নাসিরুদ্দিন হোজার কান্ডকারখানা

Nasreddin

গোটা মধ্য এশিয়ার লোক থেকে শুরু করে মায় আজারবাইজানি দের-ও অনেকে দাবি করেন হোজা নাসিরুদ্দিন তাঁদের নিজের লোক, যদিও জনমত ভারী তুরস্কের দিকেই – আনাতোলিয়ার আকশেহর-এ নাকি হোজার জন্ম। সে শহরে প্রত্যেক বছর ঘটা করে নাসিরুদ্দিনের জন্মদিন পালন করা হয়, দেশ বিদেশ থেকে বহু পর্যটক ঘুরতে আসেন। ভাবছি এ বছরেই ওই মেলা চলার সময় একবার আকশেহর ঘুরে আসব, যদি সত্যি গিয়ে উঠতে পারি তাহলে নাসিরুদ্দিন মানুষটাকে নিয়ে একটা লেখা পাবেন। এখানে চুপি চুপি জানিয়ে রাখি কিছু তুর্কী বিশেষজ্ঞের ধারণা নাসিরুদ্দিন বলে কোনো একজন লোক ছিলেন না, অনেক হোজার (তুর্কী বিদ্বজনের) গল্প একত্রে চালানো হয়েছে নাসিরুদ্দিনের গল্প বলে।

দু’বাংলার অসংখ্য মানুষের নাসিরুদ্দিনের সঙ্গে প্রথম পরিচয় সত্যজিৎ  এর ‘মোল্লা নাসীরুদ্দীনের গল্প’ বইটির দৌলতে, আমিও ব্যতিক্রম নই। আজকে সাড়ে বত্রিশের পাতায় প্রবন্ধের বদলে সেই স্টাইলেই রইল নাসিরুদ্দিন হোজার কিছু অণুগল্প যেগুলো সত্যজিৎ এর বইতে নেই। তুরস্কে নাসিরুদ্দিনের হাজার হাজার গল্প, স্থানীয় গল্পগুলির ইংরেজীতে অনুবাদ খুব সুলভ অবশ্য নয়। তাও সেরকম-ই একটি বই পেয়ে যাওয়ায় সাহস করে বাংলায় অনুবাদ করে ফেললাম নিজেই। জানাবেন কেমন লাগল।

১।

সকাল সকাল হোজা চলেছে , বাহন একটি গাধা। পেছন পেছন আরো দুটো গাধা বয়ে নিয়ে আসছে নাসিরুদ্দিনের মালপত্র।  সেই দেখে গ্রামের মোড়ল ফুট কাটল, “নিজের বাচ্চাদের নিয়ে চললে কোথায় হোজা”?

অম্লানবদনে জবাব দিল নাসিরুদ্দিন, “পাঠাশালায় নিয়ে যাচ্ছি, সব কটাই মোড়ল হতে চাইছে কিনা”।

২।

নাসিরুদ্দিনের বাড়িতে নাকি চল্লিশ বছরের পুরনো এক বোতল শরাব আছে, এমনতর খবর পেয়ে হোজার পড়শী দৌড়ে গেছে। কড়া নাড়ার শব্দ শুনে হোজা দরজা খুলতেই পড়শীর মিনতি “চল্লিশ বছরের শরাব একটু পেতে পারি জনাব?”। গম্ভীরমুখে নাসিরুদ্দিন জানাল “সে শরাব আছে বটে আমার কাছে তবে দেওয়া টেওয়া যাবে না”। পড়শীর বিরস বদন দেখে হোজা বললে, “চাইলেই পাওয়া গেলে কি ‘চল্লিশ বছরের শরাব’ তৈরী হত?”।

৩।

নিজের পোষা মুরগীটাকে বাজারে বিক্রি করার মতলব নাসিরুদ্দিনের, কিন্তু সে মুরগী ধরা দিতে চায় না কিছুতেই। শেষমেশ কয়লার গাদার মধ্যে অনেক হুটোপাটি করে তাকে ধরা হল, মাঝখান থেকে কয়লার গুঁড়োয় গেল মুরগীর রঙ কালো হয়ে।

বাজারে পাওয়া গেল এক খদ্দের কিন্তু সে অনেক দেখে টেখে হোজাকে জানাল, “মুরগীটা সাদা হলে  তবেই না নিতাম! কালো মুরগী চাই না”। শোনা মাত্র নাসিরুদ্দিন দিয়েছে মুরগীকে এক রাম চিমটি, মুরগী কোঁকর কোঁ করে ঝটপটিয়ে উঠেছে, আর কয়লার গুঁড়োর মধ্যে দিয়ে বেরিয়ে পড়েছে একটু সাদা রং ।

“তোমার জন্য রঙ অবধি বদলে ফেলছে এ মুরগী, তুমি মুরগী না চাইলে কি হবে মুরগী কিন্তু তোমাকে চায়” – জানাল নাসিরুদ্দিন।

৪।

বাজারে ঘুরতে ঘুরতে হোজা দেখে একটা পুঁচকে পাখির দাম উঠল দশ মোহর। সেই দেখে দৌড়ে বাড়ি এসে নিজের পোষা টার্কি টা কে নিয়ে ফের বাজারে গেল নাসিরুদ্দিন, দর চাইল কুড়ি মোহর। বাজারের লোকেরা বলল, “কি যে বল হোজা, একটা টার্কির দাম কখনো কুড়ি মোহর হয়?” নাসিরুদ্দিন তর্ক জুড়ে দিল, “অতটুকু ছোট একটা পাখির দাম দশ মোহর হলে আমার এই প্রমাণ সাইজ টার্কিটার দাম বেশক্ কুড়ি মোহর”। “বলো কি হোজা, ও তো কথা বলা টিয়া – ওর দাম তো দশ মোহর উঠবেই”। “কিন্তু সে টিয়া তো আমার টার্কির মতন চিন্তা করতে পারে না”।

৫।

একদিন  আড্ডার মধ্যে সবাই মিলে হোজাকে শুধোল, “নাসিরুদ্দিন, তোমার ক’জন সত্যিকারের দোস্ত আছে?” “এ বছর সেটা বলা মুশকিল খুব”, জানাল হোজা। সবাই তো অবাক, “কেন কেন, এ বছর বলা যাবে না কেন?” “আর বোলো না, এ বছর আমার ক্ষেতে বিস্তর ফসল হয়েছে যে”।

৬।

নাসিরুদ্দিনের নাপিত দাড়ি কামাতে গেলেই হোজার গাল কেটে ফেলে, সে এক মহা সমস্যা। একদিন দাড়ি কামানোর সময় শোনা গেল বিকট শব্দ, নাপিত-ও চমকে উঠে দিয়েছে ক্ষুরের এক লম্বা টান। যন্ত্রণা সহ্য করে নাসিরুদ্দিন জিজ্ঞাসা করল, “কিসের শব্দ হে?”। “ঘোড়ার পায়ে নাল পরাচ্ছে তো, তাই ঘোড়াটা চেঁচাচ্ছে” – জানাল নাপিত। “তাই বলো, আমি ভাবলাম কেউ দাড়ি কাটাচ্ছে বোধ হয়”।

৭।

আজান পড়তে পড়তেই একজন প্রাণপণে দৌড়চ্ছিল। মাথামুন্ডু বুঝতে না পেরে সবাই এসে নাসিরুদ্দিনকে শুধোল ব্যাপারটা কি। ক্ষণেক মাথা চুলকে নাসিরুদ্দিন জানাল, “ও দেখতে চায় ওর গলার স্বর কতদূর অবধি পৌঁছয়”।

৮।

“তোমার কি মনে হয় হোজা, গ্রামের আগা সাহেব স্বর্গে যাবে না নরকে?” নাসিরুদ্দিনকে দেখে সবাই একসঙ্গে জিজ্ঞাসা করে উঠল। নাসিরুদ্দিন ভারিক্কী চালে জবাব দিল, “কোত্থাও না, এখানেই থাকবে”। “সে আবার কি?”, সবাই ভারী অবাক। “আরে, কফিনে ঢোকার জন্য ঠিক একটা গরীবকে পেয়ে যাবে আগা, খুব চিনি ওকে।”

৯।

চমৎকার একটা বিকালে মাঠে শুয়ে শুয়ে চারপাশ দেখছিল আমাদের হোজা – পাশেই একটা গরু চরছে আর উড়ে বেড়াচ্ছে একটা কাক। দেখে ঈশ্বরের কাছে অনুযোগ জানাল নাসিরুদ্দিন, “এ তোমার কেমনধারা বিচার! কাক তো কোনো কাজেই আসে না  কিন্তু ওকে দিলে উড়তে, আর যে এত কাজে আসে তাকে আটকে রাখলে মাটিতে”। বলতে বলতেই সেই কাক বিষ্ঠা ত্যাগ করেছে নাসিরুদ্দিনের ওপর। নাসিরুদ্দিন ভারী অবাক হয়ে বলল, “তোমার বিচার নিয়ে আর কোনো প্রশ্ন নয় খোদা! ভাগ্যিস, গরু ওড়ে না”।

১০।

ঝমঝম করে বৃষ্টি নেমেছে, নাসিরুদ্দিন জানলার পাশে বসে তাই দেখছিল –  চোখে পড়ল এক পড়শী পড়ি কি মড়ি করে দৌড়চ্ছে। হোজা ডাক ছাড়ল, “কি হে, এত দৌড়ও কেন?” “দেখতে পাও না নাকি হোজা? বৃষ্টি পড়ছে যে, ভিজে মরব নাকি?”

নাসিরুদ্দিন গম্ভীর হয়ে বলল, “বৃষ্টি হল আল্লার আশীর্বাদ, তার থেকে এরকম ভাবে দৌড়ে পালানো কি ঠিক?”

পড়শী পড়ল লজ্জায়, দৌড় থামিয়ে চুপচুপে ভিজে ফিরল বাড়ি।

পরের দিন-ও বৃষ্টি, এদিন কিন্তু পড়শী বাড়ির ভেতরে, দেখে নাসিরুদ্দিন তড়িঘড়ি করে দৌড়চ্ছে। পড়শী হেঁকে বলল, “কি গো, নিজের উপদেশ যে ভুলে গেলে বড়?” পা চালাতে চালাতে নাসিরুদ্দিনের জবাব, “আমি তো শুধু চেষ্টা করছি ঈশ্বরের আশীর্বাদের ওপর পা না ফেলতে”।

১১।

সুলতানের নতুন চাকর চাই কিন্তু পছন্দ হচ্ছে না কাউকেই, লাইন ধরে বাতিল করে যাচ্ছেন সবাইকেই। রাজদরবারে সেদিন হোজা-ও উপস্থিত, আর থাকতে না পেরে বলল, “জাহাঁপনা, শেষের জন কিন্তু দিব্যি ছিল”।

“ও হাসার সময় বত্রিশ পাটি বার করে রেখেছিল যে, পছন্দ হয় নি মোটেই” – বিরস বদনে জানালেন সুলতান।

মাথা নেড়ে নাসিরুদ্দিন বলল, “নিশ্চিন্ত থাকুন, আপনার কাজ শুরু করে দিলে বত্রিশ পাটির একটিও বেরোবে না”।

১২।

নিজের ক্ষেতে কাজ করছিল আমাদের হোজা। এমন সময় কে একজন হেঁকে বলল, “পাশের গাঁয়ে যেতে কতক্ষণ লাগবে বাপু?” কোনো উত্তর নেই। আবার প্রশ্ন করল সে, আবারো কোনো উত্তর নেই। বার বার তিনবার হওয়ার পর রেগেমেগে সে ব্যক্তি হাঁটা লাগাল।

এবার নাসিরুদ্দিন পেছন থেকে ডেকে বলল, “ঘন্টা তিনেক মতন লাগবে।”

“তুমি কি আমার সঙ্গে মস্করা করছ নাকি? এতক্ষণ ধরে জবাব দিলে না যে বড় আর এখন পিছু ডাকছ।”

নাসিরুদ্দিন হাতের কাজ সারতে সারতে বলল, “তোমার হাঁটা না দেখলে কি করে জানব কতক্ষণ লাগবে”।

১৩।

শিকার করে ফিরছিলেন সুলতান, দেখেন কনকনে শীতের দিনে হোজা একটা পাতলা জামা গায়ে বেড়াতে বেরিয়েছে।

“কি ব্যাপার হে ? পুরু পশমের জামা পরে আমি কেঁপে যাচ্ছি আর এত পাতলা জামা পরেও তোমার কোনো হেলদোল নেই। রহস্যটা কি?”

“আজ্ঞে আপনার যত কটা জামা আছে তার সবগুলো পরে ফেললেই ল্যাঠা চুকে যেত, ঠান্ডা লাগত না মোটেই; আমি তো তাই করেছি”, হেসে জানাল নাসিরুদ্দিন।

১৪।

রাজদরবারে পৌঁছে সুলতান দেখেন হোজা খুব মন দিয়ে সভাসদদের সঙ্গে আলোচনায় ব্যস্ত।

সুলতানের একটু পেছনে লাগার ইচ্ছে হল, সবাইকে ডেকে বললেন “ওহে, নাসিরুদ্দিন বড় মিথ্যা কথা বলে, ওর কথা শুনো না”।

নাসিরুদ্দিন সম্মতি জানিয়ে বলল, “যা বলেছেন খোদাবন্দ, আপনার দরবারে ন্যায়বিচার পাওয়া কত সহজ সে কথাই জানাচ্ছিলাম”।

১৫।

পড়শীর বাড়ির পাশ দিয়ে যেতে যেতে নাসিরুদ্দিনের কানে আওয়াজ এল, জানলার দিকে সরে গিয়ে দেখে পড়শী বিছানায় শুয়ে প্রার্থনা করছে “হে আল্লা, আমাকে স্বর্গের পথ দেখাও”।

সেই দেখে নিজের বাড়িতে ফিরে এসে হোজা বাড়ির চালের উপর উঠে “কই রে, কই” বলে চিৎকার শুরু করে দিল।

চেঁচামেচিতে বিরক্ত হয়ে এবার পড়শী বেরিয়ে এসেছে, “সকাল সকাল এত হট্টগোল কিসের?”

“আরে, আমার গাধা টাকে খুঁজে পাচ্ছি না যে”।

পড়শী আরো বিরক্ত হয়ে বলল, “তোমার মাথা খারাপ নাকি! বাড়ির চালে গাধা খুঁজছ?”

“তুমি বাড়ির বিছানায় স্বর্গ খুঁজতে পারো আর আমি বাড়ির চালে গাধা খুঁজলেই দোষ?” শান্ত স্বরে উত্তর নাসিরুদ্দিনের।

প্রান্তিক অর্থনীতি প্রসঙ্গে দু-চার কথা

জলদস্যু থেকে যুদ্ধবন্দী, অনলাইন হ্যাকার থেকে স্ট্রীট হাসলার – প্রান্তিক অর্থনীতির বাহকদের থেকেও হয়তো মূলধারার অর্থনৈতিক উপদেষ্টাদের কিছু জানার আছে। সেই নিয়েই একটি প্রবন্ধ লিখেছিলাম অশোক মিত্র-র ‘আরেক রকম’ পত্রিকার জন্য, সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে সেটি। সম্পাদকমন্ডলীর সদস্য শুভনীল চৌধুরীকে ধন্যবাদ উৎসাহ দিয়ে লেখাটিকে দাঁড় করানোর জন্য।

সাড়ে বত্রিশ ভাজার পাঠকদের জন্য তুলে দিলাম স্ক্যানড কপি।

1

2

3

4

5

6

7

ইয়ো হো হো, ভিন্ডালহো

Flag_Portugal

রেস্তোরাদোরেসে পর্তুগীজদের থেকে বেশী দেখবেন ভারতীয়, বাংলাদেশী এবং আফ্রিকানদের, রুয়া দাস পোরতাস ডা সান্তো অ্যান্তাও (চমকাবেন না, সেন্ট অ্যান্টনির নামে রাস্তা আর কি) ধরে এঁরা ছুটোছুটি করছেন ট্যুরিস্টদের ঘাড় ধরে পর্তুগীজ বা ইটালিয়ান নয়তো নিদেনপক্ষে উত্তর ভারতীয় রেস্তোরাঁতে বসানোর। লিসবনের অন্যতম ব্যস্ত অঞ্চল, ট্যুরিস্টদের আনাগোনা বেশ ভালোই – কেউ হয়ত পাহাড়ের ওপরের রাজপ্রাসাদটি দেখে সরু পাথুরে গলিওলা আলফামার রঙ বেরঙ এর বাড়ির পাশ দিয়ে হেঁটে এসে সমতলে পৌঁছে রেস্তোরাদোরেসে বিশ্রাম নিচ্ছেন, কেউ বা আবার বেজায় হ্যাপেনিং বায়হু অল্টোতে বেশী রাত্রের দিকে যাওয়া মনস্থির করে এখানে সান্ধ্যকালীন ঘাঁটি গেড়েছেন। আমাদেরকে দেখে যেখানে খোদ পর্তুগীজরা ‘নমস্তে’ বলে যাচ্ছেন সেখানে রেস্তোরাদোরেসের শশব্যস্ত ওয়েটাররা টানাটানি করবেন তাতে আর আশ্চর্য কি? এতক্ষণ আবার বেশ বৃষ্টি পড়ছিল, কিন্তু সেটাও আস্তে আস্তে ধরে আসছে আর তাই কানের কাছে গুনগুনিয়ে উপরোধ-অনুরোধেরও বিরাম নেই।

কিন্তু আমাদের টলানো সোজা কথা নয়, সেই যে হোটেল থেকে গুগলের দিকনির্দেশিকা পাকড়ে বেরিয়েছি তার থেকে আপাতত মুখই তুলছি না। গুগল জানাচ্ছে এবার সোজা রাস্তা লারগো সাও ডমিঙ্গোজে পড়তে হবে, তারপরেই এসে পড়বে বারোজ ক্যুইরোজ, সেখানে বাঁদিকে বেঁকেই আবার ডানদিক নিয়ে উঠতে হবে ডম ডুয়ারতের মুখে, তারপরেও হাজার একখানা অলিগলি টপকানোর পালা। কিন্তু সামনেই ডিশে ডিশে সাজানো পাস্তা, পিজ্জা, ল্যাম্ব বিরিয়ানির প্রলোভন ছেড়ে পায়ে সারাদিনের জমানো শ্রান্তি এবং বৃষ্টিতে ভেজার ফলে শরীরের ক্রমবর্ধমান উষ্ণতাকে অগ্রাহ্য করে কোথায় যাওয়ার এত টান? এতই টান যে অথেনটিক পর্তুগীজ ডিশ মঙ্কফিশের স্ট্যু-ও পাত্তা পাচ্ছে না। আছে, আছে , কারণ আছে – আমরা চলেছি ভারতের মাটিতে তৈরী হওয়া আদি ফিউশন ফুডের সন্ধানে। কিন্তু যে খাদ্যবস্তুর সন্ধান দেওয়ার আগে একটু পিছোতে হবে, বেশী নয় – পাঁচশ সতের বছর আর ন’হাজার কিলোমিটার।

রেস্তোরাদোরেস থেকে মিনিট কুড়ি দূরে রয়েছে জেরোনিমো’স মনাস্ট্রি, সেখানে  যাঁর সমাধি দেখার জন্য লোকে মাইল খানেক লম্বা লাইন লাগায় তাঁর জনপ্রিয়তা ন’হাজার কিলোমিটার দূরের শহর কোচিতেও সমতুল্য – সেই কোচি, ভারতীয় শহরদের মধ্যে প্রথম যে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়েছিল পর্তুগীজদের দিকে। সম্রাট ম্যানুয়েল কেন যে কুড়ির কোঠায় থাকা ভাস্কো ডা গামা কেই পছন্দ করেছিলেন ভারত মহাসাগর ধরে অভিযানের জন্য সেটা একটা রহস্য, অনভিজ্ঞতার মাশুল গুনতেও হয়েছিল ভাস্কো ডা গামা কে প্রথমবার অভিযানের সময় – না বাণিজ্যিক ভাবে, না ধর্ম প্রচারে সফল হয়েছিল ভাস্কোর প্রথম ভারত অভিযান। কালিকটের মুসলিম মশলা ব্যবসায়ীরা বিশেষ পাত্তা দেন নি ভাস্কোকে, ফলত সেখানকার রাজদরবারেও বিশেষ সম্মান জোটেনি (তার মধ্যে আবার রাজার জন্য বিশেষ কিছু ভেট-ও নিয়ে যান নি ভাস্কো)। ব্যর্থমনোরথ যুবকটিকে হয়ত আবার ভারতে ফিরতে হত না, কিন্তু বাধ সাধলেন কিছু ইটালিয়ান। লিসবনে তখন বসবাস ছিল ফ্লোরেন্স এবং জেনোয়া থেকে আসা একাধিক ব্যবসায়ীর যাঁদের সঙ্গে আবার ঘোর শত্রুতা ছিল ভেনিসের বণিকদের। হয়ত ভেনিসের বণিকদের টক্কর দেওয়ার উদ্দেশ্যেই তাঁদের দরকার ছিল ভারত মহাসাগর ধরে স্পাইস রুটে আধিপত্য; এঁদের প্ররোচনাতেই ম্যানুয়েল ১৪৯৮ এ ভাস্কোর প্রথম ভারত সফরের পর মাত্র চার বছরের মধ্যে আরো তিন বার বিশাল নৌবহর পাঠান। শেষ বার, ১৫০২ সাল, নেতৃত্বে আবার ভাস্কো ডা গামা –  ভাস্কোর নৌবহরের বোমাবর্ষণে বিধ্বস্ত হল কালিকট আর বন্ধু শহর কোচি (কোচিন) তে গড়ে উঠল পর্তুগীজদের মূল ঘাঁটি।

ভাস্কো আর তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গোদের হাত ধরে ভারতে ঢুকে পড়ল কিছু পর্তুগীজ শব্দ-ও – কালিকটের সমুদ্রে ভাস্কোর নৌসেনারা কারণে অকারণে এত আক্রমণ চালাতে লাগলেন যে স্থানীয়দের কাছে এঁরা প্রায় জলদস্যুর সামিল হয়ে উঠলেন, পর্তুগীজ ‘আর্মাডা’ থেকে ভারতীয় ‘হার্মাদ’ আসার লজিকটা বোঝা যায়। আর্মাডা’ এবং আরো কয়েকশ শব্দের মধ্যে ছিল ‘ভিনহো’ এবং ‘অ্যালহোস’ – প্রথমটি ওয়াইন ভিনিগার এবং দ্বিতীয়টি রসুন। মধ্যপ্রাচ্য থেকে রসুনের ব্যবহার অবশ্য আগেই ভারতে এসেছে কিন্তু ওয়াইন ভিনিগারের ব্যবহার এই প্রথম। ওয়াইন ভিনিগারে শুয়োরের মাংস জারিয়ে রাখার টেকনিক-ও প্রথমবারের মতন দেখল ভারতবাসী। কিন্তু সে নেহাতই বিজাতীয় খাবার, সে খাদ্যবস্তুটির জন্য আমিও হয়ত লিসবনে কানা গলির অ্যাডভেঞ্চারে বেরোতাম না। কিন্তু বেরোতে যে হল তাঁর কারণ আরো দুই পর্তুগীজ যুদ্ধবাজ – ডম ফ্রান্সিককো ডা আলমেডা এবং  আফোন্সো ডা আলবুকার্ক।

আলমেডা ভারতে আসেন ১৫০৫-এ (সেই সম্রাট ম্যানুয়েলের আদেশেই) এবং এসেই খুব তাড়াতাড়ি অনুধাবন করেন ভারতের দক্ষিণ থেকে পশ্চিমে মনোনিবেশ করাটা জরুরী – কারণ গুজরাটি ব্যবসায়ীদের বাণিজ্যিক প্রতাপ দক্ষিণীদের থেকে অনেকটাই বেশী। আলমেডার জন্যই পর্তুগীজরা খুঁজতে থাকেন একটি নতুন শহর যাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠবে ভারতের পর্তুগীজ উপনিবেশ। আর এই নতুন শহরটি শেষে খুঁজে বার করেন আলবুকার্ক, যিনি আলমেডার বদলি হিসাবে ভারতে আসেন। কেরালা আর গুজরাটের মাঝামাঝি অবস্থিত এই শহরটিতে ছিল চমৎকার একটি বন্দর, ইরান এবং আরব থেকে ঘোড়া ভারতে চালান-ও হত এই শহর দিয়েই। আলবুকার্ক ঘোড়ার ব্যবসা নিয়ে বিশেষ উৎসাহী ছিলেন, আর শহরটির অবস্থান, বন্দরের সুবিধা সব দেখে সিদ্ধান্ত নিলেন কোচিন ছেড়ে এখানেই গড়ে উঠবে পর্তুগীজদের মূল ঘাঁটি। হলও তাই, পরের সাড়ে চারশ বছর ধরে গোয়া হয়ে রইল ভারতে পর্তুগীজদের প্রাণকেন্দ্র।

কোচিন ছেড়ে গোয়াতে আসা হল – সঙ্গে ভিনহো আর অ্যালহোস তো এলই, উপরন্তু এল দক্ষিণ ভারত থেকে অসংখ্য মশলা যার সঙ্গে এতদিনে পর্তুগীজরা অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। কেরালা ছেড়ে গোয়াতে আসার আরেকটা সুবিধে হল গোয়ার লাগোয়া কানাড়া (অধুনা কর্ণাটক) অঞ্চল থেকে চালের আমদানি; কানাড়া অঞ্চলে চালের জন্য বিখ্যাত এবং ফলন-ও এত বেশী হত যে প্রায়শই ফসল উদ্বৃত্ত থেকে যেত। কেরলে থাকাকালীন দেশজ স্টাইলে ঝলসানো মাংস এবং স্ট্যু জাতীয় খাবারই ছিল পর্তুগীজদের ভরসা, গোয়াতে এসে কিন্তু খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন ঘটল – মশলা এবং ভাতের সুবাদে স্ট্যু-র বদলে এল কারি, এবং মশলাদার কারি।

আর সেই সুবাদেই তৈরী হল ভারতের প্রথম ফিউশন ফুড – ভিন্দালু। এতক্ষণে তো বুঝেই গেছেন যে ভিন্দালু এসেছে পর্তুগীজ শব্দ ভিন্ডালহো (ভিনহো + অ্যালহোস -> ভিনহো ডা অ্যালহোস ) থেকে; কলকাতার বেদুইন জাতীয় রেস্তোরাঁয় যতই ভিন্দালুতে আলু দিক না কেন, আলুর সঙ্গে এ ডিশের কোনো সম্পর্কই নেই। কলকাতা এবং দিল্লীর বহু জায়গায় আলুবিহীন ভিন্দালুতে আবার টকের নামগন্ধ পাই নি, মনে রাখবেন ভিনিগারের টক স্বাদ না পেলে সে রান্না কিন্তু আদপেই ভিন্দালু নয়। এ প্রসঙ্গে মনে করাই ফিউশন ফুড বলেই আধুনিক পর্তুগীজ রান্নায় কদাচিৎ এর উল্লেখ পাবেন, লিসবন বা অন্যত্র এ খাবার খেতে গেলে কিন্তু ভরসা সেই গোয়ান হেঁসেল। ভিন্দালু পর্তুগালের খাবার বললে ভুল বলা হবে, এ ভারতের মাটিতে পর্তুগীজদের বানানো খাবার।

আদি ফিউশন ফুড বলেই ভিন্দালু এক্সোটিক খাবার-ও বটে; গলির গলি তস্য গলি পেরিয়ে টেন্টাকোজ ডা গোয়াতে পৌঁছে দেখা গেল ছোট্ট ঘরটিতে সুবেশ এবং সুবেশিনীরা প্রায় গায়ে গা ঠেকিয়ে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন কাঙ্ক্ষিত খাদ্যবস্তুর জন্য।  নেহাত বাইরে আবার জোরদার বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছিল বলে ভেতর থেকে দু’খান চেয়ার বার করে অতি কষ্টে জায়গা করা হল আমাদের জন্য, নচেৎ  এ যাত্রায় আর ভিন্দালু চাখা হত না। বাড়ির হেঁশেলেই রান্না, সুতরাং সময়টাও বাড়ির রান্নার মতন-ই লাগে। অতএব বসে বসে মেনুতে চোখ বোলাচ্ছিলাম। শুধু তো আর ভিন্দালু নয়, কোন ফ্রেঞ্চ মহিলা ভেড়ার মাংসের জাকুতি খেয়ে ঘামতে ঘামতেও ধন্য ধন্য করছেন, কোন পর্তুগীজ যুবক পর্ক বালচাও খেয়ে মুগ্ধ, কেউ বা আবার মুরগীর কাফ্রিয়াল নিয়ে থেকে থেকেই ‘আফরিন আফরিন’  করে উঠছেন। মনে পড়ল গোয়ান খাবারে পর্ক আর প্রন বালচাও কেই দেখা গেলেও, আদতে কিন্তু এটা কডফিশের প্রিপারেশন। নুন মাখিয়ে রেখে দেওয়া কডফিশ (বাকালাও) গলা দিয়ে নামানোর জন্য পর্তুগীজদের সহায় ছিল এক বিশেষ সস – সেই সস বালিচাও-এর নামেই এই ডিশ। কিন্তু সে সস এখন প্রায় দুষ্প্রাপ্য, তার বদলে ভারতীয় মশলা দিয়ে বেশ মাখা মাখা একটা আচারী পর্ক জাতীয় জিনিস বানানো হয় বালচাও নাম দিয়ে। আদি বালিচাও কেমন খেতে ছিল সে হয়ত আর জানা যাবে না কিন্তু তার গোয়ান সংস্করণটি বড়ই সুস্বাদু।

ঝাড়া পঁয়তাল্লিশটি মিনিট অপেক্ষা করার পর এল লিসবনের ভিন্দালু, তার এক চামচ মুখে তুলতেই একটা আলগা ঝাল ছড়িয়ে পড়ল সারা মুখে, সঙ্গে একটা অম্লমধুর স্বাদ। কিছুক্ষণ পর বুঝলাম মধুর ব্যাপারটা আমার জিভের হ্যালুসিনেশন মাত্র, বিদেশ কেন দেশেও চট করে এত ঝাল খাওয়া হয় না বলেই হয় তো ওটা একটা সাইকোলজিক্যাল রেসিস্ট্যান্স। ভাবছিলাম পোড়ানো মাংস থেকে এই ঝাল ঝাল কারিতে উত্তোরণের পথটি কেমন ছিল পর্তুগীজ হানাদারদের জন্য – একাত্ম হওয়ার কতটা তাগিদ থাকলে খাদ্যাভ্যাসে এহেন পরিবর্তন আসে? ববি ব্র্যাগাঞ্জার কোন পূর্বসূরী  ‘দেতা হ্যায় দিল দে বদলে মে দিল কে’র সঙ্গে সঙ্গে অস্ফূটে চেয়ে নিয়েছিল ঝালের প্রতিশ্রুতি-ও?

যদি এক্ষুনি গোয়া বা পর্তুগাল না যেতে পারেন, দুঃখ করবেন না – বাংলার জন্য ভিনহো না নিয়ে এলেও পর্তুগীজরা অন্য জিনিস কম আনেনি। কয়েক মাস পরেই রথযাত্রা, মঠ নামক চিনির ড্যালাটি কিন্তু এনাদেরই অবদান। আর অত দিন ধৈর্য না থাকলেও সমস্যা নেই, পয়লা বৈশাখ দোরগোড়ায়, গরম পড়ল বলে – সবেদা খান কি আনারস, আতা হোক কি নোনা, সবই পর্তুগীজদের দান। মায় ভ্যারেন্ডা অবধি!