চোর-জোচ্চোর

 

chor

বহু লোকে বলেন ইভ-ই প্রথম চোর। আমি অবশ্য এ ব্যাপারে একটু সন্দিহান, আপেল গাছটি কি কারোর প্রাইভেট প্রপার্টি ছিল? নিশ্চয় নয়। নিষিদ্ধ কাজের তাড়নাটা বেশ বুঝতে পারি কিন্তু টেকনিক্যালি একে চুরি বলা যাবে কিনা সে নিয়ে বেশ সন্দেহ আছে। কিন্তু চৌর্যবৃত্তির ইতিহাস যে অতি প্রাচীন সে নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। বিশ্বের প্রায় সমস্ত ধর্মগ্রন্থগুলিতেই কেন চুরিবিদ্যা মহাবিদ্যা নয় সে নিয়ে বিস্তর উপদেশ দেওয়া হয়েছে, কিছু কিছু ধর্মগ্রন্থে আবার চুরির সাজা কি হতে পারে সে নিয়ে স্পষ্টাস্পষ্টি মত ব্যক্ত করা হয়েছে। কিন্তু এ সবই ব্যক্তিবিশেষের সাজা – গোষ্ঠীবদ্ধ ভাবে চুরিও যে হতে পারে সে নিয়ে বিশেষ ধারণা বোধহয় সুপ্রাচীন যুগে ছিল না। গোষ্ঠী বলতে ‘আলিবাবা ও চল্লিশ চোর’ এর চল্লিশ চোর ধরণের কথা বলছি না। এ গোষ্ঠীর মাথারা সমাজের হর্তাকর্তা, এ গোষ্ঠীর সদস্যদের পেছনে ঢিল নিয়ে জনতা ‘চোর, চোর’ চেঁচাতে চেঁচাতে ছোটে না, এ চুরির হেতু অভাব নয়, নিতান্তই লোভ। কখনো সখনো অবশ্য কুক্ষিগত ক্ষমতার জোরেও চুরি করে যেতে পারে মানুষ। আধুনিক ইতিহাসে এ ধরণের চুরি সব থেকে বেশী ঘটেছে বোধহয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। জার্মানি থেকে নরওয়ে, অস্ট্রিয়া থেকে হাঙ্গারি – নাজি সৈন্যরা চুরি চালিয়ে গেছে কবরখানায়, সিনাগগে, রাস্তার পাশে ছোট মুদির দোকানটায়, গলির ভেতরের সেলুনে। কিন্তু তা বলে ভাববেন না শুধু অক্ষশক্তিই একতরফা চালিয়ে গেছে এ চুরি, সুযোগ যখন এসেছে মিত্রশক্তির সৈন্যরাও পিছিয়ে থাকেনি – ফাঁকা অ্যাপার্টমেন্ট থেকে ব্যাঙ্ক, মিউজিয়ম থেকে দুষ্প্রাপ্য বইয়ের দোকান, বাদ পড়েনি কিছুই।

যাই হোক, নিজের শহরে ফিরে আসি। লক্ষ লক্ষ মানুষের সামান্য সঞ্চয়টুকু যে সমস্ত চোররা নিজেদের পকেটস্থ করেছে তাদেরকে পর্যায়ক্রমে জেলে যেতে দেখে নিতান্তই খুশী হয়েছি। ঝুলি থেকে এখনো সব বেড়াল বেরোয়নি, কিন্তু যে বেড়ালরা বেরোয়নি তারাও যে গোঁফে তা দেওয়ার মতন অবস্থায় নেই সেটা একটা ভরসার কথা। তবে সব চোরদের দেখেই কি আর বিবমিষার উদ্রেক ঘটে? সে উত্তর দেওয়ার জন্যই আসুন পরিচয় করিয়ে দি এমন কিছু চোরেদের সঙ্গে যাদের আমরা মনে রেখেছি নিতান্তই মানবিক কারণে।

অঘোর দাস – তরুণ মজুমদারের ‘সংসার সীমান্তে’ চলচ্চত্রটি এখন দুষ্প্রাপ্য, কিন্তু প্রেমেন্দ্র মিত্রের যে ছোটগল্প অবলম্বনে সিনেমাটি বানানো সেটি পড়ে ফেলতেই পারেন। প্রেমেন্দ্র মিত্রের কিছু ছোটগল্প বিশ্বমানের, ‘তেলেনাপোতা আবিষ্কার’ বা ‘মহানগর’ এর মতনই এ গল্পটিও একবার পড়ে ফেললে ভুলে যাওয়া প্রায় অসম্ভব। অঘোর দাস চোর তো বটেই কিন্তু তার জন্য কোনো অনুতাপ নেই। সে জানে বাঁচার তাগিদেই তাকে চুরি করে যেতে হবে, সে চুরি কার ঘরে গিয়ে করতে হচ্ছে সে নিয়ে ভাবার অবকাশ তার নেই। আর এই নিঃস্পৃহতা থেকেই একদিন অঘোর দাস চুরি করে জনপদবধূ রজনীর ঘর থেকে; সেও যে তার মতনই এক হতভাগ্য মানুষ এ নিয়ে কোনো তাপউত্তাপই জমেনি তার মনে। ভাগ্যের বিড়ম্বনায় চালচুলোহীন অঘোরকে একদিন ফিরে আসতে হয় রজনীর ঘরেই। বিগতযৌবনা রজনীর হাতে তার শারীরিক ও মানসিক লাঞ্ছনা কমে ঘটে্না কিন্তু তার পরেও জন্মে যায় একটা টান, সে টানের উৎস কাম-প্রেম-অর্থ  নয়, শুধু জীবনে থিতু হওয়ার একটা বাসনা। জীবনের সব থেকে বড় এবং শেষ চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে অঘোর দাস শেষবারের মতন চুরি করার প্রস্তুতি নিতে থাকে, পারবে সে?

অমূল্য  – ও’হেনরির জিম আর ডেলা কে মনে আছে তো? নরেন্দ্রনাথ মিত্রের ‘চোর’ পড়তে বসলে এদের কথা আপনার মনে পড়বেই, কিন্তু ‘দ্য গিফট অফ ম্যাজাই’ এর সঙ্গে এ গল্পের কোনো আপাত-সাদৃশ্যই নেই। অমূল্য অঘোর দাসের মতন চালচুলোহীন নয় – তার নিজস্ব সংসার আছে, মাথা গোঁজার জন্য আছে নিজের ঘর। কিন্তু তারপরেও অমূল্য চোর, নিম্নবিত্ত জীবনযাপন করতে করতে সেই ধরে নিয়েছে চুরি করাটা প্রায় অধিকারের মধ্যেই পড়ে। সেই অধিকার বলুন কি অভ্যাসের তাগিদেই অমূল্য মনোহারি দোকান থেকে রেণুর জন্য চুরি করে নিয়ে আসে সাবান আর স্নো, অম্লানবদনে ট্রামে বিনা পয়সাতেই যাতায়াত করে এমনকি বৌকে আদর করার সময় মনে করিয়ে দেয় প্রতিবেশী বিনোদ বাবুর বাড়ি থেকে একটা কাঁসার বাটি উঠিয়ে আনলে সংসারে বেশ সাশ্রয় হয়। রেণু স্বামীর এমন ব্যবহারে মরমে মরে থাকে কিন্তু অমূল্যর স্বভাব পালটায় না। কিন্তু সব দিন সমান যায় না, চুরি করতে গিয়েই ধরা পড়ে চাকরিটুকু খোয়ায় অমূল্য। সংসার বাঁচাতে কি করবে রেণু?

বারীন ভৌমিক – চুরি করাটা যে নিতান্তই একটা অসুখ-ও হতে পারে, আমবাঙ্গালীকে প্রথমবার সে কথা জানালেন সত্যজিৎ রায়। ‘বারীন ভৌমিকের ব্যারাম’ গল্পে আমরা দেখেছি ক্লেপটোম্যানিয়াক বারীন ভৌমিক কে, দিল্লীগামী ট্রেনের ফার্স্ট ক্লাসের সহযাত্রীটিকে তিনি ন’বছর আগেও পেয়েছিলেন। অভ্যাসবশতই চুরি করে ফেলেছিলেন পুলক চক্রবর্তীর ট্র্যাভেলিং ক্লক। ন’বছর পরে সেই পুলক চক্রবর্তীকে আবার দেখে অপরাধবোধে ভুগতে থাকেন তিনি, ভয় জমাট বাঁধতে থাকে। শেষমেশ ঘড়িটা ফিরিয়ে দেন তিনি পুলককে, স্বীকার করে নেন তাঁর অসুখের কথা। কিন্তু পুলক চক্রবর্তীর অসুখের কথা কি বারীন জানেন?

কালমন আর মোগলাই –  কালমন আর মোগালাই কলোনির ছেলে, ক্লাস সিক্স থেকেই চুরি করে। অবশ্য সিক্সের পর ওদের আর পড়াও হয়নি। কোম্পানী লকআউটের পর ওরা দেখেছিল ভিক্ষে করে বিশেষ সুবিধা হয় না,  মোগলাইয়ের বাবা কৌটো নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে একদিন মরেই গেল। তার থেকে বরং গাড়ির হেডলাইট চুরি করা ভালো, কিংবা পেট্রলের জেরিক্যান – অন্তত বেশ কয়েকদিন চা বিস্কুট খাওয়ার পয়সা থাকে হাতে। চুরি এখানে সারভাইভ করার মন্ত্র, সবাই জানে, তাই কেউ বিশেষ মাথাও ঘামায় না। এই যেমন বাড়িতে লোকজন এলে কারেন্ট চুরি করাটাই ওদের কলোনিতে রেওয়াজ, না করলেই লোকে অবাক হবে। নষ্ট হয়ে যাওয়া কৈশোর আর তারুণ্যের কর্কশ শব্দ বড় অবলীলায় নবারুণ শুনিয়েছেন ‘কালমন আর মোগলাই’ গল্পে। কি ভবিষ্যৎ ওদের? রেলপুলিশের গুলি নাকি অন্য পার্টির বোমা?

গোলাপী –  গোলাপী ঠিক চোর নয়, ও জোচ্চোর। মেহগিনিতলায় ছাগলছানা নিয়ে বসে থাকে, দূর থেকে গাড়ি আসতে দেখলেই তৈরি হয়, আর কাছে এসে গেলেই ছাগলছানা কে গাড়ির তলায় ফেলে দিয়ে ডুকরে কেঁদে ওঠে। দলবল তৈরিই থাকে, গোলাপীর কান্নার শব্দ শুনলেই রে-রে করে তেড়ে আসে সব। তারপর শিকারের পকেট আর দম বুঝে চলে গা-জোয়ারি। তাদের নেতা কালী, কালীকে পাওয়ার জন্য গোলাপী হাসতে হাসতে এসব করতে পারে। কিন্তু কালী প্রেম ভালোবাসা বোঝে না, তার কাছে ধান্দাই সব। কালীর কাছে পাত্তা না পেলেই গোলাপীর মন মরে যাওয়া ছাগলছানা গুলোর জন্য হু হু করতে থাকে। ধান্দা ওর কাছে নিছক ধান্দা নয়,  একসাথে সংসার করার প্রিলিউড মাত্র। কিন্তু সে সংসার শুধু স্বপ্ন হয়েই রয়ে গেলে আর কত বার এই এক কাজ চালিয়ে যেতে পারে গোলাপী? বলিপ্রদত্ত কি শুধু ছাগলছানাই হতে পারে? সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের ‘সরাইখানা’ ওঁর শ্রেষ্ঠ গল্পগুলির মধ্যে অন্যতম, গোলাপীকে চেনার জন্য পড়তেই হবে।

পিটার স্বয়ম্ভু হোড় – জোচ্চোরের কথাই যখন উঠল তখন প্রফুল্ল রায়ের স্বয়ম্ভু কে অনেকেরই মনে পড়বে নিশ্চয়। বই পড়ার ব্যাপারে বিশেষ আগ্রহী না হলে টিভি সিরিয়ালের দৌলতেও কিন্তু মনে পড়ে যেতেই পারে – নব্বইয়ের দশকে প্রফুল্ল রায়ের চার খন্ডের সুবৃহৎ উপন্যাস অবলম্বনে তৈরি ‘আমাকে দেখুন’ বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল, ‘বেদের মেয়ে জ্যোৎস্না’ র ব্লকবাস্টার সাফল্যের পরেও চিরঞ্জিত হয়ত গল্পের সুবাদেই টিভি সিরিয়ালের নামভূমিকায় অভিনয় করতে দু’বার ভাবেন নি। জোচ্চুরিকে একটা শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছে স্বয়ম্ভু, দুর্নীতিগ্রস্ত শিল্পপতি বা রাজনৈতিক নেতাদের পকেট সাফ করার ব্যাপারে স্বয়ম্ভুর জুড়ি মেলা ভার। একটা হাল্কা রবিনহুড টাইপের ইমেজ থাকলেও বা মর‍্যাল ক্যারাক্টরটি অপ্রয়োজনীয় ভাবে শক্ত হলেও স্বয়ম্ভু নিজের পেশা নিয়ে বিন্দুমাত্র লজ্জিত নয়, বরং গর্বিতই। সত্যি ঘটনা অবলম্বনে বানানো এই চরিত্রকে কিন্তু লেখক দেখেছেন একজন মুক্তপুরুষ হিসাবে, চুরি বা জোচ্চুরি তার জীবনদর্শনের একটা  অঙ্গ।

মেরী ওঁরাও – মেরী শুধু চোর নয়, খুনীও বটে। কিন্তু চুরি বলুন কি খুন, জীবনে সে একবারই করেছে। অস্ট্রেলিয়ান সাহেব আর আদিবাসী চাকরানী মেরীর বাবা মা, স্বভাবতই আদিবাসীদের মতন সে দেখতে নয়। শুধু ভদ্দরলোকরা নয়, তাকে সমঝে চলে আদিবাসীরাও – খানিকটা গায়ের রঙের জন্য, খানিকটা তার তেজের জন্য। কিন্তু পয়সাওলা শহুরে ঠিকাদার তাকে সামান্য সম্মানটুকুও দিতে রাজি নয়, মেরী তার চোখে নিতান্তই ভোগ্য বস্তু। দা দেখায় মেরী, বহুবার – তাও ধর্ষকাম ঠিকাদারের হাত থেকে লাঞ্ছনার অবকাশ নেই ওর। শেষে এক চাঁদনি রাতে আদর করে শোয়ায় ঠিকাদারকে; উত্তুঙ্গ উত্তেজনার মুহূর্তটিতে অক্লেশে দা চালিয়ে দেয়, ওপর নিচ, ওপর নিচ। তারপর অবলীলায় পার্স থেকে বের করে নেয় একতাড়া নোট, আদিবাসী গ্রামে ফিরে এসে আকন্ঠ মদ খেয়ে পা চালায় নিজের পছন্দ করা পুরুষসঙ্গীটির অঙ্কশায়িনী হবে বলে। মহাশ্বতা দেবীর আরেক অমর চরিত্র দ্রৌপদী মেঝেনের মতনই মেরী ওঁরাও-এর (গল্পের নাম ‘শিকার’) তেজ-ও আমাদের সহ্যের বাইরে; হয়ত সে তেজে হাত পোড়াতে চাই না বলেই খুন বা খুনের পরে চুরি কোনো কিছুই অস্বাভাবিক লাগে না আমাদের, অনির্বাণ থাকে প্রতিহিংসার আগুন।

পাখিওলা – জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী বাংলার সর্বকালের শ্রেষ্ঠ গল্পকারদের মধ্যে একজন, তাঁর ‘সংহার’ গল্পের পাখিওলা চরিত্রটিও চোর কিন্তু অন্য যে সব চরিত্রদের কথা বললাম, তাদের সঙ্গে পাখিওলার একটা মস্ত তফাত আছে; সে চোর হওয়ার আগে থেকেই চোর, গল্পের প্রোটাগনিস্টরা তাকে শুরু থেকেই পছন্দ করেনি, তার ‘রুক্ষ মেটেমেটে গায়ের রঙ, উষ্কখুষ্ক চুল, ফ্যাকাশে চোখ, ছোট্টখাট্টো চেহারা’ দেখেই আমরা তাকে চোর বানিয়েছি (ওই প্রোটাগনিস্টরা তো আমি-আপনিই)। তাকে আমরা উপদেশ দিয়েছি পাখি ধরা বন্ধ করে কলকারখানায় কাজ দেখতে, পাখিদের প্রতি বাবুদের মমতা দেখে সে অবাক হয়েছে, হয়ত একটু বিরক্ত-ও। আমরাও কম বিরক্ত হই নি তাকে আমাদের কথায় কান দিতে না দেখে। চোর ব্যাটাচ্ছেলে, শুনবে কেন কথা? তাই যখন দেখি পেটের দায়ে সে পাখি ধরা ছেড়ে চুরি করতে শুরু করেছে, বিশেষ অবাক হই না। বরং বিরক্ত হই একটা ননসেন্সকে এখনো বেঁচে থাকতে দেখে, জ্যোতিরিন্দ্র নিজেও কম বিরক্ত হন না – তাই দিলেন ব্যাটাকে আমাদের গাড়ির তলায় ফেলে। আপদ বিদেয় হল।

 

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s