কলকাত্তাওয়ালী

Kolkattawali

কালীপুজো গেছে গত সপ্তাহেই, এক বন্ধু জিজ্ঞাসা করলেন কালীর নৃতাত্ত্বিক বা সমাজতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা নিয়ে বাংলায় কোনো বই আছে?  আছে তো নিশ্চয় কিন্তু প্রবাসে ভরসা নিজের সংগ্রহ এবং ইন্টারনেটে ইতিউতি ছড়িয়ে থাকা বইয়ের ওপরেই। কিন্তু সেই সংক্ষিপ্ত পরিসরে কিছুই পাওয়া গেল না; বাধ্য হয়ে বন্ধুকে বললাম আপাতত ওয়েন্ডি ডনিগারের “হিন্দুজ : অ্যান অল্টারনেটিভ হিস্ট্রি” তে চোখ বোলানো যাক,  বাংলা বইয়ের সন্ধান পাওয়া গেলেই জানাবো। যাই হোক, এক সপ্তাহের মধ্যেও কিছু খুঁজে পাওয়া গেল না কিন্তু বিষয়টি নিয়ে আমারও এতই উৎসাহ জাগল যে একটা ব্লগপোস্টের কথাই ভেবে ফেললাম।

কালী কলকাত্তাওয়ালী শব্দগুচ্ছ নেহাত অবান্তর কথা নয়, কালী যে মূলত বাংলার দেবী সে নিয়ে আমাদের সন্দেহের অবকাশ নেই। কালীঘাটের ইতিহাস তো আছেই; আরো ধরুন উইলিয়াম স্লীম্যানের কথা, যিনি কালীউপাসক ঠগীদের সাথে বাকি বিশ্বের পরিচয় করান, ছিলেন বেঙ্গল রেজিমেন্টের অফিসার। বাংলায় থাকাকালীনই শুনেছিলেন রক্তপিপাসু কালীর কথা, ঠগী প্রসঙ্গে জানিয়েছিলেন কালী বাঙ্গালীদেরই আরাধ্য দেবী।  বাংলায় আবার ফিরে আসব কিন্তু কয়েকটা বিষয় তার আগে আলোচনা না করলেই নয়। কালীর কথা কিন্তু আমরা হিন্দু পুরাণে দেখতে পাচ্ছি প্রায় ৬০০ খ্রীষ্টাব্দ থেকেই – অগ্নি পুরাণ এবং গড়ুর পুরাণে কালীর পরিচয় দেওয়া হচ্ছে যুদ্ধের দেবী হিসাবে। শুধু তাই নয়, ইনি প্রেতপৃষ্ঠে ঘুরে বেড়ান এবং শ্মশানে থাকেন; শুধু বাহ্যিক রূপ দেখলেই ভয় হয় না, উন্মত্ত হাসি এবং তান্ডব নৃত্যর কথাও মাথায় রাখতে হবে। ভাগবত পুরাণে আবার বলা হচ্ছে এক দল চোরের আরাধ্য দেবী এই কালী, যাদের সর্দার পুত্রলাভের আশায় এঁর কাছে ধর্না দিয়ে পড়ে থাকেন। ভাগবত পুরাণ পড়েই ঠগীরা উদ্বুদ্ধ হয়েছিল কিনা জানা নেই, তবে শোনা যায় ঠগীরা নিজেদের রক্তবীজ অসুরের বংশধর বলে ভাবতে ভালোবাসত তাই হয়ত  কালীর উপাসনা। প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখি যতই গুরুজনরা বলে থাকুন যে শিবের বুকে উঠে পড়ার জন্য লজ্জায় কালীর জিভ বেরিয়ে গেছিল, আসল কারণ কিন্তু ওই রক্তবীজ। রক্তবীজের এক বিন্দু রক্ত মাটিতে পড়লেই যেহেতু রক্তবীজের ক্লোন এসে উপস্থিত হবে, কালীর জিভ বার করে রাখা ছাড়া উপায় ছিল না। কালীর বুকের নিচে শিবকে পরে ঠেলে পাঠিয়েছেন পুরাণকার রা। তন্ত্রশাস্ত্র অনুযায়ী অবশ্য বুকের ওপর উঠে পড়াটা  বেখেয়াল বা ঝগড়া হেতু নয়,  পুরুষ ও প্রকৃতির মিলনের পূর্বাভাষ।

পুরাণ বলুন বা তন্ত্র, কালী কিন্তু সমস্ত দেবীদের মধ্যে সব থেকে ফ্রী স্পিরিটেড। যদিও পুরাণ অনুযায়ী কালী এই ফ্রী স্পিরিটের মর্যাদা রাখতে পারেন না প্রায়শই – তাই বিশ্বসংসারকে রক্ষা করতে যখন তাঁকে পাঠানো হয়, অধিকাংশ সময়েই শত্রুদের ধ্বংস করার সাথে সাথে শেষ করেন সেই বিশ্বসংসারকেই।  হিন্দু ধর্মের হায়ারার্কি অনুযায়ী কালীর স্থান লক্ষ্মী, সরস্বতী এবং দুর্গার পরে কিন্তু কালীর ক্রোধ খন্ডন করার সাধ্য এনাদের তো নেইই এমনকি হোলি ট্রিনিটিরও নেই। আবার তন্ত্রশাস্ত্র অনুযায়ী কালী হচ্ছেন সেই তিন দেবীর একজন যাঁদের অখন্ড সার্বভৌমত্ব আছে (বাকি দু’জন হলেন নীল সরস্বতী এবং তারা)। বৃহন্নীল তন্ত্র আরো জানাচ্ছে নীল সরস্বতী এবং তারা দুজনেই তরুণী এবং পূর্ণযৌবনপ্রাপ্তা কিন্তু কালী অতটাও নবীনা নন এবং দেখতেও বেশ শীর্ণকায়, তাই বাকি দু’জনের থেকে কিছুটা তফাৎ আছে। আরো একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হল তন্ত্রশাস্ত্র অনুযায়ী নীল সরস্বতী এবং তারা দু’জনকেই মহামায়া বলা হলেও কালীকে সে নামে ডাকা হচ্ছে না (যদিও বৃহন্নীল তন্ত্রে এটাও বলা হচ্ছে যে এই তিন জনকে আলাদা করে দেখার চেষ্টা করলে নরকগামী হতে হবে) – অর্থাৎ কালী আর যাই করুন বেকার বিভ্রম ছড়িয়ে তাবৎ ভক্তকুলকে ঘাবড়ে দেন না।

পুরাণ এবং তন্ত্রশাস্ত্র, দু’দিক থেকেই দেখে একটা কথা আমার বারেবারেই মনে হয় – কালী যেন সাধারণ ঘরের এক স্বাধীনচেতা মেয়ের প্রতীক। রূপ, যৌবন বা বংশমর্যাদা  কোনো কিছু দিয়েই ভোলাতে ইনি চান না, কিন্তু তাই বলে ফ্রী স্পিরিটের কমতি নেই। আর সে স্বাধীনচেতা মেয়ের তেজ এমনই যে সমাজের মাথারাও সেখানে নিজেদের মতামত চাপিয়ে দেওয়ার সুযোগ পান না। স্বভাবতই চরম পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বহু পুরাণকার শেষমেশ কালীকে অসভ্য জাতের উপাস্য দেবী বলে ঠাউরেছেন, দেখিয়েছেন প্রায় জংলী এক মূর্তিকে যাঁকে ঘিরে থেকেছে চোর, ডাকাত আর খুনীরা। তন্ত্রশাস্ত্রের লেখকরা কিন্তু কালীর প্রতি অনেক সদয়, এবং সেখানে কালী নিছক এক হিন্দু দেবী নন, সমগ্র নারী জাতির প্রতীক। ‘কালী সাধনা’য় যৌন মিলন অপরিসীম গুরুত্ব পেয়েছে কিন্তু বারেবারেই বলা হয়েছে নারী পূজক নন, পূজ্য। নারীর দেহের প্রতি সম্মান না থাকলে কালী সাধনা করা সম্ভব নয়। একই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বলা হয়েছে ‘কুমারী পূজা’ করার কথা, যৌন মিলনের বয়স যাদের আসেনি তাদের শরীরেরও যে সম্মান প্রাপ্য সেটা তুলে ধরাই এ পুজোর অন্যতম উদ্দেশ্য। নারীমুক্তিতে যে গোটা সমাজেরই মুক্তি এবং সে মুক্তি সাধনে শরীরের ভূমিকা বোঝাটা যে নিতান্তই জরুরী, এহেন আধুনিক চিন্তাধারা কিন্তু পুরাণে পাবেন না, পাবেন তন্ত্রে। বার্নার্ড কলেজের অধ্যাপক রেচেল ম্যাকডারমটের গবেষণার বিষয় হিন্দু দেবী এবং মূলত কালী – ওপরের কথার সূত্র ধরেই রেচেলও বলছেন পুরুষতান্ত্রিক পৃথিবীতে কালী এক প্রশমন। রেচেল যদিও দেবী কালীর কথাই বলেছেন, আমার কাছে কালী শব্দটি পর্যবসিত হয়েছে একটা চিন্তাধারায়, একটা আইডিয়ায়।

আর একবার ফিরে যাই ঠগী প্রসঙ্গে, আধুনিক গবেষণা দেখাচ্ছে ঠগীরা থাকলেও ঠগীদের ঘিরে যে কাল্ট তৈরী হয়েছিল তার অনেকটাই পাশ্চাত্ত্যে নির্মিত।  এই যে রহস্যময়তা, এই যে আন্ডারগ্রাউন্ড নেটওয়ার্ক নিয়ে একটা চরম ফ্যাসিনেশন এর অনেকটাই গড়ে উঠেছে প্রাচ্য দেশ নিয়ে বিশেষ ওয়াকিফহাল না থাকার দরুণ। এই কথাটাকেই হয়ত আরেকটু এগিয়ে নিয়ে গিয়ে বলা যায় ঠগীদের উপাস্য দেবীকে নিয়েও যে রহস্যের জাল বোনা হয়েছে, অ্যাকাডেমিক টেক্সট থেকে কমিকস সবেতে নিয়ে আসা হয়েছে একটা নয়্যার টাচ সেটার পেছনেও আছে ওই ভয়মিশ্রিত কৌতূহল। আসল চিন্তাধারাটিকে না ধরেই অনর্থক রোমাঞ্চিত হয়েছি আমরা, পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নিজের দায়িত্ব এড়িয়ে গিয়ে আয়োজন করেছে শক্তিপূজার। শক্তিপূজা অবশ্য আমার কাছে ম্যাট্রিয়ারকির চরম অবস্থা – কামাখ্যা তন্ত্র, নিরুত্তর তন্ত্র বা মহানির্বাণ তন্ত্র মতে কালী শক্তির আধার কারণ ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং মহেশ্বরের উদ্ভব কালীর শরীর থেকেই। যদিও এক হিসাবে আমার মনে হয় তন্ত্রশাস্ত্রও সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয় – যৌনচেতনার মাধ্যমে নারীমুক্তির কথা বলার জন্য তন্ত্রশাস্ত্রকে আবশ্যিক ভাবে বেছে নিতে হয়েছে সেই ফ্রী স্পিরিটেড কালীকেই। অষ্টাদশ পুরাণের লক্ষ্মী, সরস্বতী বা দুর্গাও যেমন কথাগুলো বলে উঠতে পারেননি, বৃহন্নীল তন্ত্রের তারা কি নীল সরস্বতীও পারেননি কারণ  সম্মান বজায় রাখা বড় দায়। শিক্ষা, ধন, কল্যাণ দাত্রী দেবীরা রয়ে গেলেন শুধু মঙ্গলময় প্রতীক হয়েই। কথাগুলো লক্ষ্মী, সরস্বতী বা দুর্গাকে দিয়ে বলালে কি হত সে নিয়ে আমরা স্পেকুলেটই করতে পারি কিন্তু চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছি বাকিরা যেখানে সর্বভারতীয় পূজ্য হয়ে রয়ে গেলেন, কালী মূলত ঠাঁই পেলেন শুধু বাংলায়। আর পুজো না পেলে কোন ঠাকুরেরই বা মান থাকে?

একটা বড় প্রশ্ন থেকে যায় – সব জায়গা ছেড়ে বাংলাই কেন? মনে রাখা ভালো যে এসব পুরাণ যখন লেখা হচ্ছে বাংলাদেশ তখন আক্ষরিক অর্থেই পাণ্ডববর্জিত জায়গা। আদি মহাভারতে বলা হয়েছে অজ্ঞাতবাসে থাকাকালীন বাংলাদেশের মেঘনা নদীর পূর্বদিকে  বসতি স্থাপনের উদ্দেশ্যে পান্ডবরা ভীমকে পাঠান। জায়গাটি নাকি এতই নির্জন এবং বিপদসঙ্কুল ছিল যে মহাপরাক্রমী ভীমও তড়িঘড়ি ফিরে আসেন। সুতরাং, উচ্চকোটির মানুষরা যখন কালীকে শ্মশানে ডোমেদের মধ্যে বা জঙ্গলে শবরদের মধ্যে (বাণভট্টের ‘কাদম্বরী’তে কালী শবরদের উপাস্য) পাঠানোর পরিকল্পনা করছেন, তখন বাংলাদেশের নাম উঠে আসাটাই খুব স্বাভাবিক। উচ্চবর্ণের ভাষা অর্থাৎ আর্য ভাষায় যাঁরা কথা বলতেন তাঁদের কেউই তখন এ তল্লাটে পা রাখেননি, পা রাখার কথা ভাবতেও পারেননি। এরকমটা হয়ে থাকতেই পারে যে বাংলাদেশের তখনকার অধিবাসীদের মধ্যে কালী বা কালীপ্রতিম কোনো মূর্তি পূজার চল ছিল, যাকে পশ্চিমী ভাষায় বলা যায় Pagan Ritual। কিন্তু তার থেকেও উল্লেখযোগ্য বিষয় হল সেই Pagan Ritual কেই আর্যভাষী মানুষরা কি ভাবে নিজেদের ধর্মের মধ্যে ঢুকিয়ে নিলেন – প্রথমদিকে কালীকে দুর্গার অল্টার ইগো বলে চালানো হলেও পরে বলা হতে লাগল দুর্গার শরীর থেকেই কালীর উদ্ভব। প্রথমবারের জন্য এ জিনিস দেখা গেল যখন শুম্ভনিশুম্ভ হত্যা কাহিনী বর্ণনের জন্য তৈরী হল ‘দেবী মাহাত্ম্য’। আরো মজার বিষয় হল প্রতিটি যুদ্ধেই দুর্গাকে সহায়তা করার জন্য সমস্ত দেবতারা হাত বাড়িয়ে রেখেছেন,কিন্তু কালী যখনই আবির্ভূত হচ্ছেন তাঁকে সহায়তার জন্য থাকছে মাংসখেকো পিশাচরা! কখন যে বাংলাদেশের ডোম আর শবররা হিন্দু পুরাণে পিশাচ হয়ে ঢুকে পড়লেন তার বিশেষ খেয়াল আমরা রাখিনি। যাকগে, তাতে কিছুই যায় আসে না – দুবেলা খাবার সারা বাংলাদেশের মানুষের কখনই জুটত না, মাংস যদি জোটে তো খাব নাই বা কেন? আর মাংসখেকো বাঙ্গালীদের আরাধ্য দেবী কালীও সর্বদা লকলকে জিভ বার করে রেখে বলবেন “ম্যায় ভুখা হুঁ”, সেটাই স্বাভাবিক। সাধে কি আর বলে “যেমন মা, তেমন ছা”। মা শুনে ভুরূ কুঁচকোবেন না, সবার কথাই হল যখন রামপ্রসাদরাই বা বাদ যান কেন?

নীরস বিজ্ঞান

আর এক  ঘন্টার মধ্যে এ বছর অর্থনীতিতে নোবেল কারা পেলেন সেটা জানা যাবে, অর্থনীতির ছাত্র হওয়ার সুবাদে প্রতি বছরের মতনই এবারেও আগ্রহের সঙ্গে অপেক্ষা করছি খবরটার জন্য। সম্ভাব্য পুরস্কার প্রাপকদের মধ্যে উঠে এসেছে উইলিয়াম বমলের নাম, যাঁর বয়স এখন ৯২, একজন অন্ত্রপ্রেনিওর হিসাবে আপনার নেওয়া সমস্ত সিদ্ধান্তের পেছনেই যে যুক্তিগ্রাহ্য অর্থনৈতিক ব্যাখ্যা থাকা দরকার সেটা প্রমাণ করতে আজ থেকে চল্লিশ পঁয়তাল্লিশ বছর আগেই ইনি উঠেপড়ে লেগেছিলেন। আজকে বিশ্ব জুড়ে যখন স্টার্ট-আপ কোম্পানিগুলোর রমরমা দেখছেন, ফেসবুক থেকে শুরু করে হোয়াটসঅ্যাপ প্রতিটি সফল অন্ত্রপ্রেনিওরাল ভেঞ্চার দেখে অসংখ্য তরুণ-তরুণী উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন তখন বমলের কাজ যেন আরো যুগধর্মী হয়ে উঠেছে। নাম উঠে এসেছে দুই ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদের – অ্যান্থনি অ্যাটকিন্সন এবং অ্যাঙ্গাস ডিটনের (অ্যাঙ্গাস যদিও বহু বছর ধরেই প্রিন্সটনে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক), এনারা পেলে সেই ১৯৯৮ সালের পর আবার কোনো  ডেভলপমেন্ট ইকোনমিস্ট নোবেল পাবেন; বলা বাহুল্য যে সে বছর অমর্ত্য সেন নোবেল পেয়েছিলেন। অমর্ত্যর কাজের তুলনায় অ্যাটকিন্সন এবং ডিটনের কাজ অবশ্য অনেক বেশী ডেটা-নির্ভর, অর্থনৈতিক বৈষম্য নিয়ে দুজনের কাজই যুগান্তকারী। বহু বছর ধরেই ঘোরাফেরা করছে আরেক বাঙ্গালী পার্থ দাশগুপ্তর নাম (যদিও ইনি ব্রিটিশ নাগরিক), প্রথমবার ‘পরিবেশ অর্থনীতি’ পড়তে গিয়ে দেখেছিলাম থিয়োরেটিক্যাল ফ্রেমওয়ার্কের অনেকটাই এনার তৈরি করা – যদি নোবেল পান তো সেই সুবাদেই পাবেন। উঠে এসেছে ফ্রেঞ্চ অর্থনীতিবিদ জঁ টিরোলের নাম, মাইক্রোইকোনমিক ফাউন্ডেশনের সাহায্যে কর্পোরেট ফাইন্যান্সের তাত্ত্বিক বুনিয়াদ গঠন করার জন্য ইনিও পেতে পারেন নোবেল। টিরোল অবশ্য গেম থিয়োরিস্ট-ও, সেই সুবাদে বাকিদের থেকে ওনার কাজ অনেক বেশী পড়ার সুযোগ ঘটেছে আমার – বয়সে অপেক্ষাকৃত তরুণ এই অর্থনীতিবিদের এ বছর নোবেল পাওয়ার চান্স একটু কম কিন্তু কোনো একদিন যে পাবেন সে নিয়ে মোটামুটি সবাই একমত।

ইকোনমিক্সকে সাধারণ মানুষ  নীরস বিজ্ঞান (ডিসম্যাল সায়েন্স) বলে জানেন, ২০০৮ এ বিশ্বজোড়া অর্থনৈতিক ধ্বস দেখার পর অনেকে একে বিজ্ঞান বলতেও রাজি নন অবশ্য, কিন্তু আজকে বরং অর্থনীতির নোবেল নিয়ে কিছু মজার ঘটনা শোনাই আপনাদের।

৯৫ সালে নোবেল পেয়েছিলেন শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের রবার্ট লুকাস, অর্থনীতির ছাত্রছাত্রী মাত্রেই জানেন ইকোনমিক গ্রোথ নিয়ে গবেষণায় লুকাস প্রায় প্রবাদপুরুষ। নোবেল পাওয়ার পর অবশ্য লুকাসের থেকেও বেশী আহ্লাদিত হয়েছিলেন লুকাসের ভূতপূর্ব স্ত্রী। ডিভোর্স নিলেও লুকাসের কাজের ওপর গভীর আস্থা ছিল তাঁর, তাই ডিভোর্সের একটি শর্ত ছিল লুকাস কোনোদিন নোবেল পেলে মোট টাকার অর্ধেক ইনি পাবেন। আরো মজার ব্যাপার লুকাস সেই বছরে নোবেল না পেলে শর্তটি আর খাটত না। যাই হোক, লুকাসকে গুনে দিতে হয় হাফ মিলিয়ন ডলার; “আ ডিল ইজ আ ডিল” বললেও লুকাস পরে বলেছিলেন “আমার নোবেল পাওয়া নিয়ে আমার নিজের অতটা আস্থা থাকলে যেন তেন প্রকারে ওই শর্তটা রদ করতাম”। বুঝতেই পারছেন, বৌদের কথা শোনাটা কত জরুরী, ডিভোর্সের পরেও।

সোশ্যাল সায়েন্স নিয়ে যাঁরা কাজ করেন তাদের মধ্যে অর্থনীতিবিদদের ‘ফিজিক্স এনভি’ দেখবার মতন, অর্থাৎ ফিজিক্সের মডেল বা যে কোনো হার্ডকোর গাণিতিক মডেল দিয়ে অর্থনৈতিক তত্ত্ব বিশ্লেষনের অভ্যাস এনাদের বহুদিনের, সে নিয়ে অবশ্য কম সমালোচনা-ও হয় না। পদার্থবিদ বা গণিতবিদদের কাছে অবশ্য সে সবই বেশ বালখিল্য কাজ।  হার্ভার্ডের গবেষক  ভ্যাসিলি লিওনটিয়েফ পুরস্কার পেয়েছিলেন ৭৩-এ, নোবেল ডিনারে সে বছরের ফিজিক্স নোবেল লরিয়েট শুধোলেন “কি নিয়ে আপনার কাজ?” লিওনটিয়েফ জানালেন তিনি তৈরি করেছেন ইনপুট-আউটপুট মডেল যা দিয়ে বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রির মধ্যে অর্থনৈতিক আদানপ্রদানের পদ্ধতি জলের মতন বোঝা যাবে। মুশকিল হল সেটার টেকনিক্যাল দিকটুকু বোঝাতে গিয়ে; শুনে টুনে ফিজিক্স লরিয়েট পাশেই বসে থাকা কেমিস্ট্রি লরিয়েট কে ফিসফিস করে বললেন, “কান্ড দেখেছ? একটা ম্যাট্রিক্সের ইনভার্স বার করার জন্য  কমিটি এনাকে নোবেল দিয়ে দিয়েছে”।

অঙ্কটা যাঁরা অর্থনীতিবিদদের থেকেও ভালো বোঝেন সমস্যা শুধু তাঁদের সঙ্গে আলাপচারিতাতেই নয়, সাধারণ মানুষদের ‘লেম্যান টার্মস’-এ গবেষনার কাজ বোঝাতে গিয়েও মাঝে মধ্যেই হাঁড়ির হাল হয় অর্থনীতিবিদদের। ৮১ সালে নোবেল পেয়েছিলেন ইয়েলের জেমস টবিন, তাঁর কাজ পোর্টফোলিও থিয়োরী নিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয় আয়োজিত সাংবাদিক বৈঠকে তিনি যতই প্রাঞ্জল করে তাঁর কাজ বোঝানোর চেষ্টা করেন, সাংবাদিকরা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারেন না। শেষমেশ টবিন বললেন, “এক লাইনে যদি আমার কাজ বলতে বলেন তাহলে হয়ত বলব – don’t put all your eggs in one basket”। সাংবাদিকরা ভারী খুশী হয়ে চলে গেলেন, ফল হল এই যে পরের দিন স্থানীয় কাগজে লেখা  হল পরের বছর “An apple a day, keeps the doctor away” বলার জন্য চিকিৎসাবিদ্যায় নোবেল দেওয়া হবে।

তবে সব থেকে খারাপ অবস্থা হয়েছিল ৯৭ সালের পুরস্কার প্রাপক রবার্ট মার্টন এবং মায়রন শোলসের – ফাইন্যান্সের যে তত্ত্বের উদ্ভাবনের জন্য তাঁরা নোবেল পেলেন, সেই তত্ত্ব খাটাতে গিয়েই এক বছরের মধ্যে উঠে গেল তখনকার দিনের নামজাদা হেজ ফান্ড, লং টার্ম ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট। মার্টন এবং  শোলস দুজনেই বহু বছর ধরে বোঝানোর চেষ্টা করে এসেছেন এটা তাঁদের তত্ত্বের দোষ নয় কিন্তু ভবি কি আর ভোলে? দুজনের প্রাণান্তকর চেষ্টা জনমতে বিশেষ ছাপ ফেলতে পারেনি আরো একটা কারণে – দুজনেই ছিলেন লং টার্ম ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্টর কন্সাল্ট্যান্ট রিসার্চার, অফিসিয়াল পদমর্যাদার হিসাবেও যা প্রায় ডিরেক্টরের সমতুল্য।

দেখা যাক ২০১৪ এরকমই কোনো নাটক নিয়ে আসে কিনা।

Nobel_Prize

বন্ধ ঘরের রহস্য

ঘরের মধ্যেই খুনটা ঘটেছে – মৃতদেহ এখনো মেঝেতে পড়ে কিন্তু পুলিশের গোয়েন্দারা কিংকর্তব্যবিমূঢ়, আর ঠিক ততোটাই হতবাক অবস্থায় দাঁড়িয়ে বাড়ির পরিচারক। গুলির শব্দ শুনে সে-ই প্রথম দৌড়ে এসে দরজা ভেঙ্গে ঢুকেছিল, কিন্তু ঘরের মধ্যে কর্তার মৃতদেহটি ছাড়া আর কাউকে দেখতে পায়নি। গোয়েন্দারাও এসে তন্ন তন্ন করে খুঁজেছেন, কিন্তু খুনী যেন ভোজবাজির মতন উধাও হয়ে গেছে ঘর থেকে – দরজা বাইরে থেকেই বন্ধ ছিল, জানলাও খোলা নেই, তন্ন তন্ন করে খুঁজে চোরাকুঠুরি ধরণেরও কিছু পাওয়া যায় নি। এদিকে পরিচারক দিব্যি গেলে বলছে যে কর্তার সঙ্গেই ঘরের মধ্যে ঢুকেছিল এক দর্শনার্থী।

Locked Room

‘লকড রুম মিস্ট্রি’ নিয়ে পাঠকের কৌতূহল বহুকালের, আর কৌতূহলটা শুধুই খুনী কে সেটা জানার জন্য নয় – খুনটা কেমন করে হল সেটাই এ ধরণের রহস্য-সাহিত্যে তুরুপের তাস।  উৎসাহী পাঠকেরা অবশ্য আরো একটু এগিয়ে ভাবতে বসেন লেখক কিভাবে গড়ে তুললেন রহস্যের এই ঊর্ণজাল, ব্যাকওয়ার্ড  ইন্ডাকশনে শেষ থেকে শুরু করেছেন নাকি রহস্যবিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে নিজেই ডিটেকটিভ সেজে বার করে ফেলেছেন সমাধানের রাস্তা? রহস্য গল্পনির্মাণে  লেখকের মুন্সিয়ানা এমনিতেই জরুরী, আর লকড রুম মিস্ট্রি হলে তো কথাই নেই – সামান্য লজিক্যাল বিচ্যুতিতে পাঠকেরা হইহই করে উঠবেন। কখনো সখনো খেই হারিয়ে লকড রুম মিস্ট্রির লেখকেরা হাস্যকর সব পন্থা বেছে নিয়েছেন বটে, ভিকটিম হাসতে হাসতে হার্টফেল করে মারা গেছেন কিংবা ঘরের ফার্নিচারের মধ্যে লুকিয়ে থেকেছে বামন আততায়ী। কিন্তু এগুলো ধরবেন না, টেকনিক্যালিটিজ নিয়ে মাথা ঘামালে হয়ত লকড রুম মিস্ট্রি বলাও যাবে না এ ধরণের অসফল গল্পগুলিকে। কিন্তু  লকড রুম মিস্ট্রির হল অফ ফেমে রয়ে যাওয়া গল্পগুলি পড়লে আপনি লেখকদের মুন্সিয়ানাকে তারিফ না জানিয়ে পারবেন না, লজিক্যাল ট্যুইস্টের চূড়ান্ত পর্যায়ে চোখ গোল গোল করে ভাববেন “এতও মাথায় আসে”!

এরকমই এক লেখক জন ডিক্সন কার, যিনি কার্টার ডিক্সন ছদ্মনামে লিখতেন। জন ডিক্সনের লেখা ‘দ্য হলো ম্যান’ সম্ভবত সব থেকে বেশী চর্চিত লকড রুম মিস্ট্রি। আজকের পোস্ট ব্যক্তি জন ডিক্সনকে নিয়ে নয়, সে সম্পর্কে বিশদ জানতে চাইলে উইকি দেখে নিতে পারেন।  আজকের আলোচনা বরং জনের লেখা বেশ কয়েকটি লকড রুম মিস্ট্রি নিয়ে, যেখানে খুনের গতিপ্রকৃতি দেখলে মনে হওয়া স্বাভাবিক যে আপনি রহস্য গল্প নয়, ভুতুড়ে গল্প পড়ছেন।  এখানে স্পয়লার অ্যালার্ট দিয়ে রাখি, যদিও আমি গল্পগুলোর নাম নিচ্ছি না (জানতে চাইলে কমেন্ট সেকশনে একটা মেসেজ রেখে দেবেন) কিন্তু বন্ধ ঘরের মধ্যে আততায়ী কি ভাবে এসেছে সে নিয়ে কিছু কথা থাকছে।

John Dickson

 

ইংল্যান্ডের সমারসেটে একটি গ্রামে এক তরুণী হঠাৎ বেনামী চিঠি পেতে শুরু করলেন। ঠিক বেনামী অবশ্য নয়, চিঠির লেখক বা লেখিকা নিজেকে দাবী করেন বহুদিন আগে মারা যাওয়া এক বিধবা যাঁর ছবি বহুদিন ধরে ওই গ্রামের ছেলেমেয়ের মনে ভয় জাগিয়ে এসেছে।  অবিবাহিতা এই তরুণীকে যৌন ব্যাভিচা্রে লিপ্ত থাকার দুর্নাম দিয়ে ভয় দেখানো হয় এই অশরীরী আত্মা শীঘ্রই তাঁকে দর্শন দেবে। হয়ত অনুমান করতে পারছেন যে তরুণীটি সত্যিই একদিন মাঝরাতে ঘুম থেকে উঠে নিজের ঘরে সেই মহিলাকে দেখতে পান, বীভৎসদর্শন সেই অশরীরীকে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভয়ে তরুণীটি প্রায় উন্মাদ হয়ে যান। যতবার আতঙ্কে চেঁচিয়ে উঠতে গেছেন, সেই মুখটিও ব্যঙ্গ করে চেঁচিয়ে উঠেছে, যতবার হাত বাড়িয়েছেন মুখটিকে দূরে সরিয়ে দিতে ততবারই সেই মুখের অধিকারিণীও হাত বাড়িয়ে ধরতে এসেছেন তরুণীকে। কার মুখ? অশরীরী আত্মা না হলে ঘরে ঢুকলই বা কি করে?

অতিথিরা জড়ো হয়েছেন একটা অন্য ধরণের সন্ধ্যা কাটানোর অভিপ্রায়ে – গৃহস্বামী এক হিপনোটিস্টকে ভাড়া করেছেন তাঁদের মনোরঞ্জনের উদ্দেশ্যে। সম্মোহিত হলেন আর কেউ নয়, গৃহস্বামীর স্ত্রী। সমস্ত অতিথির সামনেই তাঁকে বলা হল গৃহস্বামীর দিকে পিস্তল থেকে গুলি ছুঁড়তে, অতিথিরা সবাই যদিও জানেন যে পিস্তলে একটাও আসল গুলি নেই।  ভদ্রমহিলা সম্মোহিত অবস্থাতেও অবশ্য পিছিয়ে এলেন। দ্বিতীয়বার তাঁকে বলা হল টেবলের ওপর রাখা একটা ছোরা গৃহস্বামীর বুকে বসিয়ে দিতে, এবারেও প্রত্যেক অতিথিই দেখে নিয়েছেন যে ছোরাটি রাবারের তৈরি। মহিলা এবারে সম্মত হলেন, কিন্তু ছোরাটি সজোরে বিদ্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেখা গেল কোন মন্ত্রবলে যেন রাবারের ছোরাটি হয়ে গেছে আসল। চোখের সামনে এই বীভৎস হত্যাকান্ড দেখে অতিথিরা স্তম্ভিত কিন্তু তাঁরা বুঝতে পারছেন না সবার চোখের সামনে থেকে রাবারের ছোরাটি বদলানো হল কি ভাবে?

তৃতীয় গল্পটি শুরু হচ্ছে যখন ছোট্ট একটি ইংলিশ গ্রামে এক তরুণ তাঁর বাগদত্তাকে নিয়ে ক্রিকেট খেলা দেখতে যান, ফেরার পথে বাগদত্তার ইচ্ছেতে তাঁরা নামেন এক এক জ্যোতিষীর আস্তানায়, এই জ্যোতিষী আবার পেশায় ক্রাইম এক্সপার্ট। এই জ্যোতিষীর কাছেই তরুণটি জানতে পারেন তাঁর বাগদত্তা এর আগে তিনজন স্বামীকে হত্যা করেছেন, প্রত্যেকবারেই মনে হয়েছে নিহতরা যেন আত্মহত্যা করেছেন – অথচ কি উপায়ে যে তাঁদের শরীরে বিষাক্ত হাইড্রোসায়ানিক অ্যাসিড ঢোকানো হয়েছে তা জানার উপায় নেই। সেই রাতেই রহস্যজনক ভাবে জ্যোতিষীটি মারা যান, চতুর্দিক থেকে বন্ধ ঘরে আরো একবার অদৃশ্য আততায়ী এসে ইঞ্জেক্ট করে যায় হাইড্রোসায়ানিক অ্যাসিড। তদন্তের সময় উপরন্তু দেখা যায় মৃত্যুর বেশ কিছু আগে ওই ঘরেই কেউ রাইফেলের গুলি ছুঁড়েছে । কেন ছোঁড়া হল এই গুলি?  প্রথমে কি তাহলে গুলি করে মারারই প্ল্যান ছিল খুনীর?

পরের গল্পটির পটভূমিকা আক্ষরিক অর্থেই প্রায় ভৌতিক। এক ভদ্রলোক একটি বহু পুরনো বাড়ি কিনে তাঁর বন্ধুদের ডেকেছেন একটি উইকএন্ড কাটিয়ে যাওয়ার জন্য – বাড়িটির ইতিহাস অবশ্য দুর্বলহৃদয় মানুষদের জন্য মোটেই স্বস্তিদায়ক নয়। বহু আগে এক বাটলার ওই বাড়ির বিশাল ঝাড়লন্ঠন চাপা পড়ে মারা যান; আরো  শোনা যায় বাড়ির ভূতপূর্ব বাসিন্দাদের সঙ্গে ঘটেছে বেশ কিছু অত্যাশ্চর্য ঘটনা, যেমন নাকি দেওয়ালের সামনে রাখা চেয়ার আপনাআপনিই এগিয়ে এসেছে। অতিথিরা বাড়িতে আসার পর থেকেই ঘটতে থাকে একাধিক অত্যাশ্চর্য ঘটনা – এক মহিলা দাবী করেন কেউ বা কিছু সোফার তলা থেকে তাঁর গোড়ালি চেপে ধরেছে, ঝাড়বাতি দুলতে শুরু করেছে নিজে থেকে, বন্ধ দেওয়ালঘড়ির পেন্ডুলাম হঠাৎ চলতে শুরু করেছে। কিন্তু নিছক ভয় পর্যবসিত হয় গভীর আতঙ্কে যখন তিনজন প্রত্যক্ষদর্শীর সামনে দেওয়াল থেকে ঝুলতে থাকা একটি বন্দুক এগিয়ে এসে গুলি করে মারে চতুর্থ  এক অতিথিকে। ঘটনাবলীর পরিপ্রেক্ষিতে অতিথিরা প্রায় বিশ্বাস করতে শুরু করেন বাড়িটির সঙ্গে জড়িয়ে থাকা উইচক্র্যাফটের ইতিহাসকে।

শেষ যে গল্পটির কথা বলতে চাই সেখানে আবার জড়িয়ে প্রাচীন মিশরীয় অভিশাপ। পিরামিড খুঁড়তে গিয়ে বাবা এবং মেয়ে খুঁজে পান ব্রোঞ্জের তৈরি  একটি আশ্চর্য সুন্দর  ল্যাম্প। স্থানীয় অধিবাসীদের কথা না শুনেই মেয়ে ল্যাম্পটি নিয়ে ফিরে আসেন ইংল্যান্ডে নিজের বাড়িতে। তিনি বাড়িতে ঢোকার তিন মিনিটের মধ্যে মেয়ের বন্ধুরাও পেছন পেছন ঢোকেন এবং স্তম্ভিত হয়ে লক্ষ্য করেন বিশাল হলঘরের মধ্যে ব্রোঞ্জের ল্যাম্পটি রয়েছে, রয়েছে তাঁদের বন্ধুর ছেড়ে যাওয়া ওভারকোট কিন্তু স্বয়ং বন্ধু যেন হাওয়ায় মিশে গেছেন। কোথায় গেলেন তিনি? ব্রোঞ্জের ল্যাম্পের সঙ্গে কি আদৌ কোনো যোগাযোগ আছে এই নিরুদ্দেশ রহস্যের? রহস্য আরো ঘনীভূত হয় যখন মেয়ের সঙ্গেই নিরুদ্দেশ হয়ে যান বাবা-ও, একই ভাবে।

লকড রুম মিস্ট্রির সমাধানকে মোটামুটি ভাবে কুড়ি রকম ভাগে ভাগ করা যায়, এ নিয়ে বিশদ আলোচনা আছে রবার্ট অ্যাডের বই “লকড রুম মার্ডারস”-এ। একটি অন্যতম কায়দা হল যন্ত্রের ব্যবহার – যে কায়দায় দ্বিতীয় গল্পে আততায়ী রাবারের ছোরা বদলে রেখে দিয়েছিল সত্যিকারের ধাতব ছোরা। সম্মোহিত ভদ্রমহিলাকে যখন হিপনোটিস্ট “ওয়ন, টু, থ্রী…ফায়ার” বলে আদেশ দিচ্ছেন তখন ঘরে উপস্থিত সবাই একাগ্রচিত্তে সেদিকেই তাকিয়ে। আততায়ীও সে মুহূর্তে ঘরে  উপস্থিত,  lazy tongs নামের একটি বিশেষ ধরণের চিমটের সাহায্যে মাত্র দশ সেকন্ডে টেবলের ওপর রাখা নকল ছোরাকে সরিয়ে নিয়ে বসিয়ে দেয় আসল ছোরা। এখানে অবশ্য মেন কালপ্রিট হচ্ছে আমাদের সিলেকটিভ অ্যাটেনশন। বিশ্বাস না হলে এই ইউটিউব ভিডিওটি দেখতে পারেন, সাইকোলজির প্রফেসরদের খুব পছন্দের একটি এক্সপেরিমেন্ট।

যন্ত্রের ব্যবহার রয়েছে আরো একটি গল্পে – চার নম্বর। হয়ত অনেকেই অনুমান করে থাকবেন যে বাড়িটি আদপেই হন্টেড হাউস নয়, বরং ট্রিক হাউস। যে সমস্ত জিনিসকে নিজে নিজেই কাজ করতে দেখা গেছে তার সবকটাই ধাতুর তৈরি। অর্থাৎ, ভুত নয়, স্রেফ ইলেকট্রোম্যাগনেট ব্যবহার করে নড়ানো হয়েছে ঘড়ির পেন্ডুলাম, ঝাড়বাতি, স্টীলের চেয়ার এবং সব শেষে বন্দুক।

লকড রুম মিস্ট্রিতে আবার অনেক সময়েই আমরা দেখি ‘লকড’ ব্যাপারটা নেহাতই একটা পারসেপশন, মানুষের ধারণা ঘরটি বন্ধ কিন্তু টেকনিক্যালি হয়ত তা নয় – এখন একে জামাই ঠকানো গপ্পোও বলতে পারেন অথবা মেনে নিতে পারেন যে এই আপাত-বিভ্রান্তিও রহস্যেরই অংশ। তিন নম্বর গল্পে কি ঘটেছে দেখুন – দরজা বন্ধ, চার দিকে দেওয়াল, কিন্তু সেই এক দেওয়ালে রয়েছে একটি জানলা। ওই যে খুনী গুলি ছুঁড়েছে, সেটি কিন্তু জ্যোতিষীকে মারার জন্য নয় – জানলায় একটা ফুটো করার জন্য। ফুটো হয়ে গেলে জানলার ভেতর দিকের হাতলে ভারী সুতো জড়িয়ে খুলে ফেলা কয়েক সেকন্ডের ব্যাপার। আর ভিকটিমকে যদি আগে থেকেই ঘুমের ওষুধ খাইয়ে রাখা হয় তাহলে তো বলা বাহুল্য যে হাইড্রোসায়ানিক অ্যাসিড শরীরের ঢুকছে সে বোঝার  কোনো অবকাশই থাকবে না।

প্রথম গল্পে যে ভাবে তরুণীটিকে প্রায় উন্মাদ করে তোলা হয়েছিল সেই কায়দাটি অবশ্য এই কুড়ি ধরণের সলিউশনের মধ্যেও পাবেন না। এখানে তরুণী নিজেই নিজের আততায়ী! একটু ভেঙ্গে বলা যাক। এ ক্ষেত্রে ঘরটি বন্ধ করা হয়েছিল বাইরে থেকে, ভেতর থেকে নয় – অবশ্য সে সময়ে একাধিক লোক ছিলেন ঘরের বাইরে। কিন্তু শেষ যে ব্যক্তি ঘরের মধ্যে ঢুকেছিলেন তিনি ঘুমন্ত তরুণীর মুখে জলরঙ দিয়ে এঁকে এসেছিলেন সেই প্রাচীনা বিধবার মুখ। মাঝরাত্রে বাইরে থেকে আসা জোরালো শব্দে তরুণীর ঘুম ভেঙ্গে গেলে পূর্ণচন্দ্রের আলোয় সামনের আয়নায় নিজের মুখই দেখেছেন তিনি, কিন্তু অবচেতনে জমে থাকা ভয়  তাঁকে বুঝিয়েছে এ সেই অশরীরী আত্মা যে বহুদিন ধরেই জানিয়ে আসছে এক বিশেষ দিনে সে দেখা দেবে।

পাঁচ নম্বর গল্পটির সমাধান কি হতে পারে একটু ভাবুন, শুধু মনে রাখবেন seeing is not always believing! আপনিই যখন ডিটেকটিভ তখন এটাও মাথায় রাখতে হবে ভিকটিম যে কে সেটাই এখানে স্পষ্ট নয়।

গল্পগুলো অবশ্য এর পরেও পড়বেন কারণ রহস্য উপন্যাসের মোটিভ অপরাধ পদ্ধতির থেকেও বেশী ইন্টারেস্টিং হতে পারে, লকড রুম মিস্ট্রি বা ইম্পসিবল মার্ডার তার ব্যতিক্রম নয়। আর যদি শুধুমাত্র অপরাধ পদ্ধতি নিয়েই আপনি উৎসাহিত হন তাহলেও অসুবিধা  নেই, একা জন ডিক্সনই লিখে গেছেন শতাধিক লকড রুম মিস্ট্রি।

 

 

মস্ত অসুরের গল্প

গত সপ্তাহে মহিষাসুর বিদায় নিয়েছেন কিন্তু এ উপলক্ষে একটু দেখে নিচ্ছিলাম অসুর সমাজের সেলিব্রিটি কারা – বৃত্রাসুর, বকাসুর  থেকে শুরু করে রুক্মাসুর, দুর্গাসুর হয়ে এমনকি ঘ্যাঁঘাসুরকেও মনে পড়ল।  আর তারপরেই মনে পড়ে গেল সেই মস্ত অসুরকে।

এই মস্ত অসুর কে সে কথা বলার আগে একটু খেজুরে কথার দরকার। ভাবুন আপনাদের পাড়ায় দুই পান্ডা, দুজনেরই বিশাল দলবল আছে এবং দু’দলের মধ্যে সদাই ঘোরতর কনফ্রন্টেশন। প্রায় ওয়েস্ট সাইড স্টোরির সেটিং, তবে একটু আলাদা – এখানে আপনার নিউট্রাল হয়ে থেকে মজা দেখার উপায় নেই। কোনো একটা সাইড নিতেই হবে – এবার কার দিকে যাবেন সেটা আপনার ইডিওলজির ওপর নির্ভর করতে পারে, আবার হয়ত কোনো এক পান্ডার দিকে আপনার ছোটকা কি আপনার প্রেয়সীর বড়দা কেউ না কেউ অলরেডি ঝুঁকে আছেন, আপনিও সেই বুঝে দল ভারী করলেন। এবার হল কি দল ভারী করতে করতে পান্ডা নম্বর দুই এবং তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গোদের ওপর বেজায় ক্ষেপে গেলেন, পান্ডা নম্বর ওয়ান এবং তাঁর ডেপুটিদের ভাষণ শুনে শুনে আপনার বদ্ধমূল ধারণা যে পান্ডা নম্বর দুই এবং তাঁর অপোগন্ড শাগরেদরা পৃথিবীর বোঝা বাড়ানো ছাড়া জীবনে কিছুই করে উঠতে পারেননি।  এই পর্যন্ত ঠিক ছিল কিন্তু মুশকিল হল আপনার জিগরি দোস্ত, যে আবার কিনা আপনার নেমসেক-ও তার সঙ্গে দেখা হয়ে যাওয়ায়। শুনলেন যে তিনি ভিড়েছেন পান্ডা নম্বর দুইয়ের দলে, এবং ঠিক আপনার মতনই তাঁরও একটা জোরদার বিশ্বাস আছে – পান্ডা নম্বর ওয়ান এবং তাঁর দলবল যে দেশ এবং দশের পক্ষে নেহাতই অশুভ এক শক্তি সে ব্যাপারে তাঁর কোনো সন্দেহই নেই। আপনি পড়লেন ফাঁপরে; স্কুলের ব্যাকবেঞ্চ থেকে খালাসীটোলার কাঠের বেঞ্চ, প্রদীপ সিনেমাহলের জলে ডোবা মেঝে থেকে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের ইন্টারভিউ রুম – পাপ, পুণ্য যাই করেছেন একসঙ্গে করেছেন এবং তার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ হল বদ ফন্দী, ভালো ফিকির যাই ভেঁজেছেন দুজনে মিলেই ভেঁজেছেন। সুতরাং, আপনার বিশ্বাসই ঠিক বিশ্বাস কিনা সে নিয়ে একটু সন্দেহ জাগল, কিন্তু ইডিওলজি বা প্রেম বড় বালাই। বন্ধুত্বের মায়া কাটিয়ে আপনি দুই নম্বরের গুষ্টি উদ্ধারে ফের লেগে পড়লেন।

একেবারে হাইপথেটিক্যাল সিচুয়েশন নিশ্চয় নয়, আপনি না পড়লেও আপনার চেনাশোনা অনেকেই হয়ত এরকম বিভ্রাটে পড়েছেন – ফুটবল টিম থেকে রাজনৈতিক দল, ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে কর্পোরেট রাইভ্যালরি বহু ক্ষেত্রেই এরকমটি হয়ে এসেছে। কিন্তু আপনিই যে ঠিক আর বাকিরা ভুল, এরকম কনভিকশনের জায়গা কোথায়? জেদাজেদির ব্যাপারটা বাদ দিলে বুকে হাত রেখে কি বলা যায় এক পক্ষ একশ শতাংশ ঠিক, আর এক পক্ষ একশ শতাংশ ভুল? এক দল একশ শতাংশ সৎ, আর অন্য টীমের গোটাটাই অসৎ? এক দল শুধুই প্রতিনিধিত্ব করে শুভশক্তির আর অন্য পার্টির সদস্যরা সব শয়তানের চেলা?

এবার কষ্ট করে আরেকটু ভাবুন যে – কিছু হাজার বছর আগে ঠিক এমনটিই ঘটেছিল, দু দলের নাম যথাক্রমে দেব আর অসুর। রাগারাগি থেকে মারামারি, মারামারি থেকে কাটাকাটি হতে হতে দু দলেরই শক্তিক্ষয় হতে লাগল; শেষে নিজেদেরকে টিঁকিয়ে রাখার তাগিদে দু দল চলে গেলে দুই বহু দূর দেশে। যে দেশে দেবরা গেল সেখানে বংশানুক্রমে লোকে জেনে এল যে দেব মানে শুভ আর অসুর মানে অশুভ আর উল্টোদিকে অসুরদের দেশে ছেলেপুলেরা শিখতে লাগল ঠিক উল্টোটা।

আদৌ কি এরকম হয়ে থাকতে পারে?

বিংশ শতকের শুরুতেও ইতিহাসবিদ এবং নৃতাত্ত্বিকরা বিশ্বাস করতেন আফগানিস্থান এবং উত্তর পারস্যের মাঝামাঝি কোনো অঞ্চল থেকে তথাকথিত সভ্য  আর্যদের ভারতে আগমন ঘটে। এদেরই আর এক দল ইরানেই থেকে যায়, আর যে ধর্মবিশ্বাসে এনারা নিজেদের জড়িয়ে ফেলেন তারই সামান্য পরিবর্তিত সংস্করণটি হল জরোস্ত্রিয়ানবাদ। এখানে আরেকটা ছোট কথা বলা যায় – ভারতের পার্সীরাও কিন্তু অগ্নি উপাসক এই ইরানিদেরই উত্তরপুরুষ, তার মানে দেশান্তরী হওয়ার প্রক্রিয়াটি একবার ঘটেই থেমে যায়নি কারণ পার্সীদের অনেক আগেই আর্যরা এসে হাজির।  বিশের দশকে হরপ্পা, মহেঞ্জোদারো প্রভৃতির সন্ধান পাওয়া যাওয়ার পর অবশ্য বহু গবেষকই বলতে থাকেন সভ্য আর্যরা অসভ্য অনার্যদের দেশে আসার বদলে উল্টোটাই ঘটেছে, অনুন্নত আর্যজাতি আক্রমণ করে দখল করেছে তুলনামূলক ভাবে উন্নত অনার্যদের দেশ – তাই migration এর বদলে শুরু হয় invasion শব্দটির ব্যবহার। Migration শব্দটি ফের ফিরে আসে যখন বেশ কিছু ইতিহাসবিদ বলতে শুরু করেন হরপ্পাতে কোনো ধ্বংসাত্মক কাজ বা বিদেশী আক্রমণের চিহ্নটুকু পাওয়া যায় নি। এর প্রায় সঙ্গে সঙ্গে হিন্দু জাতীয়তাবাদীরাও বলতে থাকেন আক্রমণের চিহ্ন না পাওয়ার অর্থ ভারতে কোনোকালেই বিদেশী ঢোকেনি,  আর্যরা এ দেশেরই লোক। ২০০8 সালে বিজ্ঞানী স্টিফেন ওপেনহাইমারের বই “আউট অফ ইডেন” বেরোনোর পর হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা আরো জোর দিয়ে এই বক্তব্যকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেন – ওপেনহাইমারের গবেষণা দেখাচ্ছে নব্বই হাজার বছর আগে আফ্রিকা থেকে মানুষ লোহিতসাগর পেরিয়ে ভারতে ঢোকেন, এনার আরো দাবী সমস্ত নন-আফ্রিকান মানুষদের পূর্বপুরুষ এঁরাই। কোনটা সঠিক তত্ত্ব সে নিয়ে বিতর্ক এখনো পুরোদমে বহাল। এরই মাঝে আবার  রোমিলা থাপার জানালেন আর্য একটি জাতি এই ধারণাটাই ভুল, আর্য একটি ভাষার নাম। কারা আর্য ভাষা বলতেন সেটাই প্রধান বিবেচ্য বিষয় হওয়া উচিত, আর সেই উত্তর পেলেই হয়ত এই ধাঁধার একটা সমাধান পাওয়া যাবে।

তাই আর্য কি বা কারা সেই নিয়ে দ্বন্দ্ব থাকলেও হাজার তিন – সাড়ে তিন বছর আগে যে উত্তর ভারতীয় এবং পারস্যের মানুষদের ভাষা এবং ধর্মবিশ্বাসে অনেকটাই মিল ছিল সে নিয়ে সন্দেহ নেই। জরথুষ্ট্রের কথাই ধরুন, নামটির মধ্যে লুকিয়ে আছে দুটি শব্দ –  জরত এবং উষ্ট্র। উষ্ট্র আমাদের উটই, তবে জরত শব্দের মানে নিয়ে একাধিক মত থাকলেও একটি ডমিন্যান্ট মত হল সংস্কৃত হারীত শব্দেরই সহোদর এটি। অর্থাৎ, যিনি সোনালী রঙের উটে চড়ে এসেছেন বা যিনি সোনালী উটদের দেখাশোনা করেন তিনিই  জরথুষ্ট্র। হাজার হাজার এরকম ফার্সি শব্দে আপনি সংস্কৃত বা সংস্কৃত শব্দে ফার্সি লুকিয়ে থাকতে দেখবেন। সেরকই আরেকটি শব্দগুচ্ছ হল –  আহুর মাজদা। আহুর বলা বাহুল্য যে অসুর এবং মাজদা হল সংস্কৃত মেধারই শব্দান্তর। সুতরাং, মেধাবী বা জ্ঞানী অসুরই হলেন আহুর মাজদা। প্রাচীন পারস্যে কিন্তু আহুর মাজদা পূজ্য ভগবান, যিনি জ্ঞান এবং সত্যের পথ দেখান; আর যাঁরা সাধারণ মানুষের বুদ্ধিবিভ্রম ঘটান, শঠতার পথ দেখান তাঁরাই দেভা। আধুনিক ভাষাতত্ত্ব অনুযায়ী ভারত এবং পারস্য দু দেশেই এই এক দল যতটাই ভালো, অন্য দল ততোটাই খারাপ এই ডাইকোটমি এসেছে আদি বৈদিক যুগের অনেক পরে।  আদি বৈদিক যুগ বা জরথুষ্ট্রের আমলে কিন্তু দু জায়গাতেই এই ডাইকটোমি ছিল না, ভালো-খারাপের হিসেব আমরা তখনো করে বসি নি। তাই ঋকবেদে অসুররাই আদি দেব,  আমরা যাঁদের দেবতা বলে চিনে এসেছি তাঁদের আগমন ঘটতে তখনো বেশ দেরী। ম্যাক্সমুলার জানিয়েছিলেন শুরুতে দেব কথাটির অর্থ ছিল উজ্জ্বল – আকাশ, তারা, সূর্য, দিন সব কিছুর ঔজ্জ্বল্য বোঝাতেই এই শব্দটি ব্যবহৃত হত। কে জানে তারুণ্যের দীপ্তি বোঝাতেই দেব কথাটি চলে এসেছিল কিনা।  এখন এই চ্যাংড়া দেবতাদের লীডারটিকে আমরা সবাই চিনি – ইন্দ্র। কিন্তু আদি দেব অর্থাৎ অসুরদের প্রধান কে বলুন তো? বাহনটি দেখে শনাক্ত করতে পারেন কিনা দেখুন।

 

Varuna

হ্যাঁ, মকরাসীন বরুণ-ই অসুরপ্রধান। বরুণ যে জলের দেবতা সে তো আমরা জানি আর ওদিকে যে আহুর মাজদার কথা বলছিলাম তিনিও কিন্তু celestial ocean এর দায়িত্বে, সেই অলৌকিক সমুদ্র যা নাকি পৃথিবীকে চারপাশ থেকে ঘিরে রয়েছে। পারস্যের আহুর মাজদা এবং ভারতের বরুণের এই সাদৃশ্য চমকপ্রদ; কেউ কেউ শুক্রাচার্যকে (যেহেতু অসুরদের গুরু) আহুর মাজদা বললেও, বরুণই যে সেই মস্ত অসুর সে নিয়ে সন্দেহ নেই। ও হ্যাঁ, জ্ঞানের বিশাল পরিধির জন্যই হয়ত অনেক সাধারণ ভক্তদের কাছেই মাজদা শব্দটি দাঁড়িয়েছে ‘বিশাল’, এ বিশালের সঙ্গে অবশ্যই আকারআকৃতির  কোনো সম্পর্ক নেই।  যাই হোক, পুরাণ জানাচ্ছে নতুনের কাছে পুরনোকে হার স্বীকার করতে হয় – ইন্দ্রের নেতৃত্বে দেবতারা বিদ্রোহ করলে অসুরদের সরে যেতে হয়। আর বেদ বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বরুণ এবং অন্যান্য অসুর যেমন মিত্র, পৃথ্বী কি ঊষাদের গুরুত্ব কমে যাচ্ছে সাঙ্ঘাতিক ভাবে (তখনো কিন্তু ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর রা প্রায় অজানা)। এমন কি একটা সময়  মিত্র এবং বরুণকে একসঙ্গে মিলিয়ে এক নতুন অবতারেরই সৃষ্টি করে ফেলা হয়েছে, যাঁর নাম মিত্রাবরুণ (জরথুষ্ট্রর আভেস্তা তেও কিন্তু এক মিথ্রা রয়েছেন যাঁকে আহুর মাজদা নিজের হাতে তৈরী করেছেন) । ঊষাকে শুরুতে দেবতাদের মা বলা হলেও পরের দিকে বলা হচ্ছে ইন্দ্র নিজেই নাকি নিজের মা-বাবাকে সৃষ্টি করেছেন। আমার মনে হয় অবাস্তবতা এখানে ফ্যাক্টর নয়, কি ভাবে নতুন রক্ত যেন তেন প্রকারে ওল্ড অর্ডারকে অস্বীকার করছে সেটাই দেখার।

বহু পরে অসুর শব্দটির সঙ্গেই জড়িয়ে দেওয়া হয় এক অশুভ অর্থ, হয়ত এই ইয়ং ব্লাডের আদেশেই। আরো একটি জিনিস লক্ষ্য করার – আদি অসুরদের কারোর নামের সঙ্গেই কিন্তু অসুর শব্দটি জড়িয়ে নেই অথচ পরে প্রত্যেক অসুরের নামের মধ্যেই অসুর শব্দটি রয়েছে, যেমন মহিষাসুর। দু’ভাবে ব্যাপারটিকে বিশ্লেষণ করা যায় –  ক) পুরাণ প্রণেতারা উইচ হান্টিং শুরু করে দিয়ে গেছেন, রাজত্বের ব্যাপারে দেবতাদের সঙ্গে যারাই যুদ্ধে জড়িয়েছেন প্রত্যেককে ট্যাগ করা হয়েছে অসুর বলে, খ) যারাঁ পুরুষানুক্রমে ওল্ড অর্ডারের প্রতি আস্থা রেখেছেন বা আনুগত্য দেখিয়েছেন, তাঁরা সাধ করে নিজেরাই অসুর নামটি ঢুকিয়ে নিয়েছেন নিজেদের নামের মধ্যে – বৃত্র নামটি তো এমনিই থাকতে পারত, তাই নয় কি? কিন্তু হতেই পারে যে বৃত্রের কাছে অসুর শব্দটি একটি গর্বের প্রতীক।

পরের পুজোয় বৃষ্টি পড়তে দেখলে একবারের জন্য কি মনে হবে না ওল্ড অর্ডার  সেই মস্ত অসুরের নেতৃত্বে প্রতিহিংসা নিতে নেমেছেন? যতই হোক, মা দুর্গাও ইয়ং ব্লাডের দলেই পড়েন।