গোটা মধ্য এশিয়ার লোক থেকে শুরু করে মায় আজারবাইজানি দের-ও অনেকে দাবি করেন হোজা নাসিরুদ্দিন তাঁদের নিজের লোক, যদিও জনমত ভারী তুরস্কের দিকেই – আনাতোলিয়ার আকশেহর-এ নাকি হোজার জন্ম। সে শহরে প্রত্যেক বছর ঘটা করে নাসিরুদ্দিনের জন্মদিন পালন করা হয়, দেশ বিদেশ থেকে বহু পর্যটক ঘুরতে আসেন। ভাবছি এ বছরেই ওই মেলা চলার সময় একবার আকশেহর ঘুরে আসব, যদি সত্যি গিয়ে উঠতে পারি তাহলে নাসিরুদ্দিন মানুষটাকে নিয়ে একটা লেখা পাবেন। এখানে চুপি চুপি জানিয়ে রাখি কিছু তুর্কী বিশেষজ্ঞের ধারণা নাসিরুদ্দিন বলে কোনো একজন লোক ছিলেন না, অনেক হোজার (তুর্কী বিদ্বজনের) গল্প একত্রে চালানো হয়েছে নাসিরুদ্দিনের গল্প বলে।
দু’বাংলার অসংখ্য মানুষের নাসিরুদ্দিনের সঙ্গে প্রথম পরিচয় সত্যজিৎ এর ‘মোল্লা নাসীরুদ্দীনের গল্প’ বইটির দৌলতে, আমিও ব্যতিক্রম নই। আজকে সাড়ে বত্রিশের পাতায় প্রবন্ধের বদলে সেই স্টাইলেই রইল নাসিরুদ্দিন হোজার কিছু অণুগল্প যেগুলো সত্যজিৎ এর বইতে নেই। তুরস্কে নাসিরুদ্দিনের হাজার হাজার গল্প, স্থানীয় গল্পগুলির ইংরেজীতে অনুবাদ খুব সুলভ অবশ্য নয়। তাও সেরকম-ই একটি বই পেয়ে যাওয়ায় সাহস করে বাংলায় অনুবাদ করে ফেললাম নিজেই। জানাবেন কেমন লাগল।
১।
সকাল সকাল হোজা চলেছে , বাহন একটি গাধা। পেছন পেছন আরো দুটো গাধা বয়ে নিয়ে আসছে নাসিরুদ্দিনের মালপত্র। সেই দেখে গ্রামের মোড়ল ফুট কাটল, “নিজের বাচ্চাদের নিয়ে চললে কোথায় হোজা”?
অম্লানবদনে জবাব দিল নাসিরুদ্দিন, “পাঠাশালায় নিয়ে যাচ্ছি, সব কটাই মোড়ল হতে চাইছে কিনা”।
২।
নাসিরুদ্দিনের বাড়িতে নাকি চল্লিশ বছরের পুরনো এক বোতল শরাব আছে, এমনতর খবর পেয়ে হোজার পড়শী দৌড়ে গেছে। কড়া নাড়ার শব্দ শুনে হোজা দরজা খুলতেই পড়শীর মিনতি “চল্লিশ বছরের শরাব একটু পেতে পারি জনাব?”। গম্ভীরমুখে নাসিরুদ্দিন জানাল “সে শরাব আছে বটে আমার কাছে তবে দেওয়া টেওয়া যাবে না”। পড়শীর বিরস বদন দেখে হোজা বললে, “চাইলেই পাওয়া গেলে কি ‘চল্লিশ বছরের শরাব’ তৈরী হত?”।
৩।
নিজের পোষা মুরগীটাকে বাজারে বিক্রি করার মতলব নাসিরুদ্দিনের, কিন্তু সে মুরগী ধরা দিতে চায় না কিছুতেই। শেষমেশ কয়লার গাদার মধ্যে অনেক হুটোপাটি করে তাকে ধরা হল, মাঝখান থেকে কয়লার গুঁড়োয় গেল মুরগীর রঙ কালো হয়ে।
বাজারে পাওয়া গেল এক খদ্দের কিন্তু সে অনেক দেখে টেখে হোজাকে জানাল, “মুরগীটা সাদা হলে তবেই না নিতাম! কালো মুরগী চাই না”। শোনা মাত্র নাসিরুদ্দিন দিয়েছে মুরগীকে এক রাম চিমটি, মুরগী কোঁকর কোঁ করে ঝটপটিয়ে উঠেছে, আর কয়লার গুঁড়োর মধ্যে দিয়ে বেরিয়ে পড়েছে একটু সাদা রং ।
“তোমার জন্য রঙ অবধি বদলে ফেলছে এ মুরগী, তুমি মুরগী না চাইলে কি হবে মুরগী কিন্তু তোমাকে চায়” – জানাল নাসিরুদ্দিন।
৪।
বাজারে ঘুরতে ঘুরতে হোজা দেখে একটা পুঁচকে পাখির দাম উঠল দশ মোহর। সেই দেখে দৌড়ে বাড়ি এসে নিজের পোষা টার্কি টা কে নিয়ে ফের বাজারে গেল নাসিরুদ্দিন, দর চাইল কুড়ি মোহর। বাজারের লোকেরা বলল, “কি যে বল হোজা, একটা টার্কির দাম কখনো কুড়ি মোহর হয়?” নাসিরুদ্দিন তর্ক জুড়ে দিল, “অতটুকু ছোট একটা পাখির দাম দশ মোহর হলে আমার এই প্রমাণ সাইজ টার্কিটার দাম বেশক্ কুড়ি মোহর”। “বলো কি হোজা, ও তো কথা বলা টিয়া – ওর দাম তো দশ মোহর উঠবেই”। “কিন্তু সে টিয়া তো আমার টার্কির মতন চিন্তা করতে পারে না”।
৫।
একদিন আড্ডার মধ্যে সবাই মিলে হোজাকে শুধোল, “নাসিরুদ্দিন, তোমার ক’জন সত্যিকারের দোস্ত আছে?” “এ বছর সেটা বলা মুশকিল খুব”, জানাল হোজা। সবাই তো অবাক, “কেন কেন, এ বছর বলা যাবে না কেন?” “আর বোলো না, এ বছর আমার ক্ষেতে বিস্তর ফসল হয়েছে যে”।
৬।
নাসিরুদ্দিনের নাপিত দাড়ি কামাতে গেলেই হোজার গাল কেটে ফেলে, সে এক মহা সমস্যা। একদিন দাড়ি কামানোর সময় শোনা গেল বিকট শব্দ, নাপিত-ও চমকে উঠে দিয়েছে ক্ষুরের এক লম্বা টান। যন্ত্রণা সহ্য করে নাসিরুদ্দিন জিজ্ঞাসা করল, “কিসের শব্দ হে?”। “ঘোড়ার পায়ে নাল পরাচ্ছে তো, তাই ঘোড়াটা চেঁচাচ্ছে” – জানাল নাপিত। “তাই বলো, আমি ভাবলাম কেউ দাড়ি কাটাচ্ছে বোধ হয়”।
৭।
আজান পড়তে পড়তেই একজন প্রাণপণে দৌড়চ্ছিল। মাথামুন্ডু বুঝতে না পেরে সবাই এসে নাসিরুদ্দিনকে শুধোল ব্যাপারটা কি। ক্ষণেক মাথা চুলকে নাসিরুদ্দিন জানাল, “ও দেখতে চায় ওর গলার স্বর কতদূর অবধি পৌঁছয়”।
৮।
“তোমার কি মনে হয় হোজা, গ্রামের আগা সাহেব স্বর্গে যাবে না নরকে?” নাসিরুদ্দিনকে দেখে সবাই একসঙ্গে জিজ্ঞাসা করে উঠল। নাসিরুদ্দিন ভারিক্কী চালে জবাব দিল, “কোত্থাও না, এখানেই থাকবে”। “সে আবার কি?”, সবাই ভারী অবাক। “আরে, কফিনে ঢোকার জন্য ঠিক একটা গরীবকে পেয়ে যাবে আগা, খুব চিনি ওকে।”
৯।
চমৎকার একটা বিকালে মাঠে শুয়ে শুয়ে চারপাশ দেখছিল আমাদের হোজা – পাশেই একটা গরু চরছে আর উড়ে বেড়াচ্ছে একটা কাক। দেখে ঈশ্বরের কাছে অনুযোগ জানাল নাসিরুদ্দিন, “এ তোমার কেমনধারা বিচার! কাক তো কোনো কাজেই আসে না কিন্তু ওকে দিলে উড়তে, আর যে এত কাজে আসে তাকে আটকে রাখলে মাটিতে”। বলতে বলতেই সেই কাক বিষ্ঠা ত্যাগ করেছে নাসিরুদ্দিনের ওপর। নাসিরুদ্দিন ভারী অবাক হয়ে বলল, “তোমার বিচার নিয়ে আর কোনো প্রশ্ন নয় খোদা! ভাগ্যিস, গরু ওড়ে না”।
১০।
ঝমঝম করে বৃষ্টি নেমেছে, নাসিরুদ্দিন জানলার পাশে বসে তাই দেখছিল – চোখে পড়ল এক পড়শী পড়ি কি মড়ি করে দৌড়চ্ছে। হোজা ডাক ছাড়ল, “কি হে, এত দৌড়ও কেন?” “দেখতে পাও না নাকি হোজা? বৃষ্টি পড়ছে যে, ভিজে মরব নাকি?”
নাসিরুদ্দিন গম্ভীর হয়ে বলল, “বৃষ্টি হল আল্লার আশীর্বাদ, তার থেকে এরকম ভাবে দৌড়ে পালানো কি ঠিক?”
পড়শী পড়ল লজ্জায়, দৌড় থামিয়ে চুপচুপে ভিজে ফিরল বাড়ি।
পরের দিন-ও বৃষ্টি, এদিন কিন্তু পড়শী বাড়ির ভেতরে, দেখে নাসিরুদ্দিন তড়িঘড়ি করে দৌড়চ্ছে। পড়শী হেঁকে বলল, “কি গো, নিজের উপদেশ যে ভুলে গেলে বড়?” পা চালাতে চালাতে নাসিরুদ্দিনের জবাব, “আমি তো শুধু চেষ্টা করছি ঈশ্বরের আশীর্বাদের ওপর পা না ফেলতে”।
১১।
সুলতানের নতুন চাকর চাই কিন্তু পছন্দ হচ্ছে না কাউকেই, লাইন ধরে বাতিল করে যাচ্ছেন সবাইকেই। রাজদরবারে সেদিন হোজা-ও উপস্থিত, আর থাকতে না পেরে বলল, “জাহাঁপনা, শেষের জন কিন্তু দিব্যি ছিল”।
“ও হাসার সময় বত্রিশ পাটি বার করে রেখেছিল যে, পছন্দ হয় নি মোটেই” – বিরস বদনে জানালেন সুলতান।
মাথা নেড়ে নাসিরুদ্দিন বলল, “নিশ্চিন্ত থাকুন, আপনার কাজ শুরু করে দিলে বত্রিশ পাটির একটিও বেরোবে না”।
১২।
নিজের ক্ষেতে কাজ করছিল আমাদের হোজা। এমন সময় কে একজন হেঁকে বলল, “পাশের গাঁয়ে যেতে কতক্ষণ লাগবে বাপু?” কোনো উত্তর নেই। আবার প্রশ্ন করল সে, আবারো কোনো উত্তর নেই। বার বার তিনবার হওয়ার পর রেগেমেগে সে ব্যক্তি হাঁটা লাগাল।
এবার নাসিরুদ্দিন পেছন থেকে ডেকে বলল, “ঘন্টা তিনেক মতন লাগবে।”
“তুমি কি আমার সঙ্গে মস্করা করছ নাকি? এতক্ষণ ধরে জবাব দিলে না যে বড় আর এখন পিছু ডাকছ।”
নাসিরুদ্দিন হাতের কাজ সারতে সারতে বলল, “তোমার হাঁটা না দেখলে কি করে জানব কতক্ষণ লাগবে”।
১৩।
শিকার করে ফিরছিলেন সুলতান, দেখেন কনকনে শীতের দিনে হোজা একটা পাতলা জামা গায়ে বেড়াতে বেরিয়েছে।
“কি ব্যাপার হে ? পুরু পশমের জামা পরে আমি কেঁপে যাচ্ছি আর এত পাতলা জামা পরেও তোমার কোনো হেলদোল নেই। রহস্যটা কি?”
“আজ্ঞে আপনার যত কটা জামা আছে তার সবগুলো পরে ফেললেই ল্যাঠা চুকে যেত, ঠান্ডা লাগত না মোটেই; আমি তো তাই করেছি”, হেসে জানাল নাসিরুদ্দিন।
১৪।
রাজদরবারে পৌঁছে সুলতান দেখেন হোজা খুব মন দিয়ে সভাসদদের সঙ্গে আলোচনায় ব্যস্ত।
সুলতানের একটু পেছনে লাগার ইচ্ছে হল, সবাইকে ডেকে বললেন “ওহে, নাসিরুদ্দিন বড় মিথ্যা কথা বলে, ওর কথা শুনো না”।
নাসিরুদ্দিন সম্মতি জানিয়ে বলল, “যা বলেছেন খোদাবন্দ, আপনার দরবারে ন্যায়বিচার পাওয়া কত সহজ সে কথাই জানাচ্ছিলাম”।
১৫।
পড়শীর বাড়ির পাশ দিয়ে যেতে যেতে নাসিরুদ্দিনের কানে আওয়াজ এল, জানলার দিকে সরে গিয়ে দেখে পড়শী বিছানায় শুয়ে প্রার্থনা করছে “হে আল্লা, আমাকে স্বর্গের পথ দেখাও”।
সেই দেখে নিজের বাড়িতে ফিরে এসে হোজা বাড়ির চালের উপর উঠে “কই রে, কই” বলে চিৎকার শুরু করে দিল।
চেঁচামেচিতে বিরক্ত হয়ে এবার পড়শী বেরিয়ে এসেছে, “সকাল সকাল এত হট্টগোল কিসের?”
“আরে, আমার গাধা টাকে খুঁজে পাচ্ছি না যে”।
পড়শী আরো বিরক্ত হয়ে বলল, “তোমার মাথা খারাপ নাকি! বাড়ির চালে গাধা খুঁজছ?”
“তুমি বাড়ির বিছানায় স্বর্গ খুঁজতে পারো আর আমি বাড়ির চালে গাধা খুঁজলেই দোষ?” শান্ত স্বরে উত্তর নাসিরুদ্দিনের।