কালীপুজো গেছে গত সপ্তাহেই, এক বন্ধু জিজ্ঞাসা করলেন কালীর নৃতাত্ত্বিক বা সমাজতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা নিয়ে বাংলায় কোনো বই আছে? আছে তো নিশ্চয় কিন্তু প্রবাসে ভরসা নিজের সংগ্রহ এবং ইন্টারনেটে ইতিউতি ছড়িয়ে থাকা বইয়ের ওপরেই। কিন্তু সেই সংক্ষিপ্ত পরিসরে কিছুই পাওয়া গেল না; বাধ্য হয়ে বন্ধুকে বললাম আপাতত ওয়েন্ডি ডনিগারের “হিন্দুজ : অ্যান অল্টারনেটিভ হিস্ট্রি” তে চোখ বোলানো যাক, বাংলা বইয়ের সন্ধান পাওয়া গেলেই জানাবো। যাই হোক, এক সপ্তাহের মধ্যেও কিছু খুঁজে পাওয়া গেল না কিন্তু বিষয়টি নিয়ে আমারও এতই উৎসাহ জাগল যে একটা ব্লগপোস্টের কথাই ভেবে ফেললাম।
কালী কলকাত্তাওয়ালী শব্দগুচ্ছ নেহাত অবান্তর কথা নয়, কালী যে মূলত বাংলার দেবী সে নিয়ে আমাদের সন্দেহের অবকাশ নেই। কালীঘাটের ইতিহাস তো আছেই; আরো ধরুন উইলিয়াম স্লীম্যানের কথা, যিনি কালীউপাসক ঠগীদের সাথে বাকি বিশ্বের পরিচয় করান, ছিলেন বেঙ্গল রেজিমেন্টের অফিসার। বাংলায় থাকাকালীনই শুনেছিলেন রক্তপিপাসু কালীর কথা, ঠগী প্রসঙ্গে জানিয়েছিলেন কালী বাঙ্গালীদেরই আরাধ্য দেবী। বাংলায় আবার ফিরে আসব কিন্তু কয়েকটা বিষয় তার আগে আলোচনা না করলেই নয়। কালীর কথা কিন্তু আমরা হিন্দু পুরাণে দেখতে পাচ্ছি প্রায় ৬০০ খ্রীষ্টাব্দ থেকেই – অগ্নি পুরাণ এবং গড়ুর পুরাণে কালীর পরিচয় দেওয়া হচ্ছে যুদ্ধের দেবী হিসাবে। শুধু তাই নয়, ইনি প্রেতপৃষ্ঠে ঘুরে বেড়ান এবং শ্মশানে থাকেন; শুধু বাহ্যিক রূপ দেখলেই ভয় হয় না, উন্মত্ত হাসি এবং তান্ডব নৃত্যর কথাও মাথায় রাখতে হবে। ভাগবত পুরাণে আবার বলা হচ্ছে এক দল চোরের আরাধ্য দেবী এই কালী, যাদের সর্দার পুত্রলাভের আশায় এঁর কাছে ধর্না দিয়ে পড়ে থাকেন। ভাগবত পুরাণ পড়েই ঠগীরা উদ্বুদ্ধ হয়েছিল কিনা জানা নেই, তবে শোনা যায় ঠগীরা নিজেদের রক্তবীজ অসুরের বংশধর বলে ভাবতে ভালোবাসত তাই হয়ত কালীর উপাসনা। প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখি যতই গুরুজনরা বলে থাকুন যে শিবের বুকে উঠে পড়ার জন্য লজ্জায় কালীর জিভ বেরিয়ে গেছিল, আসল কারণ কিন্তু ওই রক্তবীজ। রক্তবীজের এক বিন্দু রক্ত মাটিতে পড়লেই যেহেতু রক্তবীজের ক্লোন এসে উপস্থিত হবে, কালীর জিভ বার করে রাখা ছাড়া উপায় ছিল না। কালীর বুকের নিচে শিবকে পরে ঠেলে পাঠিয়েছেন পুরাণকার রা। তন্ত্রশাস্ত্র অনুযায়ী অবশ্য বুকের ওপর উঠে পড়াটা বেখেয়াল বা ঝগড়া হেতু নয়, পুরুষ ও প্রকৃতির মিলনের পূর্বাভাষ।
পুরাণ বলুন বা তন্ত্র, কালী কিন্তু সমস্ত দেবীদের মধ্যে সব থেকে ফ্রী স্পিরিটেড। যদিও পুরাণ অনুযায়ী কালী এই ফ্রী স্পিরিটের মর্যাদা রাখতে পারেন না প্রায়শই – তাই বিশ্বসংসারকে রক্ষা করতে যখন তাঁকে পাঠানো হয়, অধিকাংশ সময়েই শত্রুদের ধ্বংস করার সাথে সাথে শেষ করেন সেই বিশ্বসংসারকেই। হিন্দু ধর্মের হায়ারার্কি অনুযায়ী কালীর স্থান লক্ষ্মী, সরস্বতী এবং দুর্গার পরে কিন্তু কালীর ক্রোধ খন্ডন করার সাধ্য এনাদের তো নেইই এমনকি হোলি ট্রিনিটিরও নেই। আবার তন্ত্রশাস্ত্র অনুযায়ী কালী হচ্ছেন সেই তিন দেবীর একজন যাঁদের অখন্ড সার্বভৌমত্ব আছে (বাকি দু’জন হলেন নীল সরস্বতী এবং তারা)। বৃহন্নীল তন্ত্র আরো জানাচ্ছে নীল সরস্বতী এবং তারা দুজনেই তরুণী এবং পূর্ণযৌবনপ্রাপ্তা কিন্তু কালী অতটাও নবীনা নন এবং দেখতেও বেশ শীর্ণকায়, তাই বাকি দু’জনের থেকে কিছুটা তফাৎ আছে। আরো একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হল তন্ত্রশাস্ত্র অনুযায়ী নীল সরস্বতী এবং তারা দু’জনকেই মহামায়া বলা হলেও কালীকে সে নামে ডাকা হচ্ছে না (যদিও বৃহন্নীল তন্ত্রে এটাও বলা হচ্ছে যে এই তিন জনকে আলাদা করে দেখার চেষ্টা করলে নরকগামী হতে হবে) – অর্থাৎ কালী আর যাই করুন বেকার বিভ্রম ছড়িয়ে তাবৎ ভক্তকুলকে ঘাবড়ে দেন না।
পুরাণ এবং তন্ত্রশাস্ত্র, দু’দিক থেকেই দেখে একটা কথা আমার বারেবারেই মনে হয় – কালী যেন সাধারণ ঘরের এক স্বাধীনচেতা মেয়ের প্রতীক। রূপ, যৌবন বা বংশমর্যাদা কোনো কিছু দিয়েই ভোলাতে ইনি চান না, কিন্তু তাই বলে ফ্রী স্পিরিটের কমতি নেই। আর সে স্বাধীনচেতা মেয়ের তেজ এমনই যে সমাজের মাথারাও সেখানে নিজেদের মতামত চাপিয়ে দেওয়ার সুযোগ পান না। স্বভাবতই চরম পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বহু পুরাণকার শেষমেশ কালীকে অসভ্য জাতের উপাস্য দেবী বলে ঠাউরেছেন, দেখিয়েছেন প্রায় জংলী এক মূর্তিকে যাঁকে ঘিরে থেকেছে চোর, ডাকাত আর খুনীরা। তন্ত্রশাস্ত্রের লেখকরা কিন্তু কালীর প্রতি অনেক সদয়, এবং সেখানে কালী নিছক এক হিন্দু দেবী নন, সমগ্র নারী জাতির প্রতীক। ‘কালী সাধনা’য় যৌন মিলন অপরিসীম গুরুত্ব পেয়েছে কিন্তু বারেবারেই বলা হয়েছে নারী পূজক নন, পূজ্য। নারীর দেহের প্রতি সম্মান না থাকলে কালী সাধনা করা সম্ভব নয়। একই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বলা হয়েছে ‘কুমারী পূজা’ করার কথা, যৌন মিলনের বয়স যাদের আসেনি তাদের শরীরেরও যে সম্মান প্রাপ্য সেটা তুলে ধরাই এ পুজোর অন্যতম উদ্দেশ্য। নারীমুক্তিতে যে গোটা সমাজেরই মুক্তি এবং সে মুক্তি সাধনে শরীরের ভূমিকা বোঝাটা যে নিতান্তই জরুরী, এহেন আধুনিক চিন্তাধারা কিন্তু পুরাণে পাবেন না, পাবেন তন্ত্রে। বার্নার্ড কলেজের অধ্যাপক রেচেল ম্যাকডারমটের গবেষণার বিষয় হিন্দু দেবী এবং মূলত কালী – ওপরের কথার সূত্র ধরেই রেচেলও বলছেন পুরুষতান্ত্রিক পৃথিবীতে কালী এক প্রশমন। রেচেল যদিও দেবী কালীর কথাই বলেছেন, আমার কাছে কালী শব্দটি পর্যবসিত হয়েছে একটা চিন্তাধারায়, একটা আইডিয়ায়।
আর একবার ফিরে যাই ঠগী প্রসঙ্গে, আধুনিক গবেষণা দেখাচ্ছে ঠগীরা থাকলেও ঠগীদের ঘিরে যে কাল্ট তৈরী হয়েছিল তার অনেকটাই পাশ্চাত্ত্যে নির্মিত। এই যে রহস্যময়তা, এই যে আন্ডারগ্রাউন্ড নেটওয়ার্ক নিয়ে একটা চরম ফ্যাসিনেশন এর অনেকটাই গড়ে উঠেছে প্রাচ্য দেশ নিয়ে বিশেষ ওয়াকিফহাল না থাকার দরুণ। এই কথাটাকেই হয়ত আরেকটু এগিয়ে নিয়ে গিয়ে বলা যায় ঠগীদের উপাস্য দেবীকে নিয়েও যে রহস্যের জাল বোনা হয়েছে, অ্যাকাডেমিক টেক্সট থেকে কমিকস সবেতে নিয়ে আসা হয়েছে একটা নয়্যার টাচ সেটার পেছনেও আছে ওই ভয়মিশ্রিত কৌতূহল। আসল চিন্তাধারাটিকে না ধরেই অনর্থক রোমাঞ্চিত হয়েছি আমরা, পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নিজের দায়িত্ব এড়িয়ে গিয়ে আয়োজন করেছে শক্তিপূজার। শক্তিপূজা অবশ্য আমার কাছে ম্যাট্রিয়ারকির চরম অবস্থা – কামাখ্যা তন্ত্র, নিরুত্তর তন্ত্র বা মহানির্বাণ তন্ত্র মতে কালী শক্তির আধার কারণ ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং মহেশ্বরের উদ্ভব কালীর শরীর থেকেই। যদিও এক হিসাবে আমার মনে হয় তন্ত্রশাস্ত্রও সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয় – যৌনচেতনার মাধ্যমে নারীমুক্তির কথা বলার জন্য তন্ত্রশাস্ত্রকে আবশ্যিক ভাবে বেছে নিতে হয়েছে সেই ফ্রী স্পিরিটেড কালীকেই। অষ্টাদশ পুরাণের লক্ষ্মী, সরস্বতী বা দুর্গাও যেমন কথাগুলো বলে উঠতে পারেননি, বৃহন্নীল তন্ত্রের তারা কি নীল সরস্বতীও পারেননি কারণ সম্মান বজায় রাখা বড় দায়। শিক্ষা, ধন, কল্যাণ দাত্রী দেবীরা রয়ে গেলেন শুধু মঙ্গলময় প্রতীক হয়েই। কথাগুলো লক্ষ্মী, সরস্বতী বা দুর্গাকে দিয়ে বলালে কি হত সে নিয়ে আমরা স্পেকুলেটই করতে পারি কিন্তু চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছি বাকিরা যেখানে সর্বভারতীয় পূজ্য হয়ে রয়ে গেলেন, কালী মূলত ঠাঁই পেলেন শুধু বাংলায়। আর পুজো না পেলে কোন ঠাকুরেরই বা মান থাকে?
একটা বড় প্রশ্ন থেকে যায় – সব জায়গা ছেড়ে বাংলাই কেন? মনে রাখা ভালো যে এসব পুরাণ যখন লেখা হচ্ছে বাংলাদেশ তখন আক্ষরিক অর্থেই পাণ্ডববর্জিত জায়গা। আদি মহাভারতে বলা হয়েছে অজ্ঞাতবাসে থাকাকালীন বাংলাদেশের মেঘনা নদীর পূর্বদিকে বসতি স্থাপনের উদ্দেশ্যে পান্ডবরা ভীমকে পাঠান। জায়গাটি নাকি এতই নির্জন এবং বিপদসঙ্কুল ছিল যে মহাপরাক্রমী ভীমও তড়িঘড়ি ফিরে আসেন। সুতরাং, উচ্চকোটির মানুষরা যখন কালীকে শ্মশানে ডোমেদের মধ্যে বা জঙ্গলে শবরদের মধ্যে (বাণভট্টের ‘কাদম্বরী’তে কালী শবরদের উপাস্য) পাঠানোর পরিকল্পনা করছেন, তখন বাংলাদেশের নাম উঠে আসাটাই খুব স্বাভাবিক। উচ্চবর্ণের ভাষা অর্থাৎ আর্য ভাষায় যাঁরা কথা বলতেন তাঁদের কেউই তখন এ তল্লাটে পা রাখেননি, পা রাখার কথা ভাবতেও পারেননি। এরকমটা হয়ে থাকতেই পারে যে বাংলাদেশের তখনকার অধিবাসীদের মধ্যে কালী বা কালীপ্রতিম কোনো মূর্তি পূজার চল ছিল, যাকে পশ্চিমী ভাষায় বলা যায় Pagan Ritual। কিন্তু তার থেকেও উল্লেখযোগ্য বিষয় হল সেই Pagan Ritual কেই আর্যভাষী মানুষরা কি ভাবে নিজেদের ধর্মের মধ্যে ঢুকিয়ে নিলেন – প্রথমদিকে কালীকে দুর্গার অল্টার ইগো বলে চালানো হলেও পরে বলা হতে লাগল দুর্গার শরীর থেকেই কালীর উদ্ভব। প্রথমবারের জন্য এ জিনিস দেখা গেল যখন শুম্ভনিশুম্ভ হত্যা কাহিনী বর্ণনের জন্য তৈরী হল ‘দেবী মাহাত্ম্য’। আরো মজার বিষয় হল প্রতিটি যুদ্ধেই দুর্গাকে সহায়তা করার জন্য সমস্ত দেবতারা হাত বাড়িয়ে রেখেছেন,কিন্তু কালী যখনই আবির্ভূত হচ্ছেন তাঁকে সহায়তার জন্য থাকছে মাংসখেকো পিশাচরা! কখন যে বাংলাদেশের ডোম আর শবররা হিন্দু পুরাণে পিশাচ হয়ে ঢুকে পড়লেন তার বিশেষ খেয়াল আমরা রাখিনি। যাকগে, তাতে কিছুই যায় আসে না – দুবেলা খাবার সারা বাংলাদেশের মানুষের কখনই জুটত না, মাংস যদি জোটে তো খাব নাই বা কেন? আর মাংসখেকো বাঙ্গালীদের আরাধ্য দেবী কালীও সর্বদা লকলকে জিভ বার করে রেখে বলবেন “ম্যায় ভুখা হুঁ”, সেটাই স্বাভাবিক। সাধে কি আর বলে “যেমন মা, তেমন ছা”। মা শুনে ভুরূ কুঁচকোবেন না, সবার কথাই হল যখন রামপ্রসাদরাই বা বাদ যান কেন?