ইস্তানবুলে মাছের বাজারে ঘুরতে গেলেই প্রথম যে জিনিসটা আপনার চোখ টানবে সেটা হল মাছের কানকো। তুর্কী মাছের কানকোতে আলাদা করে কিছু বিশেষত্ব নেই, কিন্তু মাছ নির্বিশেষে প্রত্যেকের কানকো বের করে রাখা থাকবেই। টকটকে লাল কানকো বের করে রেখে জলের উজ্জ্বল শস্যরা জানান দিচ্ছে এ জিনিস বরফাচাপা ঝুড়ি থেকে বেরিয়ে আসে নি। আমি অবশ্য কলকাতার ছেলে, একবার সন্দিহান হয়ে এক তুর্কী বন্ধুকে শুধিয়েছিলাম কানকো বের করে রেখেছে মানেই যে টাটকা এর গ্যারান্টি কি, রং-ও তো করে রাখতে পারে। তিনি তক্ষুনি হাতের সামনে রাখা একটি মাছ তুলে বার দশেক জলের গামলায় চুবিয়ে প্রমাণ করে ছাড়লেন রং এখানে কেউ-ই মাখায় না। যাই হোক, আমাদের রুই-কাতলার মতন কমন মাছ হল এখানে চুপরা আর লেভরেক। চুপরা খানিকটা ভেটকি গোত্রীয় আর লেভরেক কে দেখলে মাঝে মাঝে আমাদের মৃগেল মাছের কথা মনে পড়ে যেতে পারে। তো এই চুপরা-ই বলুন কি লেভরেক এবং অন্য লোক্যাল মাছের দাম মোটামুটি ভাবে প্রতি কেজি পনের থেকে কুড়ি টার্কিশ লিরা ( এক টার্কিশ লিরা মানে ঐ ধরুন তিরিশ টাকা মতন)।
এই হিসেবটা মাথায় থেকেই যায়, আর হয়ত সেই কারণেই অক্টোবরের শুরুতে (যখন এখানে ফেস্টিভ সীজন) একদিন মাছের বাজারে ঢুকে ভারী চমকে গেলাম। দেশী বিদেশী নতুন মাছ দেখলেই মনে হয় ট্রাই করি, সেদিনকে প্রথমবারের মতন ‘লুফর’ দেখে বেশ উত্তেজিত। তুর্কী লুফরের পাশে আবার ইংরেজীতে লেখা ব্লুফিশ। দেখলাম সাকুল্যে তিন চার পিস পড়ে রয়েছে, আর মাছের বাজারে তুমুল ভিড়ের মধ্যেও লোকজন বিশেষ হাত বাড়াচ্ছে না সেদিকে। কেন কেউ হাত বাড়াচ্ছে না সে নিয়ে অবশ্য প্রথমটা মাথা ঘামাই নি, কারণটা মালুম হল বিলটা হাতে পাওয়ার পর। তিন পিস মাঝারি সাইজের মাছের দাম ষাট লিরা দেখে চক্ষু চড়কগাছ, তারপর দেখি কুড়ি লিরা যে দাম দেখেছিলাম সেটা প্রতি কেজি নয়, প্রতি পিস। ভাঙ্গাচোরা টার্কিশে অনুসন্ধান চালিয়ে বুঝলাম মাছটি দুষ্প্রাপ্য। কিন্তু দামের জন্য নয়, খানিকটা নামের জন্যই যেন মাছটার কথাটা মাথায় থেকে গেছিল – চুপরা শুনলেই যেমন মনে হয় মাছেরই নাম, লুফর শুনলে কিন্তু ঠিক সেরকমটি মনে হয় না, সাধারণ মাছের নামের তুলনায় একটু বেশীই লিরিক্যাল।
অতি সম্প্রতি সুলতানী আমলের তুর্কী রান্না নিয়ে একটি বই পড়তে গিয়ে লুফরকে ফিরে পেলাম। লুফর বেশ রয়্যাল মাছ – একে যে শুধু মাছেদের সুলতান বলা হয় তাই নয়, সুলতানদের মাছ বলতেও বোঝানো হত লুফরকে। সুলতানদের বিদায়ের ফলে ভালো ব্যাপার যেটা ঘটেছে সেটা হল লুফর আস্বাদনের ডেমোক্র্যাটাইজেশন। সাধারণ মানুষের ভাগ্যেও লুফর জুটতে শুরু করেছে কিন্তু লুফরের স্টেটাস সিম্বলের জন্যই হয়ত লোকে এত বেশী বেশী লুফর ধরেছে যে আজ লুফর বিপন্ন। চারা লুফর, পোনা লুফর কেউ বাদ যায় নি। মানুষ অবশ্য ঠেকে শেখে, এখন তাই ২৪ সেন্টিমিটারের ছোট লুফর ধরা মানা, এমনকি রেস্তোরাঁতে সে লুফর পরিবেশন হলেও মালিককে জেলের ঘানি টানতে হবে।
কিন্তু জেলে যাওয়াটাই বড় কথা নয়, লুফর হারিয়ে যাওয়া মানে ইস্তানবুলের ঐতিহ্যও একটু হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। শ শ বছর ধরে লুফর নিয়ে তুর্কী কবি সাহিত্যিকরা লিখে এসেছেন, সেসব-ও তো ভাবার ব্যাপার। বাঙ্গালীরা যেমন ইলিশ নিয়ে বড়ই অনুভূতিপ্রবণ, এ দেশে সেটাই দেখবেন লুফর নিয়ে। তবে ইলিশ যেমন ঝালে-ঝোলে-অম্বলে সবেতেই ফেলে দিতে পারেন, লুফর নিয়ে অবশ্য অমনটি করা চলবে না। আমরা সর্ষের ঝাল বানালেও সতেরশ শতকের সেয়াহতনামা বা আঠারশ শতকের রিসালে-ই-নুর বলছে লুফর খেতে হলে লুফর পোলাও বা লুফর কুলবাস্তে বানানোই ভালো; বলে রাখা ভালো কুলবাস্তে এক ধরণের কাবাব, যদিও সাধারণত বানানো হয় ভেড়ার মাংস দিয়ে। দেখলাম বাইজ্যান্টিয়াম আমলেও গ্রীক সম্রাটদের বেশ প্রিয় খাদ্য ছিল এই লুফর। ১০৮১ তে সম্রাট নিসেফোরাস বোট্যানিআটেস কে সন্ন্যাস গ্রহণ করতে বাধ্য করানো হয়। অন্য সন্ন্যাসীরা পরে সম্রাটকে যখন জিজ্ঞাসা করেন কেমন লাগছে এই নতুন জীবন, নিসেফোরাসের ছিল একটাই অভিযোগ – মাংস খাওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু সেটুকু বাদ দিলে মনাস্ট্রির মেনু নিয়ে কিন্তু দিব্যি খুশী ছিলেন ভদ্রলোক, আর হবে নাই বা কেন? সেই মেনু জুড়ে যে রাজ করছে লুফর!
কাদিকয় মাছের বাজারের পাশেই টার্কিশ মিষ্টির দোকান – কেজি কেজি বাকলাভা, লোকাম, পিস পিস হেলভা (হালুয়া) চোখের পলকে বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। যে সমস্ত ট্যুরিস্টরা বেশ আটঘাট বেঁধে ইস্তানবুল ঘুরতে আসেন তারা জানেন ইউরোপীয়ান সাইডের ইস্তানবুলের গ্র্যান্ড বাজার কি স্পাইস বাজার থেকে এসব কেনা মানে গলাটুকু বাড়িয়ে দেওয়া, সস্তায় একই মানের মিষ্টি কিনতে হলে আসতে হবে এশিয়ান সাইডে। তাই ইচ্ছে থাকলেও সবসময় ঢোকা যায় না এ দোকানে, অগুন্তি ট্যুরিস্টের ভিড়ে আমি তো দূরস্থান স্থানীয় বাসিন্দারাও বেশী পাত্তা পান না। গত দুই সপ্তাহ জুড়ে ইস্তানবুলে বৃষ্টির আনাগোনার জন্যই বোধহয় এবার ভিড়টা একদমই পাতলা ছিল। দোকানে ঢুকে চোখ বোলাতে বোলাতে থমকে গেলাম শোকেসের নিচের সারিতে এসে, সেখানে ট্রে ট্রে রঙ বেরঙের মিনিয়েচার ফল সাজিয়ে রাখা। এ জিনিস কলকাতার পাড়ার মিষ্টির দোকানেও দেখেছি, নিতান্তই চিনির গাদ – যদিও দোকানদাররা মাঝে মাঝেই আশ্বস্ত করার চেষ্টা করেন যে এ জিনিস আসল ক্ষীর দিয়ে বানানো। কিন্তু সে খাজা জিনিস তো ইস্তানবুলের অন্যতম মিষ্টির দোকানে থাকার কথা নয়। সন্দেহ আরো দৃঢ় হল যখন মিষ্টির নাম জিজ্ঞাসা করাতে দোকানদার আকাশ থেকে পড়লেন! ইস্তানবুলে থাকেন আর মারজিপান-এর নাম শোনেননি?
কাস্টমারের অভাবেই বোধহয় ভদ্রলোক ছোটখাটো একটা লেকচার দিয়ে ফেললেন মারজিপান নিয়ে – এ মিষ্টির জন্ম পড়শী দেশ ইরানে, কিন্তু সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে তুর্কীদের মাধ্যমেই। জানা গেল, অ্যামন্ড এবং মধু হল দুটো প্রধান উপাদান এ মিষ্টির, মধুর অভাবে চিনিও চলবে। বলতে বলতেই ভদ্রলোক ফস করে বার করে এনেছেন ট্রে – কি দেখছেন? আমি আমতা আমতা করছি দেখে বললেন, “ভালো করে ফিনিশিং টা দেখুন, একটার সঙ্গে আরেকটার মিল নেই। কেন জানেন তো? কারণ পুরোটাই হাতে বানানো। মারজিপান কতটা ভালো হবে সেটা ইনগ্রেডিয়েন্টসের ওপর বিশেষ নির্ভর করে না, হাতে বানানো হয়েছে কিনা সেটাই প্রশ্ন। দেখুন না, দেখুন, দেখুন……” বলতে বলতেই হাতে তুলে দিয়েছেন একটা আতা।
কি খারাপ খেতে!
ওঃ, সেই এক চিনির গাদ! এর থেকে এমনকি গুজিয়াও ঢের ভালো।
কপাৎ করে গিলে ফেলে বেরোতে যাচ্ছি দেখি ভদ্রলোক জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে। ব্যাজার মুখে ওয়ালেটের দিকে হাত বাড়ালাম।
মারজিপানের ঠোঙ্গা আর চিটচিটে জিভ নিয়ে দোকান থেকে বেরিয়ে ভাবছি চিনির লেয়ার জিভ থেকে কি করে সরানো যায়, চোখে পড়ল সামনেই ঠেলাগাড়ি নিয়ে এক সালেপওলা দাঁড়িয়ে। যদি আপনি কখনো ইস্তানবুলে ঘুরে গিয়ে থাকেন, টোপকাপি প্যালেসের সামনে এরকম ঠেলাগাড়ি নিশ্চয় চোখে পড়েছে আপনার।
ঠেলাগাড়ীর ওপরে রাখা বিশাল পিতলের পাত্র, সেখান থেকে ঈষৎ হলদেটে এক উষ্ণ (এবং ঘন) পানীয় ঢেলে বিক্রি করা হচ্ছে। এ পানীয়ের মূল উপকরণ হল অর্কিডের শেকড়। গরম দুধে অর্কিডের শেকড়গুঁড়ো আর অর্কিডের কুঁড়ি মিশিয়ে তৈরি হয় এ পানীয়, শোনা যায় কোন সুলতানের হেড বাবুর্চির মাথা থেকে বেরিয়েছিল এ আইডিয়া। অর্কিড শুনে অবাক হচ্ছেন কি? অর্কিডের আর এক নাম কিন্তু ‘বট্যানিকাল ভায়াগ্রা’, অনাদিকাল ধরে পৌরুষ ধরে রাখার অদম্য বাসনা অন্য রাজাগজাদের মতন অটোমান সুলতানদের-ও নিয্যস ছিল। সুতরাং, বেরনোর সঙ্গে সঙ্গে-ই আইডিয়া সুপারহিট! এখন অবশ্য বাজার ধরার জন্য অর্কিডের আরো গুণাবলী ফলাও করে প্রচার করা হয়, বলা হয় বাচ্চাদের সর্দিকাশির-ও অব্যর্থ দাওয়াই এ পানীয়। আমি অবশ্য মজেছিলাম এর রূপ দেখে – সালেপ এমনি খাওয়ার চল নেই, এর ওপর আপনাকে ছড়িয়ে নিতেই হবে দারচিনির গুঁড়ো। আহা, সে কি দৃশ্য, নিতান্ত বেরসিক ছাড়া বাকি সবাই একবারের জন্য হলেও থমকে দাঁড়িয়ে এ জিনিস দেখবেন – খান আর না খান।
শোনা যায় অটোমান আমলের তুরস্ক থেকে সালেপ ছড়িয়ে পড়েছিল গোটা ইউরোপেই। ইংল্যান্ডে এ পানীয় সতেরশ শতকে এতটাই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে যে চা বা কফি আসার আগে অবধি সালেপ-ই ছিল রোজকার পানীয়। গোটা ইউরোপ জুড়ে এত চাহিদার জন্যই বোধহয় অর্কিড প্রায় লোপ পেতে বসেছিল এ তল্লাট থেকে, এখন অবশ্য টার্কি এবং আরো কয়েকটি দেশে অর্কিডের বিদেশে চালানের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে।
তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আপনাকে ইনোভেটিভ হতেই হবে, বুঝতে হবে বিশ্বায়িত বাজারের চাহিদাকে। সে কথা মাথায় রেখে যেমন বলরাম মল্লিক চকোলেট সন্দেশ বাজারে ছাড়ছেন কিম্বা কে-সি-দাশ নিয়ে আসছেন চকোলেট ছানার পায়েস, একইরকম ভাবে ইস্তানবুলের দোন্দুরামজি আলি উস্তার দোকানে গেলে শুধু সালেপ পাবেন না, পাবেন সালেপ আইসক্রিম। আবার আরেক জনপ্রিয় দোকান সরায় মুহল্লাবেজিসিতে গেলে পেয়ে যাবেন সালেপ পুডিং।
এখনও কি খুব অচেনা মনে হচ্ছে দেশটাকে?
lufor er kabab khabar bashona roilo….darun lekha…lufor ar salep er chhobi google korle pabo hoyto…kintu ei lekhar modhyei chhobi thakle jome jeto!
LikeLike
অভিষেক – ঠিক বলেছিস, ছবিটা দিলে হত। যাক গে, এই হল লুফর – http://blog.milliyet.com.tr/lufer-ve-palamut-baliginin-boy-uzunluklari-hakkinda/Blog/?BlogNo=389137
আর এই হল সালেপ – http://goo.gl/jQbEF8
LikeLike
desh tar upore lobh dhore jachhe kintu. giye tor baritei hamla korbo. tokhon bujhbi moja. 😛
LikeLike
চলে আয় স্বাতী, সাদর আমন্ত্রণ রইল 🙂
LikeLike
Durdanto lekha. Jinish gulo publish korar chesta koro kokhono. Salep er prothom ullekh ekhane peyei mone porlo ota to kheychhi ice cream e. Jothariti dekhi shesh e ice cream er ullekh. Tomar lekha pore ichhe hoy abar Istanbul jai. Boro bhalo legechhilo jayga ta.
LikeLike
একেবারেই অচেনা লাগছেনা। একেবারে দিল্লীর চাঁদনি চক, বা কলকাতার হাতিবাগান বাজার।
পামুকের লেখা পড়েও দেশটাকে খুবই চেনা লেগেছিল।
LikeLike
আহা, বড্ড সুস্বাদু লেখা। 🙂
মাছ, মিষ্টি আর সবকিছু মিলিয়ে পুরো দুর্দান্ত হয়েছে। 🙂
LikeLike
চেটেপুটে খাওয়ার লেখা। উফহ, একবার ওই দেশটায় ঢুঁ না মারলেই নয় দেখছি!
LikeLike