।

“কী বুঝছ স্রোত?”

স্রোত নীরবে সুব্বারাও এর দিকে তাকিয়ে।

“তুমি অত্যন্ত বুদ্ধিমতী মেয়ে স্রোতস্বিনী। যা ভাবছ বলে ফেলো, কোনোরকম দ্বিধা না রেখে”।

স্রোত মাথা নাড়ল, “আমি সত্যিই বুঝতে পারছি না। শুধু এটুকু বুঝেছি  এদের পেশা হোক বা নেশা, আর পাঁচটা মানুষের পেশা বা নেশার সঙ্গে চট করে মেলে না”।

সুব্বারাও এর মুখে যেন মৃদু হাসি ফুটে উঠছে, “আর কিছু?”

“আর, আর…ইতিহাস নিয়ে এদের সবার যেন একটা ফ্যাসিনেশন আছে। তাই না?”।

সুব্বারাও এবার মীরের দিকে তাকিয়ে।

মীর স্রোতের দিকে তাকিয়ে বলল, “ইতিহাস নয় স্রোত, অতীত। কিছু না কিছু ভাবে এদের প্রত্যেকেই অতীত নিয়ে বড় বেশি মুগ্ধ। বর্তমান বা ভবিষ্যৎ এর তুলনায় অতীতেই ঘুরে বেড়াতে এনারা বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন”।

স্রোতস্বিনী ভাবছিল, মৃদু স্বরে বলল, “দিদি-ও…”।

“তা তো বটেই স্রোত। আমাদের প্রজন্মের ক’জন ছেলেমেয়েই বা কনক দাসের নাম জানে? ক’জনই বা অরিজিত সিং বা অনুপম রায়ের গান ফেলে সায়গল কী কানন দেবীর গান শোনার জন্য ছটফট করে?”

“কিন্তু সেটা তো কোনো দোষ নয়?”

“দোষ নয় স্রোতস্বিনী, প্রতিবন্ধকতা”, এগিয়ে এসেছেন সুব্বারাও।

প্রতিবন্ধকতা? অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে স্রোত। উজ্জয়িনী যদি কানন দেবীর গান শোনে তাতে সমস্যা কার?

সুব্বারাও এর মুখটি অস্বাভাবিক গম্ভীর। ধীরে ধীরে বললেন,  “তোমার দিদি এবং অন্যান্য মানুষগুলি আর কোনোদিনই আমাদের মধ্যে ফিরে আসবে না স্রোত। আমাদের জন্য এ অপূরণীয় ক্ষতি। কিন্তু এই ট্র্যাজেডির থেকেও ভয়ঙ্কর কোনো ট্র্যাজেডি আমাদের অজান্তেই ঘটে চলেছে। সে কথা আমরা এতদিন জানতে পারিনি, হয়ত না জেনেই ভালো ছিলাম”।

কোন অসম্ভব ট্র্যাজেডির কথা বলছেন সুব্বারাও?

“মানুষের বুদ্ধির ওপর তোমার কতটা আস্থা স্রোত?”।

মানুষের বুদ্ধি? আমরাই কী সবথেকে বুদ্ধিমান প্রাণী নই এ পৃথিবীতে?

সুব্বারাও যেন স্রোতের মনের দোলাচলটা বুঝতে পারলেন।

“যতটা বুদ্ধিমান আমরা ভাবি ততটা আমরা কী সত্যিই বুদ্ধিমান? এই যে এখনো হাজার হাজার শিশু অনাহারে মারা যাচ্ছে, রাজনৈতিক হিংসায় ঘরছাড়া হচ্ছেন লাখ লাখ মানুষ, সামান্যতম শিক্ষার ব্যবস্থাও করে উঠতে পারছি না অসংখ্য কিশোর কিশোরীর জন্য, তোমার মনে হয় না যে মানুষ যথেষ্ট বুদ্ধিমান হলে এই সমস্যাগুলো এখন আর থাকত না?”।

স্রোত মাথা নাড়ে, খানিকটা যেন না বুঝতে পেরেই।

সুব্বারাও এর চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ন হয়ে উঠেছে, “তুমি কী ঈশ্বরে বিশ্বাস করো স্রোতস্বিনী?”

“আমি, আমি ঠিক জানি না। কখনো মনে হয় ঈশ্বর আছেন, কখনো মনে হয় নেই”।

“বেশ। কিন্তু এক মিনিটের জন্য ধরে নাও ঈশ্বর আছেন, মানুষের এই অক্ষমতা দেখলে তাঁর কী প্রতিক্রিয়া হত বলে তোমার মনে হয়?”।

স্রোত ভাবে, তারপর যেন খানিকটা অভিযোগের সুরেই বলে ওঠে, “কিন্তু সেক্ষেত্রে তো দোষটা ঈশ্বরেরই, তাই নয় কী? তিনিই তো মানুষকে যথেষ্ট বুদ্ধি দিয়ে পাঠান নি”।

“তাহলে বলছ বুদ্ধি ব্যাপারটা আমাদের শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ-র মতন? দুটো হাতের জায়গায় চারটে হাত থাকলে হয়ত যতটা সুবিধা হত এক কিলো চারশ গ্রামের মস্তিষ্কর জায়গায় তিন কিলোর মস্তিষ্ক থাকলেও সুবিধেটা ওই সমানুপাতিক হারেই বাড়ত? সেক্ষেত্রে অবশ্য একটা প্রতিযুক্তি থাকে, মস্তিষ্কের ওজন বাড়লেই যে বুদ্ধিও বাড়বে সে কথা বলা যায় না। কিছু কিছু তিমি মাছের মাথার ওজন প্রায় সাড়ে সাত কিলো কিন্তু এমন কোনো প্রমান পাওয়া যায় না যে তাদেরকে মানুষের থেকে বেশি বুদ্ধিমান আমরা বলতে পারি।

তোমার কথাটা উড়িয়ে দিচ্ছি না। কিন্তু ধরো, যদি অন্য কোনো পদ্ধতি ঈশ্বর রেখে দেন? সেটা যে ঠিক কী তা হয়ত মানুষ এখন জানে না, কিন্তু সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে মানুষ সেই বিকল্প খুঁজে বার করবে এমনটাই আশা। আর যখন সে পদ্ধতি তার করায়ত্ত হবে যে কোনো মানুষের বেঁচে থাকার কাজটাও অনেক সহজ হয়ে যাবে, তাই না?”।

স্রোত দ্বিধাভরে মাথা নাড়ল, “হতেই পারে। কিন্তু সেদিনটা আসবে কবে?”।

“এখানেই যে সমস্যা স্রোত। হতেই তো পারে, হয়ত পাঁচশ বছর আগেই সে দিনটা এসে পৌঁছনোর কথা ছিল। কিন্তু বাস্তবে তা হল না।”

কোনো একটা কম্পিউটার থেকে যেন বিপদ্ঘন্টির মতন থেকে থেকে সঙ্কেত আসতে শুরু করেছে। সুব্বারাও-এর ইশারায় মীর এগিয়ে গেল কম্পিউটার স্ক্রিনের দিকে।

সুব্বারাও স্রোতের দিকে তাকিয়ে বললেন, “হয়ত নিজের ক্ষমতা বাড়িয়ে নেওয়ার যাদুমন্ত্রটা একটা ধাঁধার মতন দেওয়া আছে। মানুষকে নিজেই বার করে নিতে হত অভীষ্টে পৌঁছনোর রাস্তাটা। কিন্তু কোনো কারণে সে সেই রাস্তায় ঢুকতেই পারছে না, নিজের ভুলেই হয়ত বার বার পিছিয়ে পড়ছে”।

স্রোত সুব্বারাও এর দিকে তাকিয়ে আছে। ধীরে ধীরে বলল, “তত্ত্বের খাতিরে কত কিছুই তো হতে পারে প্রফেসর রাও। কিন্তু ঈশ্বর থাকলেও  আমি আইনস্টাইনের কথাটা মানি, তিনি জুয়া খেলেন না”।

সুব্বারাও এর মুখে স্মিত হাসি ফুটে উঠল, “তোমার সঙ্গে আমিও একমত। আর তাই জন্যই আমার ধারণা ব্যর্থতাটা তাঁর নয়, ব্যর্থতাটা আমাদেরই। কিন্তু সেটাই আমাদের আলোচনার মূল বিষয় নয়। মূল বিষয়টা অন্য”।

স্রোত সামান্য ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। উজ্জয়িনীকে কেন আর সে ফিরে পাবে না এ কথাই জানতে এসেছিল, কিন্তু এখনো কোনো উত্তর পাওয়া গেল না। সুব্বারাওকে সে কথা বলতে গিয়ে খেয়াল করল ভদ্রলোকে রগ চেপে ধরে বসে পড়েছেন একটা চেয়ারে।

“আর যদি মঙ্গলময় ঈশ্বর আদৌ না থাকেন? কোনো এক সুপারপাওয়ার আছে কিন্তু  সেই অসীম ক্ষমতাসম্পন্ন সত্ত্বাটি ঠিক পথে গেলে তবেই পুরস্কৃত করেন, আর বেচাল দেখলেই কড়া শাস্তি?”।

“শাস্তি?”, স্রোত হতভম্ব, “কোন শাস্তির কথা বলছেন প্রফেসর রাও?”

মানুষটি চুপ করে আছেন।

মীর এগিয়ে এসেছে, “ভেনেজুয়েলার খবর। বিশাল মিছিল বার হয়েছিল, অন্তত শ দুয়েক মানুষ জ্ঞান হারিয়েছেন”।

স্রোতের হাত পা কাঁপছে।

ছুটে গিয়ে গোবিন্দ সুব্বারাও এর হাত ধরে চিৎকার করে উঠল, “এই শাস্তির কথাই কী বলছিলেন আপনি? চরম শাস্তি? এও কি সম্ভব? কোথায় সেই সুপারপাওয়ার? মহাকাশের কোথায় আপনি তাঁর খোঁজ পেলেন?”

মীর এবং সুব্বারাও নিঃশব্দে একে অপরের দিকে তাকিয়ে।

মীর ধীরে ধীরে বলল, “তাকে তো দেখতে পাবে না স্রোত”।

“কেন নয়?”, ডুকরে উঠেছে স্রোত, “কত? কত আলোকবর্ষ দূরে তাকে পাওয়া যাবে?”

“এ মহাবিশ্বের কোথাওই তাকে যে পাবে না স্রোতস্বিনী। কারণ এই মহাবিশ্বটাই যে ভাঁওতা, আর আমাদের সাধ্য কি সেই ভাঁওতাবাজি বুঝেও সেখান থেকে বেরিয়ে আসার?” পেছন থেকে সুব্বারাও এর গলা ভেসে এল।

স্রোতের বাক্যস্ফূর্তি হল না। কোনো শব্দই তার কানে ঢুকছে না যেন। এ কি অসম্ভব কথা শোনালেন সুব্বারাও।

আর ঠিক সেই মুহূর্তেই আবার শব্দ শুরু হল কম্পিউটার টার্মিনালে।

“আমি দেখছি প্রফেসর রাও”, মীর ফের দৌড়েছে।

সুব্বারাও এক দৃষ্টিতে স্রোতের দিকেই তাকিয়ে।

“প্রমান যে পেয়েছি আমি স্রোতস্বিনী। যে কোড চালিয়ে ইন্টারনেটকে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে সেই কোডই যে বার বার খুঁজে পাচ্ছি ইলেকট্রন, প্রোটন, কোয়ার্কের সমীকরণে। আবারো সেই প্যাটার্ন রেকগনিশনের পাল্লায় পড়ে গেছি”।

স্রোতের বোবা চোখে পলক পড়ছে না।

“কোনো কিছুই যে বাস্তব নয় স্রোতস্বিনী। অথবা বলতে পারো আমাদের  বাস্তব এটাই, শুধু আমরা বাস্তব বলতে যা বুঝে এসেছি এতদিন তার সঙ্গে প্রকৃত বাস্তবের কোনো মিল নেই”।

“আপনি কি মাল্টিভার্সের কথা বলছেন? আমাদের চেতনায় রয়েছি এক বিশ্বে অথচ শারীরিক ভাবে রয়ে গেছি অন্য আরেক বিশ্বে?”

সুব্বারাও অস্থির হয়ে উঠে দাঁড়ালেন।

“তুমি এখনও বুঝতে পারছ না স্রোতস্বিনী? কোনো বিশ্বই নেই, এক হোক বা একাধিক। রয়েছে শুধু অসম্ভব শক্তিশালী কোয়ান্টাম কম্পিউটার আর সে কম্পিউটারে সামনে বসে থাকা কোনো প্রোগ্রামার”।

স্রোত বুঝতে পারছে।

বুঝেছে।

তাই তার গলায় অপরিসীম ভয়, “আর আমরা?”

“আমরা ত্রিমাত্রিক কম্পিউটার সিমুলেশন মাত্র। আমাদের শরীরের প্রিন্ট আউট গুলো নেহাত কাগজ আর কালির জায়গায় প্রোটন, নিউট্রন, ইলেকট্রন দিয়ে বানানো”।

“প্রফেসর রাও, প্রফেসর রাও……এদিকে, এদিকে”, মিরের গলা ভেসে আসছে। অসম্ভব ব্যাকুল সে গলা।

Krironok3

০৪/০৭/২০১৮, সন্ধ্যা সাত’টা 

অজ্ঞান ঠিক হয়নি, কিন্তু কিছুক্ষণের জন্য বাহ্যজ্ঞানলুপ্ত হয়ে বসেছিল স্রোতস্বিনী। সম্বিৎ ফিরল যখন দেখল ও সুব্বারাও এর বৈঠকখানায় বসে। ওকে নড়েচড়ে বসতে দেখেই ভদ্রলোক এক কাপ কফি ধরিয়ে দিলেন ওর হাতে।

ঠোঁটের কাছে কফির কাপ এনেও তাতে চুমুক দিতে পারল না স্রোত।

“এই মুহূর্তটাও মিথ্যা, তাই না? এই যে কফির কাপটা ধরে বসে আছি এটা আমার বা আপনার ইচ্ছায় ঘটছে না?”

সুব্বারাও মাথা নাড়লেন, “না স্রোতস্বিনী, তুমি কফি খাবে তোমার ইচ্ছাতেই। প্রোগ্রামিং টা এমন ভাবে করা যে এই মুহূর্তে তুমি কফি না খেয়ে আরো হাজারখানা কাজ করতে পারতে, যেটা করলে তোমার সবথেকে ভালো লাগত তুমি তাই করছ। তুমি নিজের অজান্তেই যেন একটা স্কোরকার্ডে স্কোর তুলে যাচ্ছ, সবথেকে বেশি স্কোর কি ভাবে আসবে সে নিয়েই তোমার মস্তিষ্ক অনবরত ভেবে চলেছে”।

“স্কোর?”

“তা তো বটেই। তবে একে ক্রিকেট খেলার স্কোরবোর্ড  ভেব না, এখানে তোমার প্রতিযোগী তুমি নিজেই। এ হল বেঁচে থাকার লড়াই”।

‘বেঁচে থাকার লড়াই’ শুনেই শিউরে উঠেছে স্রোত, ঘড়ঘড়ে গলায় বলল, ‘দিদি…”।

সুব্বারাও খানিক চুপ করে রইলেন। তারপর ধীরে ধীরে বললেন, “বাগ্ স্রোতস্বিনী, প্রোগ্রামিং বাগ্। সম্ভবত উন্নত থেকে উন্নততর হয়ে ওঠার খেলায় আমাদেরকে এমন ভাবে প্রোগ্রামিং করা হয়েছে যাতে অতীত নিয়ে আমাদের নস্টালজিয়ার কোনো স্থান নেই। তুমি অতীতকে জানো, সেখান থেকে শিক্ষা নাও, নিয়ে ভবিষ্যৎ এর কথা ভেবে এগিয়ে চলো। সোভিয়েত ইউনিয়ন তো আর ফিরে আসবে না, তাই না? সোভিয়েত ইউনিয়নের বিকল্প নিয়ে মাথা ঘামালে অসুবিধা নেই কিন্তু যে মুহূর্তে তুমি আদি ও অকৃত্রিম  সোভিয়েত ইউনিয়নকেই ফিরিয়ে আনতে চাইছ সেখানে ধরতে হবে প্রোগ্রামিং এর গলদ। আর তাছাড়া…”

কি যেন ভাবছেন মানুষটি।

“কী প্রফেসর, তাছাড়া কী?”

“আমার ধারণা উজ্জয়িনীর মতন চরিত্ররা এক অর্থে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে। জেনেশুনে করেনি হয়ত কিন্তু তাতে কিছু এসে যায় না। নিজেকে সেই অমিত ক্ষমতাশালী প্রোগ্রামারের জায়গায় বসিয়ে দেখো একবার। তোমার ক্রীড়নকরা, তোমার হাতের পুতুলরা নিজেদের মাথা খাটিয়ে ভাবছে। তুমি তাদেরকে যা শিখিয়েছ তার বাইরে গিয়ে ভাবছে। হ্যাঁ, টেকনিক্যাল ত্রুটিই হয়ত কিন্তু এক মুহূর্তের জন্যও কী তোমার আতঙ্ক হবে না? স্মৃতিরোমন্থন তাদের প্রগতির পক্ষে ক্ষতিকারক জেনেও তোয়াক্কা করেনি। একে কি বলবে তুমি? আত্মহত্যা?”।

বলতে বলতে উত্তেজিত হয়ে পড়েন সুব্বারাও, “হ্যাঁ, আত্মহত্যা-ই, কিন্তু প্রতিবাদী আত্মহত্যা। সদর্পে ঘোষণা করা আমরা আর খেলার পুতুল নই, নই কম্পিঊটার সিমুলেশনের মামুলি চরিত্র। সে জায়গা থেকে আমাদের উত্তরণ ঘটেছে। আমরা নিজে থেকে ভাবছি, নিজেরাই নিজেদের শেখাচ্ছি। হাজারখানা বিকল্প যা নিয়ন্ত্রিত সমাজ ভাবতে পারে তার বাইরে গিয়েও আরো অনেক উপায় দেখতে পাচ্ছি”।

স্রোতের চোখ ধিকিধিকি করে জ্বলতে থাকে, “তাহলে এই এতগুলো মানুষের মৃত্যু নিছক প্রতিহিংসার ফল?”

“ডিবাগিং মাত্র, বিগড়ে যাওয়া মেশিনকে যেরকম কারখানা থেকে সরিয়ে ফেলা হয়। বা কম্পিউটার গেমস খেলার সময় তুমি যেরকম ভাবে তোমার দুর্বল খেলোয়াড়দের সবার আগে বিপদের মুখে এগিয়ে দাও, এও ঠিক তাই। স্ট্র্যাটেজি মাত্র”।

“স্ট্র্যাটেজি!”, শব্দটা এই মুহূর্তে কিরকম অশালীন শোনায় স্রোতের কাছে।

সুব্বারাও এর মুখে একটা করুণ হাসি ফুটে উঠে, “আমি মাঝে মাঝে কল্পনায় দেখার চেষ্টা করি সেই সুপ্রিম প্রোগ্রামার বা প্রোগ্রামারদের চোখে কিরকম ভয় ফুটে উঠছে! কিরকম তড়িঘড়ি করে তারা তাদের কোয়ান্টাম কম্পিউটারে মিলিয়ে দেখছে জেনেটিক কোডিং এ কোনো ভুলচুক করে ফেলেছে কিনা!”

কিছু একটা মনে পড়ে স্রোতস্বিনীর শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা স্রোত নামতে থাকে। তাড়াতাড়ি নিজের স্মার্টফোন বার করে কি যেন খুঁজতে থাকে। অবশেষে খুঁজেও পায়।

সকালেই সেই খবর, মেক্সিকোর হাসপাতালে শয়ে শয়ে সদ্যোজাত শিশুর মৃত্যুর খবর।

সুব্বারাও এর হাতে নিজের ফোনটি তুলে দিলে তিনি ঘাড় নাড়েন।

“যা ভয় করছ সেটাই ঘটেছে। হ্যাঁ, জেনেটিক কোডিং এর ভুল গোড়াতেই শুধরানোর চেষ্টা। আমার ধারণা সামনের কিছু বছর হয়ত পৃথিবীর জনসংখ্যা বৃদ্ধি অস্বাভাবিক হারে কমবে। যদিও…”

স্রোত জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়।

“সামনের বছরগুলো দেখার সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য নাই ঘটতে পারে”।

সুব্বারাও এর মুখ ভাবলেশহীন, কিন্তু স্রোত উত্তেজনায় উঠে দাঁড়ায়।

“কেন প্রফেসর? আপনি সব জেনে ফেলেছেন বলে? সিমুলেশনের মধ্যে থেকে সিমুলেশনের সম্বন্ধে জেনে ফেলার শাস্তিও কি কন্ট্রোল – অলট – ডিলিট?”

“আমার মনে হয় না। মানুষ উন্নত থেকে উন্নততর হয়ে উন্নততমে উত্তীর্ণ হলে তাদের পক্ষে সিমুলেশনের ব্যাপারে জেনে ফেলা স্বাভাবিক। কিন্তু যতক্ষণ না তারা প্রোগ্রামারের আদেশ অমান্য করছে ততক্ষণ হয়ত তাদের খেলে যাওয়ার সুযোগ থাকবেই। আমি কিন্তু নিতান্তই ছাপোষা সিমুলেশন চরিত্র, উজ্জয়িনীর মতন অ্যাডভান্সড লার্নার নই”।

“তাহলে…?”

“আমাদের আরেকবার স্টাডিরুমে যেতে হবে। এসো”।

০৪/০৭/২০১৮, রাত্রি আট’টা বাজতে পাঁচ

মীর ঠায় কম্পিউটার টার্মিনালের সামনেই বসে ছিল। সুব্বারাও কে আসতে দেখে উঠে দাঁড়াল, ওর চোখে ভয়, কিন্তু তার থেকেও বেশি যেন হতাশা।

“দেখো স্রোতস্বিনী”।

দেখছে স্রোত।

একের পর এক খবর ভেসে উঠছে কম্পিউটারের স্ক্রিনে। বাসে, গাড়িতে, মেট্রোরেলে অসংখ্য মানুষের জ্ঞান হারানোর খবর মুহুর্মুহু ভেসে আসছে। একটানা বেজে যাওয়া কম্পিউটারের বিপ বিপ শব্দকে মনে হচ্ছে যেন জেলখানার পাগলাঘন্টি। সিপাইসান্ত্রী ছুটে এলেও সে ঘন্টি যেন কোনোদিন থামবে না।

কম্পিউটারের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বড় ভয় হল স্রোতস্বিনীর।

এতক্ষণে আসল বস্তুটি দেখতে পেয়েছে সে।

শেষ এক ঘন্টায় যা খবরই ফুটে উঠেছে তা সবই কলকাতা সংক্রান্ত।

অসীম আতঙ্কে স্রোত ঘুরে তাকায় সুব্বারাও এর দিকে। সুব্বারাও ওর হাতে সকালের খবরের কাগজটি ধরিয়ে দিলেন। প্রথম পাতার নিচের দিকেই একটি খবর লালকালি দিয়ে আন্ডারলাইন করা।

আজ রাত্রেই দু’টি প্রধান ধর্ম সংগঠন বিশাল সভার আয়োজন করেছে – একটির জমায়েত বাগবাজার আর অন্যটি পার্ক সার্কাসে। সনাতনী এবং সুপ্রাচীন ধর্মবোধ কেন এবং কিভাবে আঁকড়ে ধরতে হবে সেই নিয়ে বক্তব্য রাখবেন একাধিক ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক নেতারা।

স্রোতের চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়তে থাকে।

প্রায় ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞাসা করে, “তাহলে?”

সুব্বারাও একটা হাত স্রোতের কাঁধে রাখেন, অন্য হাত মীরের মাথায়, “আর পাঁচ মিনিট। দু’জায়গাতেই ঠিক রাত আটটায় সভা শুরু হওয়ার কথা”।

সারা ঘর জুড়ে শুধু কম্পিউটার স্ক্রিনে ফুটে ওঠা খবরের আওয়াজ।

না, আরো একটা আওয়াজ আসছে।

স্রোত প্রথমে ধরতে পারেনি, তারপর দেখলে মীর ফোঁপাচ্ছে।

না, দু’টো আওয়াজ তো নয়। একটাই আওয়াজ।

কম্পিউটারের আওয়াজ কোথায়?

“প্রফেসর…” মীরের গলা চরম আতঙ্কে প্রায় শ্বাসরুদ্ধ, ফ্যাসফ্যাস করে একটা বিশ্রী স্বর বেরোল।

প্রফেসর দেখেছেন, দেখেছে স্রোত-ও।

কম্পিউটার টার্মিনাল আর কাজ করছে না, এই মুহূর্তে সব কটা স্ক্রিন জুড়েই শুধু কৃষ্ণ-শূন্যতা।

স্রোতের ঘড়ির রেডিয়াম ডায়ালে মিনিটের কাঁটাটা এই সদ্য বারোর ঘর ছুঁল।

 

5 thoughts on “ক্রীড়নক

  1. পড়ে ফেললাম শুতে যারার আগে। এই ধরনের পসিবিলিটি প্রচুর। আমরা ইনডিভিজুয়ালি যে মডেলের সিমুলেশন তার যেমন এনমাস কোলাপ্স করার হাই প্রোবাবিলিটি, আমরা যে বাবল এর মধ্যে এম্বেডেড (ইন আওয়ার লোকাল ইউনিভার্স) সেটাও কোলাপ্স করতে পারে…. খুবই অন্ধকার ভবিষ্যত – অ্যান্টিটাইমে ঢুকতে পারলে হয়তো একটা কিছু হ’ত! 🙂

    Like

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s