“Looking high, high, high/ Looking low, low, low/ Wondering why, why, why/ Did she go, go, go”………
“কি পেলেন?”
“ওই যা পাই আজকাল – এট্টু পার্শে পোনা, এট্টু চিংড়ি মীন”……বলতে বলতেই দেখি একটা বাচ্চা কালো কাঁকড়া জাল থেকে বেরিয়েই পড়ি কি মড়ি করে ছুটলো।
ইন্দ্রদা এর মাঝে বেশ কয়েকবার গলা খাঁকরানি দিয়েছে অর্থাৎ কিনা খেজুরে শেষ করে এবার আসল প্রশ্নটা কর্। এবার মরিয়া হয়ে নিজেই জিজ্ঞাসা করল, “ইয়ে……জল আসে না এখানে?”
“তা আসবে না কেন? ওই তো ঢুকতে শুরু করেছে”।
“অ্যাঁ, তাই নাকি? কোথায় কোথায়? অ্যাই অপু, দেখতে পাচ্ছিস? ঝিনি, তুমি দেখতে পাচ্ছ?”
ঝিনিদি অম্লানবদনে বলল “সেকি, তুমি দেখতে পাচ্ছ না? এই তো সামনেই…… ওই তো তিরতির করে এগিয়ে আসছে।”
“ইয়ার্কি, সমুদ্রের জল তিরতির করে এগিয়ে আসছে?” ইন্দ্রদা হতাশ হয়ে আমার দিকে তাকাল। আমি দয়াপরবশ হয়ে ঘাড় নাড়লাম – চিন্তা নেই, যত দূরেই তাকাও জলের টিকি দেখা যাচ্ছে না।
“কই দাদা, এই যে বললেন জল ঢুকছে?”
“নিয্যস ঢুকছে, ও আপনাদের চোখে ধরা পড়বে না। যান, তেল টেল মেখে ঘন্টা দুই পরে চলে আসুন………জল একেবারে থৈথৈ করবে, তখন নেমে চান করে নেবেন অখন। রোজই তো কলের জলে চান করেন। ”
“আরে বলে কি রে! দেখেছিস অপু, বলেছিলাম না এ হল গিয়ে একেবারে ভার্জিন স্পট, লোকজন এখনো বিশেষ খুঁজে পায়নি। হোটেল থেকে বেরিয়েই জলে নেমে পড়ব, আদিগন্ত কেউ নেই , শুধু আমরা আর লাল কাঁকড়া। আহা।”
অন্য সময় হলে ভাবতাম খাদ্যরসিক ইন্দ্রদা লাল কাঁকড়ার কথা ভেবেই ‘আহা’টা বলল, তবে আধ ঘন্টা আগেই আমাদের ডিটেলসে বুঝিয়েছে ওগুলো লোকে খায় না , সুতরাং এ আনন্দ যে জলের আসার আশাতেই সে নিয়ে সন্দেহ নেই।
ঝিনিদির হঠাৎ উত্তেজিত গলা, “ইন্দ্র, দেখেছ – পাশেই একদম নতুন একটা হোটেল তৈরি হচ্ছে? কি সুন্দর না আর্কিটেকচার টা? ”
ইন্দ্রদা ততোধিক উত্তেজিত, “তবে! বলছি টা কি। এখনো লোকজন জানে না, বছর তিনেক পর এখানে এসো – পুরো মন্দারমণির মতন অবস্থা হবে।”
সমুদ্র যেখানে থাকার কথা, আমাদের লজটা তার পাশেই – দু’মিনিটের রাস্তায় লাল কাঁকড়াদের একটা বিশাল কলোনি পেরোতে হয়। তারা ঠিক গর্তের ওপর চুপটি করে বসে থাকে, পায়ের শব্দতরঙ্গ ভেসে এলেই টুপ করে যে যার গর্তে ডুব। একবার তাড়াতাড়ি হেঁটে দেখলাম, যারা একটু দূরে চলে গেছিল তড়িঘড়ি যেখানে যা গর্ত পেল ঢুকে গেল – স্পষ্টতই বোঝা গেল ঘরগুলো ইন্টারকানেক্টেড, কে জানে নিচে হয়ত বিশাল দালান-ও আছে। এক ব্যাটা তাড়াতাড়িতে সুবিধে করতে না পেরে একটা পাথরের সাইডে গিয়ে মড়ার মতন পড়ে রইল, যেই কাছে গেছি অমনি দাঁড়া খাড়া। ফটো তোলার জন্য তার সঙ্গে একটু চু-কিত-কিত জাতীয় খেলতে হচ্ছিল, যতক্ষণ ওয়ান ইজ টু ওয়ান ছিল তার খেলার তেজই আলাদা। দু’জন মিলে ধাওয়া করার সময়-ও কোনো সমস্যা নেই তার, কি ক্ষিপ্রতায় যে ডান- বাঁ- সামনে – পিছনে এগোতে পিছোতে লাগল কি বলব – উদ্দেশ্য একটাই, যে কোনো ভাবেই দু’জনকে একই দিকে রাখতে হবে, সামনে পিছনে দু’দিকেই দুর্ধর্ষ দুশমনদের রাখা যাবে না। মুশকিলটা হল ইন্দ্রদা ক্যামেরাটা নিয়ে দৌড়ে আসার পর, তিনজনকে যে একসঙ্গে কিভাবে সামাল দেওয়া যাবে সেটা বেচারীর মাথায় এল না। স্থাণুবৎ দাঁড়িয়ে পড়ার পরেও দেখলাম ভয়ের চোটে কমলা দাঁড়াগুলো টকটকে লাল হয়ে উঠেছে।
ফটোসেশনের পর একটা স্পষ্ট দীর্ঘশ্বাস শুনতে পেলাম, দু’পেয়েরা বলা বাহুল্য একটু বিপাকে ফেলে দিয়েছিল।
দু’ঘন্টা পর ফিরে এসে সবাই ভারী উত্তেজিত – জল এসেছে! কিমাশ্চর্যম্ , সেই তিরতির করেই। পার্শে পোনা নিয়ে এখনো লোকজন ফিরছে, তার অভয় দিয়ে গেল , “এই তো জোয়ারের সময়, এবার হু হু করে আসবে।” শুনে ভারী ফুর্তি, আস্তে আস্তে জলের দিকে যাওয়া শুরু। মিনিট দুয়েক পর ঝিনিদির জিজ্ঞাস্য , “কতটা দূর গেলে পায়ের পাতা একটু ভিজবে বলে মনে হয়?” “ওই তো, সামনেই মনে হচ্ছে একটু ঢেউ খেলছে।” “বেশ, বেশ”………মিনিট দশেক পরেও একই কথোপকথন হচ্ছে দেখে আমরা একটু অস্বস্তিতে। ঘাড় ঘুরিয়ে ইন্দ্রদাকে প্রশ্নটা ফরোয়ার্ড করতে গিয়ে দেখি সে পাশে নেই। পেছন ফিরে দেখি হাত পাঁচেক দূরে ইন্দ্রদা বেজায় ভুরূ কুঁচকে তাকিয়ে।মিনিটখানেক পর খানিকটা ফিসফিস করে বলল, “ঝিনি, কোন সমুদ্রের তীরে ঘাস গজায়?”
ঝিনিদির বিষয় ভূগোল, কাষ্ঠহাসি হেসে বলল, “গজায় না। সমুদ্র না কচু, নদীর মোহনা বলে মনে হচ্ছে এটা।” আমি মিনমিন করে বলার চেষ্টা করলাম, “ইয়ে, ইন্টারনেটে কিন্তু সমুদ্রই বলেছে, সঙ্গে খালি বলেছে নিস্তরঙ্গ।” ঝিনিদি পাক্কা মিতিন মাসী স্টাইলে বলল, “কিন্তু ভেবে দেখে, একটা ছবিতেও সমুদ্র দেখেছিস?” হক কথা, খেয়াল পড়ল সবেতেই খালি বালিতে আটকে থাকা নৌকো। ঝিনিদি কি একটা বলতে যাচ্ছিল, ইন্দ্রদা হঠাৎ আর্তনাদ করে ওঠায় চমকে ক্যামেরাটাই ফেলে দিচ্ছিল প্রায়। ইন্দ্রদার গলায় হাহাকার, ” এ কি ঝিনি, এ কি।” আর এ কি! সেই তিরতিরে জল দেখি কোন জাদুবলে স্রেফ অদৃশ্য হয়ে গেছে ; জোয়ার কেন, ভাঁটার সময়েও সচরাচর এর থেকে কয়েকগুণ বেশী জল থাকে। কিন্তু সমস্যা সেখানে নয়, আদিগন্ত সমুদ্রের জলের বদলে আদিগন্ত কাদার মধ্যে আমরা দাঁড়িয়ে। আর সে কি কাদা! সে তো শুধু কাদা নয়, যাকে বলে পাঁক। বাঁকিপুটে এলাম এরকম একটা ধারণা তৈরি হয়েছিল, এখন দেখি পাঁক-ই-পুট।
শহুরে বাবুদের সঙ্গে অবশ্য প্রকৃতিই যে শুধু বদ রসিকতা করেছেন তা নয়, লজের ম্যানেজার অবধি বশংবদ গলায় জানিয়েছিলেন “শীতকালে ঢেউটা একটু কম থাকে সার, বর্ষাকালে সত্তর ফুট ঢেউ পেয়ে যাবেন।” সত্তর ফুট অবশ্য উঠেছিল পেটে পানি পড়াতেই, কিন্তু তা বলে শেষে এই? তার মধ্যে আবার কারা বলছিলেন তেল টেল মেখে এসে সমুদ্রের জলে নেয়ে যেতে।
সেই অবিশ্বাস্য কাদা ভেঙ্গে ঘরের ছেলেমেয়ে কিভাবে ঘরে ফিরলাম তার বর্ণনা আর দিতে চাই না। তবে শক্ত মাটিতে যখন পা পড়ল, তখন হাওয়াই চপ্পলের নিচেও আরো দু’তিন লেয়ারের পুরু সুখতলি। বিধ্বস্ত এবং বিমর্ষ কম্প্যানিয়নদের ভরসা দিতে অবশ্য ইন্দ্রদা ওস্তাদ, “কুছ পরোয়া নেই, ওই জেলেদের থেকে নিয়ে কাদা চিংড়িই খাবো।” শুঁটকি মাছের ম’ম করা গন্ধের মধ্যে থেকেই অবশ্য মিলল কুচো এবং কাদা চিংড়ি, মিলল আরেক স্কুপ নিউজ। পাশের সেই নতুন হোটেলের কাজ ঠিক শুরু হয়নি, বরং বলা যায় শুরু হয়েই শেষ হয়ে গেছে। সমুদ্র যখন ঘুরে অন্য দিকে চলে গেছে, তখন কয়েক কোটিই মাত্র ঢালা হয়েছে – বলা বাহুল্য, আমরাই একমাত্র দুখী নই।
অবশ্য দমে যাওয়ার পাত্র আমরা কেউই নই। ওই তো ইন্দ্রদা ভারী খুশী খুশী মুখে এক ঝাঁক সবজে মাছরাঙার ছবি তুলছে, অসম্ভব চঞ্চল ছোট্ট পাখিগুলো দয়া করে এতক্ষণে স্থির হয়ে বসেছে; ঝিনিদি পাঁক-ই-পুটের বালুতটেও ঝিনুক খুঁজতে গিয়ে খুঁজে পেয়েছে একটা মরা ছুঁচো, সেটাই ভারী হাসি হাসি মুখ করে দেখছে। আমি বসে আড্ডা দিচ্ছি ড্রাইভার রাজুর সঙ্গে, রাজুর হাতে ধরা এক প্যাকেট বিস্কিট – বোম্বে রোডের টোলট্যাক্সওলা পাঁচ টাকা চেঞ্জ দেন না , তার বদলে ধরিয়ে দেন ওই প্যাকেট। আমি অবশ্য যতবার হাত বাড়াই, রাজু সরিয়ে নেয়; শেষে বলল “খাবেন না দাদা, ফেরার পথে যখন আবার চেঞ্জ চাইবে তখন এই প্যাকেটটাই ফেরত দেব।”
দিয়েওছিল।
(স্থিরচিত্র – কাজরী এবং ইন্দ্রনীল)
পুনশ্চ – শুরুর গানটা দিতে ভুলে যাচ্ছিলাম!
প্রবীর, লেখাটা পড়ে বেশ লাগল, কিন্ত, একটা প্রশ্নঃ এগুলো তো হারমিট ক্রাব নয়। হারমিট ক্রাবের একটা শাঁখ বা গুগ্লির মত স্পাইর্যাল শেল থাকে, তার মধ্যে ঢুকে যায় বিপদ এলে।
LikeLike
নীলমণি দা, ঠিক বলেছেন। ভুল টা ঠিক করে নিলাম; হারমিট ক্র্যাবদের রঙটাও বোধহয় লালই হয়, সেখান থেকে এই কনফিউসন।
LikeLike
এতরকম মাছের কথা পড়েটড়ে মনটা কেমন যেন উদাস হয়ে গেল!
লেখাটার টাইটেলটাও বেশ সুন্দর। 🙂
LikeLike
অরিজিত – মাছের কথাই যখন উঠল তখন এই লেখাটাও পড়তে পারেন,
LikeLike
nicher pakhi ta kintu thik sobje machhranga noi…otake bole green bee-eater. mane sobje machhi khai je taa noi…tobe oi machhi tachhi e dhore kheye thake…bhari sundor pakhi 🙂
LikeLike
থ্যাঙ্ক ইউ অঙ্কন ইনফরমেশনটার জন্য ; আমাদের-ও একটু সন্দেহ যে হয়নি তা নয় কিন্তু ঠোঁট টা দেখতে দেখতে শেষমেশ মনে হল কে জানে হয়ত মাছরাঙ্গা গোত্রীয়ই হবে।
LikeLike