সাদা ফ্রেম, কালো ফ্রেম

বিধিসম্মত সতর্কীকরণ – এটা ফ্যানবয় পোস্ট, ফ্যানবয়দের আতিশয্যে যদি গা জ্বালা জ্বালা করে বা উত্তমকুমারকে যদি জেনারেলি অপছন্দ করেন তাহলে এ পোস্ট না পড়াই ভালো।

মহানায়কের জন্মদিন আজ (3rd September) সুতরাং সাড়ে বত্রিশ ভাজায় একটা পোস্ট দিতেই হত। কলকাতার স্কুল-কলেজে, জে-এন-ইউর ধাবায় এমনকি সিয়াটলে পি-এইচ-ডি স্টুডেন্টদের জমায়েতে যখনই একাধিক বাঙ্গালী (সময় সময়ে বাংলাদেশীরাও) থেকেছেন, উত্তম ভার্সাস সৌমিত্র টপিকটি অবধারিত ভাবে এসেছে – একবারের জন্যও ব্যতিক্রম ঘটতে দেখিনি। ছেলেমানুষি? হয় তো তাই কিন্তু আড্ডা জমিয়ে দেওয়ার জন্য এর থেকে ভালো বিষয় হয় না। এ আড্ডা শুরু হলে সব থেকে মুখচোরা তরুণ বা তরুণীটিও কথা না বলে উঠে পারেন না, ফ্রেশার্সদের জড়তা কাটানোর জন্য এ দাওয়াই র‍্যাগিং এর থেকে ঢের ভালো  । মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল নিয়েও লোকে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন কিন্তু উত্তম বনাম সৌমিত্র নিয়ে কথা হচ্ছে না, এমনটি নৈব নৈব চ।  অর্কুট কি ফেসবুকে অবশ্য এ ঝগড়া অনেক উদ্দাম, দু পক্ষই বাছা বাছা যা সব বিশেষণ ঢালেন সেসব শুনলে আমাদের ভূতপূর্ব ম্যাটিনি আইডলরা (কবিতা সিংহের অনুবাদ ছিল ‘বৈকালিক বিগ্রহ’, আমার অবশ্য এই শব্দগুচ্ছটি একদমই পোষায়নি) হার্টফেল করতেন।

তো এহেন ঝগড়া যখন অভিনয় ক্ষমতার চৌহদ্দি ছাড়িয়ে লুকস-এ গিয়ে পৌঁছয় তখন সৌমিত্র সাপোর্টাররা উইদাউট ফেল চড়া লিপস্টিক লাগানো সপ্তপদীর উত্তমকে মনে করিয়ে দিয়ে মহা তাচ্ছিল্যের হাসি হাসেন। এই লিপস্টিককে কাউন্টার করার জন্য আমি বোধহয় আজ বছর পনের ধরে চশমার শরণাপন্ন। হ্যাঁ, চশমা চোখে উত্তম (স্পেশ্যালি সে চশমা যদি মোটা ফ্রেমের হয়) বাঙ্গালী আভিজাত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতীক। এ আভিজাত্যের সঙ্গে অবশ্য বংশ, অর্থ, সাফল্য কোনো কিছুর সম্পর্ক নেই – একজন অতি মধ্যবিত্ত বাঙ্গালীও অভিজাত হয়ে উঠতে পারেন  স্রেফ পার্সোনালিটি দিয়ে। অবশ্যই বলা যত সহজ, করে দেখানো তার চেয়ে হাজার গুণ কঠিন। উত্তম সেই কাজটা যে কি অবলীলায় করে গেছেন তা বলে বোঝানোর নয়; এই অবতারে উত্তমকে দেখলেই মনে হয় লাস্ট ম্যান স্ট্যান্ডিং, সিনেমাটা শেষ হবে আর তারপরেই খেয়াল পড়বে যে এ আর হল না, বাঙ্গালীর জীবদ্দশায় হয়ত হবেও না।

আজকে সেই চশমা আঁটা উত্তমের কিছু ঝলক রইল সাড়ে বত্রিশ ভাজায়।

কালো ফ্রেম

১) চিড়িয়াখানা (১৯৬৭) –  বহু সমালোচকই বলে থাকেন  সত্যজিৎ এ সিনেমায় ব্যোমকেশের প্রতি সুবিচার করেননি। কিন্তু পরিচালকের কথা এখানে ধরছি না, অভিনেতা উত্তম অনন্য – স্বয়ং সৌমিত্র বলেছেন চিড়িয়াখানায় উত্তমের পারফরম্যান্স প্রায় একমেবাদ্বিতীয়ম।  শরদিন্দু নিজে চশমা চোখে ব্যোমকেশকে একদমই পছন্দ করতে পারেননি (আদত ব্যোমকেশের চশমা নেই) কিন্তু চশমা এখানে ব্যোমকেশকে আলাদা একটা গ্র্যাভিটি দিয়েছে। চিন্তামগ্ন সত্যান্বষীকে চশমা ছাড়া দেখতেই বরং একটু অদ্ভুত লাগত না?

Chiryakhana

২) হার মানা হার (১৯৭২) –  তারাশঙ্করের ‘মহাশ্বেতা’ অবলম্বনে বানানো সলিল সেনের এই সিনেমায় উত্তমকুমারের নাম বিনোদা সেন। পেশায় শিল্পী, যদিও দেশসেবার জন্য প্রায় সব শিল্পই অসমাপ্ত। শিল্পীর বোহেমিয়ানা, একাকীত্ব এবং অসহায়তা সবই ফুটে বেরিয়েছে কালো ফ্রেমের ভেতর দিয়ে।

haar mana haar

৩) যদি জানতেম (১৯৭৪) – উত্তম আরো একবার গোয়েন্দার ভূমিকায়, এবার নারায়ণ সান্যাল সৃষ্ট ব্যারিস্টার পি-কে-বাসু। নারায়ণ সান্যালের কাঁটা সিরিজের প্রথম বই ‘নাগচম্পা’ অবলম্বনে বানানো এই সিনেমায় অবশ্য উত্তমের থেকে স্ক্রিনে বেশীক্ষণ থেকেছেন সৌমিত্র। কিন্তু সৌমিত্র এবং সুপ্রিয়াকে খুনের দায় থেকে বাঁচানোর জন্য উত্তমই ভরসা। দাপুটে ব্যারিস্টারকে একবার চশমা ছাড়া ভাবার চেষ্টা করে দেখুন তো।

jodi jantem

৪) যদুবংশ (১৯৭৪) – বিমল করের উপন্যাস অবলম্বনে বানানো এ সিনেমায় উত্তমের চরিত্রের নাম গণনাথ। উত্তমের চরিত্রটি এখানে পার্শ্বচরিত্র এবং ছবি শুরুর প্রায় আধ ঘন্টা পর গণনাথকে প্রথমবারের জন্য দেখা যায়। উত্তমের সেরা কাজের লিস্ট বানাতে গেলে বহুজনই প্রথম পাঁচে যদুবংশকে রাখবেন। বদলে যাওয়া সমাজের প্রতি নিষ্ফল নীরব আক্রোশে ফুঁসতে থাকা গণাদার চোখে কিন্তু গোল ফ্রেমের চশমা, ট্র্যাডিশনাল চৌকো ফ্রেমের জায়গায়। গোল ফ্রেমের চশমা সাধারণত শৌখিনতার প্রতীক, সিনেমায় তুলে ধরা আয়রনি যেন কখন অজান্তে ছুঁয়ে গেছে সিনেমার prop কেও।

jadu bangsha

৫) দুই পৃথিবী (১৯৮০) – আমার লিস্টে উত্তমের সেরা তিন সিনেমার একটি, উত্তমের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অভিনয় করেছিলেন ভিক্টর ব্যানার্জ্জীও। নুভো রিচ ছোটো ভাই ভিক্টরের টাকা যখন পৃথিবীসুদ্ধ সবার বোধবুদ্ধি গুলিয়ে দিয়েছে (এমন কি বাবা মায়েরও) তখনো আদর্শে অবিচল থেকেছেন উত্তমের বড়দা। কিন্তু কালো ফ্রেমের নিচে থাকা আপাতশান্ত একজোড়া চোখ যে ফুঁসেও উঠতে পারে তার প্রমাণ এই ক্লিপটি। ভ্রাতৃবধূকে জড়িয়ে কুৎসাক্ষেপণে রত ভিক্টরের নীচতা দেখে এক পলকের জন্য থমকে যাওয়া বড়দা বলে উঠছেন, “ইউ স্কাউন্ড্রেল!”। এর পর প্রায় এক মিনিট লম্বা একটি দৃশ্যে উত্তম ভিক্টরকে চাবুকপেটা করবেন, অত মাচো অ্যাকশন সিন বাংলা সিনেমাতে দুর্লভ।

dui prithibi

সাদা ফ্রেম 

১) বাঘবন্দী খেলা (১৯৭৫) – তর্কাতীতভাবে উত্তমের করা সেরা খল চরিত্র, এত দাপুটে অভিনয় উত্তম ছাড়া আর কেউ করতে পারতেন বা বলেই আমার ধারণা। অনুতাপের বিন্দুমাত্র রেশ না দেখিয়ে স্বেচ্ছাচারের যে নমুনা বাঘবন্দীর ‘বড় সাহেব’ রেখেছেন তা বাংলা সিনেমায় অভূতপূর্ব। সাদা ফ্রেমের মধ্যের চোখ দুটো কিন্তু এখানে অসম্ভব ক্রূর, নিজের ছেলেকে ঠকিয়ে শেষ করে দিতেও যে চোখের পাতা একবারের জন্যও কাঁপবে না।

baghbandi khela

২) অগ্নীশ্বর (১৯৭৫) – বনফুলের সেই আদর্শবান  ডাক্তার; যাঁর  আপাতরুক্ষ ব্যবহারে দুঃখ পেয়ে লাভ নেই, বরং মানুষটির আসল চরিত্রটিকে বুঝতে গেলে কিছু সময় কাটানো নিতান্তই দরকার। সিনেমারর বাকি চরিত্রদের সে সুযোগ না মিললেও দর্শকদের মিলেছে, এবং সে জন্য তাঁরা চিরকৃতজ্ঞ।

agnishwar

৩) ব্রজবুলি (১৯৭৯) – এবারে উত্তম গৌরকিশোর ঘোষ বা রূপদর্শীর বিখ্যাত চরিত্র গুল্পবাজ ব্রজদার ভূমিকায়। মেক আপটি ঠিক জমেনি, সময় সময় চিড়িয়াখানার জাপানীজ হারাকিরির কথা মনে করিয়ে দেয় কিন্তু সাদা ফ্রেমে আড্ডাটি দেদার জমিয়ে দিয়ে গেছেন উত্তম। আর এ আড্ডার উপরি পাওনা ভবানীপুরের আদি বাসিন্দা উত্তমের খাঁটি কলকাত্তাইয়া চালে ‘খেলুম, গেলুম, ছিলুম’ বুলি।

Brajabuli

8) দুই পুরুষ (১৯৭৮) – আবারো তারাশঙ্কর, বাঘবন্দী খেলার পর আবারো পার্থ মুখোপাধ্যায় ছেলে, এবং আবারো ছেলের সঙ্গে চূড়ান্ত কনফ্রন্টেশন। একদা আদর্শবান বাবা আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়েছেন, শুধু ছেলেই রুখে দাঁড়িয়েছে বাবার হাজারো একটা ভুল সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে। বাবার ঠিক করা মেয়েকে বিয়েতে রাজি না হওয়ায় বাবা ছেলেকে পরিত্যাগ করেন, সগর্বে জানিয়ে দেন “তিল তিল করে গড়ে তোলা এ সাম্রাজ্য আমার, আমি এখানে সম্রাট, এখানে কোনো অবাধ্যতা আমি বরদাস্ত করি না”। বাংলা সিনেমার বাবা ছেলের মধ্যের ঘাত-প্রতিঘাতে ভরা দৃশ্যগুলির অন্যতম একটি দৃশ্য এ ছবির – উত্তমকে যথার্থ সঙ্গত দিয়েছিলেন পার্থ, এত নাটকীয় একটি দৃশ্যকে পারফেক্ট করে তোলার জন্য দুই অভিনেতার অনুরোধেই বেশ  কয়েকবার রিটেক করতে হয়েছিল পরিচালককে।

dui purush

৫) আলো আমার আলো (১৯৭১) – যদিও ‘সানগ্লাসে উত্তম’ একটা আলাদা ব্লগপোস্ট হবে, কিন্তু এই পোস্টেও একটা ক্লিপ দেওয়ার লোভ সামলাতে পারলাম না।

Aalo aamar aalo


ফ্রেম কিন্তু সাদাই, বিশ্বাস না হলে একবার দেখে নিন, “এই এত আলো, এত আকাশ………”

তবে চশমার কথাই যদি ওঠে তবে সবার আগে কিন্তু মনে পড়ে ইন্সপেকটর তিনকড়ি হালদারকে।

Thana theke aaschi

4 thoughts on “সাদা ফ্রেম, কালো ফ্রেম

  1. খুব সুন্দর লিখেছেন। বেশ কয়েকটা ছবিই আমার দেখা হয়নি। এবার যোগাড়যন্ত্র করে দেখে ফেলতে হবে।

    আপনি তিনকড়ি হালদারকে তালিকার প্রথমেই রাখলেননা কেন? আমার তো মনে হয় ব্যোমকেশের চেয়েও তিনকড়িতে উত্তমকুমারের অভিনয় ভাল।

    Like

  2. তথাগত – আপনার সঙ্গে একমত, থানা থেকে আসছি তে উত্তমের অভিনয় আর প্রায় সব কিছুকেই ছাড়িয়ে গেছে। ডিউ ক্রেডিট টুকু দেওয়ার জন্যই একদম শেষের আলাদা করে মেনশন করা – “তবে চশমার কথাই যদি ওঠে তবে সবার আগে কিন্তু মনে পড়ে ইন্সপেকটর তিনকড়ি হালদারকে”।

    Like

  3. Duronto ebong phataphati… jadio ami ektu Soumitra ghesha… kintu je cinemagulo ullekh karechish… off just bhaba jayena… r bangali abhijatyer dik diye uni sreshtho.

    Khub sundor… tabe tor ei banglar madhye amr ei english typo ta baroi bemanan 😦

    Like

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s