উগ্র জাতীয়তাবাদ, সমস্যা যখন গোটা পৃথিবীর

২৫শে মে’র আনন্দবাজার পত্রিকার উত্তর-সম্পাদকীয়তে আমার লেখা   এই প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছে (http://www.anandabazar.com/editorial/violent-nationalism-is-winning-everywhere-1.394601)।

Trump-Putin-1-1024x675

ভারতে মোদী, ইজরায়েলে নেতানইয়াহু, তুরস্কে এরদোয়ান, পোল্যান্ডে দুদা, রাশিয়ায় পুতিন – দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে পৃথিবী জুড়ে এতজন কট্টর জাতীয়তাবাদী নেতাকে প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতি রূপে তখতে বসে থাকতে বোধহয় আমরা আগে দেখিনি। অবশ্য পরিস্থিতির চাপে যেখানে আঙ সান সু চি রোহিঙ্গাদের বার্মিজ বলে মেনে নিতে অস্বীকার করছেন বা এঞ্জেলা মার্কেল জার্মানি তথা ইউরোপীয়ন ইউনিয়নকে সিরিয়ান শরণার্থীদের নাগালের বাইরে নিয়ে যাওয়ার জন্য তুরস্ককে কোটি কোটি ইউরো দান করছেন সেখানে মেনে নেওয়া ভালো যে আলো ক্রমে নিভিছে। আগামী নভেম্বরে ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন রাষ্ট্রপতির পদটি গ্রহণ করলেই বৃত্তটি সম্পূর্ণ হয়। এই জাতীয়তাবাদ দেশবাসী নয় দেশকে ভালো রাখার প্রতিশ্রুতি দেয়,  এবং দেশ নামক সেই বিমূর্ত ধারণাটিকে দেশবাসীর মাথায় গেঁথে দেওয়ার জন্য  এমন দিনের গল্প শোনায় যেখানে ইতিহাস, পুরাণ আর কল্পনা মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। এ যে নেহাত কথার কথা নয় সেটা দেশে বসে অধিকাংশ মানুষই বিলক্ষণ টের পান কিন্তু সে সমস্যা যে শুধু ভারতের নয় সেটা বোঝার সময় এসেছে।

আন্দ্রেই দুদার কথাই ধরুন। ভদ্রলোকের দয়ার শরীর, কোটি কোটি সিরিয়ান এবং আফ্রিকান শরণার্থীদের মধ্যে জনা দেড়শকে ঠাঁই দিয়েছেন পোল্যান্ডের মাটিতে; যারা ঢুকেছেন তাঁরাও অবশ্য প্রায়ই মারধোর খাচ্ছেন। কিন্তু দুদা শুধু শ্বেতাঙ্গ পোলিশদের ত্রাতা হিসাবেই দেখা দেননি, ইতিহাসকেও দস্তুরমতন নিজের পথে চালাতে চাইছেন। পোলিশ রাষ্ট্রপতি সম্প্রতি ঘোষণা করেছেন পোল্যান্ডের ইতিহাসের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হল হাজার বছর আগের এক পোলিশ রাজার ক্রিশ্চান ধর্মে দীক্ষিত হওয়া। ভেবে দেখুন একবার, এই সেই দেশ যেখানে নাজি অত্যাচারের দগদগে স্মৃতি নিয়ে এখনো দাঁড়িয়ে অসউইজ কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প, এই সেই দেশ যেখানে স্টালিন এবং তাঁর অনুগামী পোলিশ কম্যুনিস্টরা চল্লিশ বছর ধরে হাজার হাজার মানুষকে জেলে পুরে রেখেছেন, এই সেই দেশ যেখানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও ইহুদীরা বহু বছর ধরে নির্যাতিত হয়ে এসেছেন। কিন্তু না, এত ঘটনাবহুল আধুনিক ইতিহাসের কোনোকিছুই পোলিশ রাষ্ট্রপতির কাছে গুরুত্ব পায় নি (কিছু ঘটনা স্রেফ অস্বীকারও করেছেন), গুরুত্ব পেয়েছে শুধুই ধর্ম।

অতি জাতীয়তাবাদের একটি প্যাটার্ন বুনে দেওয়ার জন্য বহু মানুষ সমস্যাটিকে ধর্মের ক্যালাইডোস্কোপে দেখতে চান। বর্তমান পৃথিবী অবশ্য সঘোষে জানাচ্ছে অতি জাতীয়তাবাদ কোনো বিশেষ ধর্মের কুক্ষিগত অধিকার নয়। তাকানো যাক ধর্মনিরপেক্ষ কিন্তু মুসলিমপ্রধান তুরস্কের দিকে।  ধর্মনিরপেক্ষতা এবং উদারপন্থার নিরিখে মধ্যপ্রাচ্য এবং পূর্ব ইউরোপের সমস্ত  দেশগুলির মধ্যে তুরস্ক ছিল সর্বতোভাবে অগ্রগামী।  অটোমান সাম্রাজ্যের শেষের সময়ে আর্মেনিয়ান গণহত্যার বিভীষিকাময় দিনগুলির থেকে দেশটিকে উদারপন্থার দিকে নিয়ে যাওয়াটা মোটেই সহজ কাজ ছিল না কিন্তু কেমাল আতাতুর্ক সেটাই করে দেখিয়েছিলেন।  আতাতুর্ক ক্ষমতায় আসার পর প্রায় একশ বছর হতে চলল, খাতায় কলমে তিনি এখনো এ দেশের জনক অথচ তাঁর ধ্যানধারণার গুরুত্ব যেন ক্রমেই কমে আসছে। শেষ কয়েক বছর ধরে এ দেশের তাবড় নেতারা ঘটা করে পালন করছেন কনস্ট্যান্টিনোপলের পতনবার্ষিকী। তাঁদের বিশ্বাস গত শতাব্দীতে ঘটা তুরস্কের মুক্তিযুদ্ধ নয়,  ১৪৫৩তে বাইজ্যান্টাইন সাম্রাজ্যের পতনই নাকি উন্মেষ ঘটিয়েছে তুর্কী জাতীয়তাবাদের। মনে রাখা ভালো যে আদি অটোমানরা এসেছিলেন তুর্কমেনিস্তান থেকে, ইস্তানবুল থেকে যার দূরত্ব প্রায় হাজার দুয়েক মাইল। একবিংশ শতাব্দীতে পৌঁছেও তুরস্কের মতন আধুনিক একটি দেশে ঔপনিবেশিক জাতীয়তাবাদ প্রাধান্য পাচ্ছে, বিস্ময়াতীত ট্র্যাজেডি ছাড়া কি বলবেন বলুন? তবে সবসময় যে এত স্থূলপদ্ধতিতেই জাতীয়তাবাদ চাগিয়ে তোলা হয় সে কথা ভাবলে ভুল হবে। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। ১৯১৫-র আর্মেনিয়ান গণহত্যাকে তুরস্কের কোনো সরকারই গণহত্যা বলে স্বীকার করেনি, অথচ বর্তমান সরকারের কর্ণধাররা প্রায় আচম্বিতেই বলতে শুরু করেছেন যে তাঁরা সেই সুদূর অতীতের কথা ভেবে ব্যথিত। তাহলে কি আলো দেখা গেল? না। কারণ যে আর্মেনিয়ানরা খুন হয়েছিলেন তাঁদেরকে এখন বলা হচ্ছে অটোমান আর্মেনিয়ান, অথচ অটোমান রাজপরিষদরাই যেনতেন প্রকারেণ চেয়েছিলেন আর্মেনিয়ানদের  এ দেশ থেকে দূর করতে। সে কথা ভোলানোর চেষ্টা করা হচ্ছে এক বৃহৎ জাতীয়তাবাদের জিগির তুলে, যেন তুরস্ক রাষ্ট্রে জাতিধর্মবর্ণ নির্বিশেষে সবার চিরকাল অক্ষয় স্থান ছিল এবং পনের লাখ মানুষের মৃত্যু স্রেফ কেন্দ্রীয় শক্তির সঙ্গে আঞ্চলিক শক্তির  সংঘাতের ফল।

কেউ নরম গলায় মিষ্টি হেসে উগ্র জাতীয়তাবাদকেই ভবিতব্য বলে চালানোর চেষ্টা করছেন কেউ আবার পেশী ফুলিয়ে গরম বুলি আউড়ে প্রমাণ করতে চাইছেন জোর যার মুলুক তার। আজ আট মাসের বেশী সময় ধরে রাশিয়ার সেনাবাহিনী সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আসাদের রাজনৈতিক বিরোধীদের ধ্বংস করার  কাজে সহায়তা করছে অথচ কতজন শরণার্থীকে পুতিন আশ্রয় দিয়েছেন নিজের দেশে? গত বছর চারশ বিরাশি জন সিরিয়ানকে রাশিয়া অস্থায়ী শরণার্থী হিসাবে দেশে ঢুকতে দিয়েছে, আর স্থায়ী শরণার্থী এক জন মানুষও হতে পারেননি। অথচ সাম্প্রতিক একটি সমীক্ষা অনুযায়ী রাশিয়ার প্রায় সত্তর শতাংশ মানুষ পুতিনের  আগ্রাসনকে সমর্থন করছেন। ২০১৪তেও প্রায় ঊননব্বই শতাংশ রাশিয়ান জানিয়েছিলেন ইউক্রেনের উচিত ক্রিমিয়াকে রাশিয়ার হাতেই তুলে দেওয়া। পেরেস্ত্রৈকা এবং গ্লাসনস্ত উত্তর সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হওয়ায় মধ্য এশিয়া এবং বাল্টিক সাগরের পাশের সোভিয়েত কলোনিরা যতই খুশী হোক না কেন, খোদ রাশিয়ার জাত্যভিমানে যে বড়সড় একটা আঘাত পৌঁছেছিল সেটা বলা বাহুল্য। শুরুর দিকের চাকরি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য পরিষেবার অপ্রতুলতায় মানুষ  এসব নিয়ে বড় একটা মাথা ঘামাননি কিন্তু আস্তে আস্তে যেই দেশের অর্থনীতিতে স্থিতি আসতে শুরু করেছে, পশ্চিমী দুনিয়া ‘ইমার্জিং ইকোনমি’ তকমা লাগিয়েছে রাশিয়ার মানুষও হৃতগরিমা কি ভাবে ফিরে পাওয়া যায় সে নিয়ে অল্পবিস্তর ভাবনাচিন্তা শুরু করেছেন। দুঃখের ব্যাপার এই যে এমন এক মানুষের হাতে ততদিনে ক্ষমতা পৌঁছেছে যিনি হৃতগরিমা শুধুই খুঁজে পেয়েছেন উগ্র জাতীয়তাবাদের বিস্তারের মধ্যে। ওদিকে রাশিয়ার অর্থনীতি শেষ দু’তিন বছর ধরেই মুহ্যমান হয়ে আছে। পুতিন যতই তেলের দাম পড়ে যাওয়াকেই দায়ী করুন  না কেন এটা ঘটনা যে বিদেশী বিনিয়োগ আনতে ব্যর্থতা, দুর্নীতি, মাঝারি এবং ক্ষুদ্র শিল্প ক্ষেত্রে চরম ব্যর্থতা এই সবকিছু মিলে রাশিয়ার অর্থনীতি এখন ভেতরফোঁপরা। কিন্তু সে নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় বা ইচ্ছা পুতিনের আছে বলে মনে হয় না।

কিন্তু শুধু পোল্যান্ড, রাশিয়া বা তুরস্ক নয় গোটা ইউরোপ জুড়েই অতি রক্ষণশীল, উগ্র জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক দলগুলি মানুষের সমর্থন পাচ্ছে – ফ্রান্স, হল্যান্ড কি স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলিতে গড়ে মোট ভোটের দশ থেকে কুড়ি শতাংশ এখন এদের দখলে। সিরিয়া এবং আফ্রিকার শরণার্থী সমস্যা অবশ্যই ইউরোপের মানুষকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে, এঞ্জেলা মার্কেলের মতন তুলনামূলক ভাবে উদারপন্থী নেতাদের ওপরে আর ভরসা রাখতে পারছেন না তাঁরা। কিন্তু শুধু সেই কারণেই কি উগ্র জাতীয়তাবাদের এত বাড়বাড়ন্ত? মনে হয় না।  বিশ্বায়িত পৃথিবীতেও নিরানব্বই আর এক শতাংশের ফারাক বেড়ে চলতে দেখলে কোন মানুষের আর বিশ্বনাগরিক হিসাবে পরিচয় দিতে ভালো লাগে? একজন তুর্কী দেখছেন বুলগেরিয়া, এস্তোনিয়া কি মাল্টার মতন দেশও ইউরোপীয়ন ইউনিয়নের সদস্যপদ পাচ্ছে স্রেফ ধর্ম ও বর্ণ পরিচয়ে, একজন পোলিশ দেখছেন একমাত্র ইউরোপীয় দেশ হিসাবে মন্দার বাজারে সাফল্যের মুখ দেখলেও লভ্যাংশের সিংহভাগটা সেই চলে যাচ্ছে ইউরোপীয় সুপারপাওয়ারদের কাছেই, একজন সার্বিয়াান দেখছেন শুধু রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক বজায় থাকার জন্য যোগ্যতা সত্ত্বেও ইউরোপীয়ন ইউনিয়নে ঢুকতে পারছেন না। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা হোক বা আন্তর্জাতিক অর্থ ভান্ডার, রাষ্ট্রপুঞ্জ হোক  বা ইউরোপীয়ন ইউনিয়ন, সাধারণ মানুষের কাছে এই সংস্থাগুলি যে প্রতিশ্রুতি নিয়ে এসেছিল তার অধিকাংশই পূর্ণ হয় নি। একথা অনস্বীকার্য যে বিশ্বায়নের মাধ্যমে উন্নয়নশীল দেশগুলির মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্ত সমাজ পেয়েছে অনেক কিছুই কিন্তু সেই এক কুমীরছানাকে বার বার দেখিয়ে উন্নত দেশগুলি তার ফায়দা তুলেছে হাজার গুণ। স্বভাবতই যে মানুষগুলির ভাগ্যে কিছুই জোটেনি (এবং তাঁরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ) তাঁরা নিজেদের প্রাথমিক পরিচয়েই ঘুরে দাঁড়াতে চাইছেন, আর জাতীয়তাবাদের শুরুর কথাও সেখানেই লুকিয়ে। ভুললে চলবে না এমনকি উন্নত দেশগুলিতেও আর্থিক বৈষম্য চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে, ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ার যে খনিশ্রমিকরা ডোনাল্ড ট্রাম্পকে জেতাবেন বলে পণ করেছেন তাঁদেরকেও কিন্তু ধোঁকার টাটি কম দেখানো হয়নি। মানুষের চরিত্রগত লোভ ও খলতা, হাজার হাজার বছরের সামাজিক ইতিহাস, গণতন্ত্রের সার্বিক বিকাশ না ঘটা এসবের কোনোকিছুকেই অস্বীকার করছি না কিন্তু আশাভঙ্গের আখ্যানটিরও একইরকম গুরুত্ব পাওয়া উচিত।

 

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s