ধুনুচিদের সদ্য ধুনে যাওয়া তুলো ভরা লেপ গায়ে দিয়ে চাঁদমামার আন্ডারঅ্যাপ্রিসিয়েটেড ফ্যান্টাসি-ফিকশন পড়াই হোক কি পার্ক সার্কাস ময়দানে গিয়ে অজন্তা সার্কাস দেখা কি জে-এন-ইউর কাঁটাঝোপ আর ধুলো ভরা মাঠে চুটিয়ে ক্রিকেট খেলা – শুধু শীতের দুপুরের স্মৃতি নিয়ে লিখতে বসলেই কম সে কম আট-দশ খানেক পূর্ণাঙ্গ ব্লগ পোস্ট হয়ে যায়। স্মৃতি সততই সুখের না হলেও নস্টালজিয়ায় বড় আরাম, আর ঠিক সেরকম আরামটিই ভরপুর ২০১৪-র জানুয়ারীর একটা দুপুরে পেয়ে ভারী চমকে উঠলাম। একা একা ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে এর আগে গেছিলাম একবারই, রোটারি ক্লাবের লাইব্রেরী থেকে বই তুলে নেওয়ার পরেও হাতে বেশ কিছু সময় ছিল। কিন্তু ক্লাস নাইনের ছেলেটিকে এক দশাসই মহিলা বেজায় ঘাবড়ে দিয়েছিলেন ভিক্টোরিয়াতে বসতে হলে তাঁর থেকে এক প্যাকেট সিগারেট কিনতেই হবে এহেন দাবী জানিয়ে। এবারে অবশ্য সেরকম কিছু গোলযোগ ঘটল না, এক গোলগাল পুলিস একগাল হেসে শুধোলেন, “লিটারেরি মীট দেখতে এসেছেন?” ভাবলাম খুব একটা ভুল বলেননি, ‘দেখতে’-ও এসেছি বই কি। ঘাড় নাড়তে একটু সহানুভূতির সুরে বললেন, ” তা ভালো, কিন্তু কেউ তো আসেনি এখনো”। দুটোয় শুরু হওয়ার কথা, পৌনে দুটোতেও কেউ আসেননি শুনে অবাক হওয়ারই কথা কিন্তু এহেন কিছু ঘটতে পারে এরকম একটা মানসিক প্রস্তুতি যেন ছিলই। কিন্তু যেটার জন্য একদমই প্রস্তুতি ছিল না সেটা হল তার পরেও মীট মাত্র মিনিট পাঁচেকের দেরীতেই শুরু হয়ে গেল।
দুটো বাজতে পাঁচে ঢুকে (প্রবেশ অবাধ) দেখি ভিক্টোরিয়ার ঠিক সামনেই সাদা – নীল (আহেম!) মন্ডপে জনা পাঁচেক মানুষ বসে। শ্রোতা বা দর্শনার্থীদের থেকে ভলান্টীয়ারদের সংখ্যা বেশী, কিন্তু চমকটা সেখানে নয়। যাঁদেরকে শ্রোতা বলে ভাবছিলাম, সামনে গিয়ে দেখি তাঁরাই বক্তা। প্রৌঢ় (নাকি বৃদ্ধ-ই?) সাংবাদিক ইয়ান জ্যাক আনন্দবাজারের স্বাতী ভট্টাচার্য্যের সঙ্গে আড্ডা মারছেন, তাঁদের পাশেই বসে এক সঞ্চালিকা যাঁকে সেই গোলগাল পুলিশ ভদ্রলোক একটু আগেই আমার পাশে দাঁড় করিয়ে রাখছিলেন (পরে অবশ্য ভুল বুঝতে পেরে জিভ বার করে কান এঁটো করা হাসি হাসলেন)। এর মাঝে আরেক ফ্যাসাদ, উদ্যোক্তারা বেজায় জোরাজুরি করছেন সবাইকে সামনের সারিতে বসার জন্য, দিব্যি গেলে বলছেন যতই “Reserved” লেখা থাকুক না কেন ও আপনাদেরই সিট – কেউ শুনলে তো ? নেহাত অ্যাকাডেমির দিক থেকে হঠাৎ মাইকে “নিপাত যাক, নিপাত যাক” শুরু হল, সবাই গুটিগুটি সামনে এগোলেন। প্রথম সেশনটায় শুনেছিলাম থাকবেন নিজামুদ্দিনের বেড়ালদের জাতে তুলে দেওয়া নীলাঞ্জনা রায় আর ভারতের “প্রথম” ফ্যান্টাসি ফিকশন রচয়তা শমিত বসু, আই মীন বাসু – শমিত কে শেষবার সামনাসামনি দেখেছি মৌলানা আজাদে পার্ট টুর অনার্স পরীক্ষা চলাকালীন, প্রেসিডেন্সি আর আশুতোষের একই সঙ্গে সিট পড়েছিল। সেলিব্রিটি অবস্থায় দেখার সুযোগ এর আগে ঘটেনি কিন্তু সে গুড়ে বালি, শুনলাম নেমন্তন্ন চার – পাঁচ হাত ঘুরে এসেছে – কেউ জয়পুরের ক্লান্তি কাটিয়ে উঠতে পারেননি, কেউ নীল-সাদা রং টাই পছন্দ করেন না, কেউ আবার জনা দশেক শ্রোতার গ্যারান্টী চেয়েছিলেন। ইয়ান জ্যাক প্রত্যেকদিনই আড্ডা মারতে ভিক্টোরিয়া চলে আসছিলেন, শেষমেশ ওনাকেই পাকড়াও করা হয়েছে আর শেষ মুহূর্তে ধরে আনা হয়েছে ভালোমানুষ স্বাতীকে।
গ্রামীণ ভারত তথা বাংলা শেষ কিছু বছরে কতটা পাল্টেছে সেই হচ্ছে প্রথম সেশনের উপজীব্য বিষয়। স্বাতী ভারী গুছিয়ে বলেন, একটু থেমে থেমে, মনে হয় যেন বলতে বলতেই পরের লাইনটা নিয়ে ভাবনাচিন্তা করছেন। দেখলাম খুব একটা পলিটিক্যালি কারেক্ট হওয়ার-ও চেষ্টা করেন না; সবাই যখন ধর্ষণ কান্ডে রাজনীতিবিদ আর পুলিশ-প্রশাসনকে ছিঁড়ে খাচ্ছে স্বাতী সেই ব্যর্থতাকে অস্বীকার না করেও গ্রামীণ সমাজের দায়িত্ববোধ নিয়ে প্রশ্ন তুললেন, শোনালেন কিভাবে গ্রামের মোড়লরাও সে দায়িত্ববোধকে সটান চাপিয়ে দেন শহুরে মিডিয়ার ওপর। ইয়ান জ্যাক সত্যি সত্যিই আড্ডার মুডে ছিলেন, প্যান্টটা একটু ওপরে উঠে গিয়ে একটা টকটকে লাল রঙের মোজা বেরিয়ে পড়েছে – সে সব দিকে ওনার ভ্রূক্ষেপ নেই, অ্যানেকডোটের পর অ্যানেকডোট চলছে। মোবাইল ফোন থেকে শুরু করে টেলিভিশন সেট, চিপসের প্যাকেট থেকে শুরু করে ইন্সট্যান্ট কফি – প্রত্যন্ত গ্রামগুলিতেও যে পরিবর্তন এসেছে সে ব্যাপারে ইয়ান দেখলাম মোটামুটি সিওর। অমর্ত্য সেন পঞ্চাশ বছর ধরে “শিক্ষা চাই, স্বাস্থ্য চাই” বলে বলে আমাদের নিশ্চিতভাবেই বেজায় বোর করেছেন মনে হয়, পরিবর্তন প্রসঙ্গে ইয়ান সেসবের ধারেকাছে গেলেন না দেখলাম। ওই আপাত পরিবর্তন কতটা পি অ্যান্ড জি বা ইউনিলিভারের সার্থক রিটেলিং স্ট্র্যাটেজীর পরিচয় আর কতটাই বা উন্নয়ন সে নিয়ে একটা প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছিল। একটু মনঃক্ষুণ্ণ হয়ে পেছনে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি এক ভদ্রলোক বেজায় ভুরু কুঁচকে ইয়ানের দিকে তাকিয়ে, সাইড প্রোফাইলে ভারী চেনা চেনা ঠেকছে। মিনিটখানেক পর ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আমার দিকে তাকিয়েই হাসলেন, আর তক্ষুনি বুঝলাম আগের দিন স্টারমার্ক থেকে এনারই নতুন বইটা কিনেছি, সই সমেত – রামচন্দ্র গুহ-ও এসে গেছেন দুপুর দুপুর।
হঠাৎ খেয়াল হল, পুরো সেট আপটা দিব্যি লাগছে। ভিক্টোরিয়ার রাজকীয় ব্যাকগ্রাউন্ডটা এত স্বাভাবিক ভাবে সামনে দাঁড়িয়ে যে মনেই হচ্ছে না কলকাতার সযত্নে লালিত ইল্যুশনগুলোর একটাকে প্রত্যক্ষ করছি। শীতের দুপুরের সেই মিষ্টি রোদটাও দেখি দিব্যি চলে এসেছে, মৃদুমন্দ বাতাস-ও দেখলাম সঙ্গত দিচ্ছে – হয়ত আমলকি বন কাঁপবে না তাতে কিন্তু শ্রোতারা দেখছি নড়েচড়ে শালের উষ্ণ আলিঙ্গনে আরো নিবিড় হয়ে বসলেন। তাকিয়ে দেখি নড়াচড়ার আরো কারণ আছে, স্বাতী আর ইয়ান কখন যেন নেমে গেছেন; তাঁদের জায়গায় স্টেজে উঠে এসেছেন রেনেসাঁ পরিবারগুলির শেষ উত্তরসূরীরা। কৃষ্ণা বসুকে নিয়ে আসা হয়েছে একটি বই প্রকাশ করার জন্য। মনে হল ওনাকে এর আগে যতবার টিভির পর্দায় দেখেছি বোধহয় ক্লোজ আপেই দেখেছি, এত ছোট্টখাট্টো অবয়ব সেটা বুঝিনি আগে। যে বইটি প্রকাশিত হবে সেটি আত্মজীবনী, কথাপ্রসঙ্গে কৃষ্ণা বললেন উনিও সদ্য শেষ করেছেন ওনার আত্মজীবনী কিন্তু তাতে গল্প শুনিয়েছেন তিরিশ দশকের কলকাতার (বইয়ের নামটা বলেননি কিন্তু বইমেলায় ঘুরতে ঘুরতে পেয়ে গেলাম, “হারানো ঠিকানা”, প্রকাশক? ঠিক ধরেছেন, আনন্দ!) ভাবলাম হয়ত তিরিশ দশকের কিছু গপ্পো শুনতে পাব, শুনলাম-ও, তবে তিরিশের দশক নয়, ঊনবিংশ শতাব্দীর – অধিকাংশই জানা। দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতপূর্ব অধ্যাপক অরুণা চক্রবর্তী ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহল নিয়ে বায়ো-ফিকশন লিখেছেন, নাম “Jorasanko”, সেই নিয়েই আলোচনা আর বই থেকে কিছুটা পড়ে শোনাবেন…….আর কে, শর্মিলা ঠাকুর। গল্প শুরু হল দিগম্বরী দেবীকে নিয়ে, দ্বারকানাথের স্ত্রী। দ্বারকানাথের ম্লেচ্ছ জীবনযাপন দেখে ভয় পেয়েছিলেন ধর্মভীরু দিগম্বরী, স্বামী আগে না ধর্ম আগে এ কঠিণ প্রশ্ন সমাধানে ডেকে এনেছিলেন ব্রাহ্মণ পন্ডিতদের; তাঁরা বিধান দিলেন স্বামীসঙ্গ ছাড়ার প্রশ্ন ওঠে না কিন্তু একত্রে শয্যাযাপনে নৈব নৈব চ, আর অসাবধানে দেহস্পর্শ হলে সাত ঘড়া গঙ্গাজলে চান। দুঃখের কথা এই যে দিগম্বরী শেষে মারা যান ঘোর নিউমোনিয়ায়, দৈনিক কত ঘড়া জলে চান করতে হত কে জানে – ডিভোর্সের ধারণাটি তখন চালু থাকলে হয়ত প্রাণে বাঁচতেন। অরুণা এবং শর্মিলা দু’জনেই শোনালেন ঠাকুরবাড়ির পুরুষদের পাবলিক এবং প্রাইভেট ইমেজে কতটা অসঙ্গতি থাকত – বাল্যবিবাহ থেকে শুরু করে পণপ্রথা, ঠাকুরবাড়ির পুরুষরা মেনে নিয়েছিলেন সবকিছুই। স্বভাবতই মৃণালিনী প্রসঙ্গ উঠল, স্ত্রীরাও আদৌ কতটা মর্যাদা পেয়েছিলেন সেই নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করলেন অরুণা। বইটি পরে পড়লাম এবং প্রথম কথা মনে হল শর্মিলার প্রিপারেশন কিন্তু এই বইটি পড়েই, বহু কথা বইয়ের সঙ্গে হুবহু মিলে গেল। সে কথা যাক, ডিগনিফায়েড প্রেসেন্সের-ও একটা গুরুত্ব আছে বইকি। এ সেশন শেষ হল একটু আক্ষেপের সুরে, সঞ্চালক জানতে চেয়েছিলেন ঠাকুরবাড়িতে ছেলেবেলা কাটানোর স্মৃতিটুকু ঠিক কিরকম – “এই দুনিয়ার সকল ভাল, আসল ভাল নকল ভাল, সস্তা ভাল দামীও ভাল, তুমিও ভাল আমিও ভাল” ইত্যাদি ।
বলতে ভুলে গেছি যে এতক্ষণে কিন্তু সভা জমজমাট, তিলার্ধ স্থান নেই উলটে শীতের দুপুরে যাঁরা ভিক্টোরিয়ায় ঘুরতে এসে বিজাতীয় ভাষায় এত বকবকানি শুনে অধৈর্য হয়ে পড়ছিলেন তাঁরাও রেলিং এর ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়েছেন। শর্মিলা নেমে যেতেই তাঁরা-ও চলে গেলেন বটে কিন্তু জয়ন্ত কৃপালনী এবং ইন্দ্রজিৎ হাজরা ঢুকলেন বেশ একটা ফিল-গুড আবহাওয়ায়। দু’জনেই জন্মেছেন এবং বড় হয়েছেন কলকাতায় কিন্তু আপাতত দু’জনেই প্রবাসী। আলোচনার টপিক “ক্যালকাটা আন্ডারবেলি”, ইন্দ্রজিৎ শুরু থেকেই সারকাসটিক, “ক্যালকাটার আবার আলাদা করে আন্ডারবেলি কি? পুরোটাই তো আন্ডারবেলি।”; জয়ন্ত কৃপালনীর হিউমরটা বেশ ড্রাই এবং উপভোগ্য, কথায় কথায় তিনিও হুগলী নদীকে বললেন “আর্সহোল অফ বেঙ্গল”। আশা করা গেছিল দর্শকরা এসব খোঁচায় একটু জেগে উঠবেন কিন্তু সবারই মত “সত্যরে লও সহজে”; কোনো প্রতিবাদ এল না দেখে জয়ন্ত এবং ইন্দ্রজিৎ একটু হতাশ। জয়ন্ত এবং ইন্দ্রজিৎ দু’জনেই সম্প্রতি বই লিখেছেন কলকাতা নিয়ে, প্রথমজনের ছোট গল্পের সঙ্কলন “New Market tales” আর আলেফ বুক কোম্পানি সম্প্রতি যে শর্ট বায়োগ্রাফি সিরিজ শুরু করেছেন তারই একটি হল ইন্দ্রজিৎ-এর “Grand delusions : a short biography of Kolkata” – সুতরাং, তাঁদের চোখে কলকাতার পরিবর্তন সেশনটার অন্যতম থীম। জয়ন্তর ছোটবেলা কেটেছে ফ্রী স্কুল স্ট্রীটে, তাঁর মতে একটা বিশাল পরিবর্তন হল কলকাতার বুক থেকে ইহুদী, আর্মেনিয়ান, পার্শি, অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের উবে যাওয়া। কলকাতার কসমোপলিটানত্বকে তুলে ধরতে এঁদের ভূমিকা ছিল অপরিসীম, এঁদের চলে যাওয়াটা একটা বড় সাংস্কৃতিক ক্ষতি-ও। কিন্তু জয়ন্তর মূল প্রশ্ন কেউ কি এনারা কোথায় গেলেন সে নিয়ে ভেবেছেন, সাধারণ মানুষ হোক কি রাজনীতিবিদ। হক কথা, আর তাই সাদা-নীল প্যান্ডেলে সবাই স্পীকটি নট। ইন্দ্রজিৎ বললেন কলকাতার পরিবর্তন বিস্তর ঘটলেও দিল্লীর মানুষদের বাঙ্গালী নিয়ে পারসেপশন এখনো বদলায়নি – এই যেমন মোটের ওপর সবাই ভালো গান গাইতে পারে, টাকাপয়সা নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামায় না, এম-আই-টিতে পারটিকল ফিজিক্স নিয়ে পি-এইচ-ডি করার চান্স থাকলেও সে সুযোগ হেলায় ছেড়ে দেয় বামপন্থী রাজনীতি করবে বলে। আড্ডার খাতিরেই ইন্দ্রজিৎ হয়ত অনেকটাই বাড়িয়ে বলেছেন কিন্তু এর কিছুটাও সত্যি হলে বলতেই হবে বাঙ্গালী সত্যিই তাহলে বিস্মৃতপ্রায় জাতি – এহেন আইডেন্টিটি সঙ্কট আমাদের ইতিহাসে অভূতপূর্ব। সঞ্চালক সন্দীপ রায়-ও (সত্যজিৎপুত্র নন, জার্নালিস্ট) বোধহয় এমনটিই কিছু ভাবছিলেন, তাই জয়ন্ত কৃপালনীকে জিজ্ঞাসা করলেন মুম্বইয়ের লোকেরা বাঙ্গালীদের নিয়ে কি ভাবে? জয়ন্তর উত্তর “দে ডোন্ট গিভ আ ফাক্”, বাঁচা গেল!
সত্যি কথা এমনিতে গুরুপাচ্য, কিন্তু এই সেশনটা জ্যানট্যাক বা মেট্রোজিলের কাজ করে গেছিল। তাই পরের সেশন শুরু হতে না হতেই রামচন্দ্র গুহ যখন এসে বললেন, “বাঙ্গালীরা সবসময় ভুল লোককে হিরো বানায়” তখন কৌতূহলই হল বেশী। এতদিন ধরে রামচন্দ্র গুহের লেখা পড়ে বা দেখে সবসময়ই মনে হয়েছে আড্ডা জমানোর জন্য ভদ্রলোকের স্টকে মালমশলা প্রচুর, দেখলাম এক্সপেক্সটেশন্স র্যাশনাল-ই ছিল। টপিক ছিল নির্বাচন ২০১৪, রাম গুহ প্রথমেই বললেন, “ভারতের নির্বাচন কমিশনারদের নিয়ে একটা সম্যক ধারণা না থাকলে নির্বাচনের ইতিহাস বোঝা মুশকিল”। আর সেই প্রসঙ্গেই এসে পড়ল সুকুমার সেনের কথা; না, ভাষাবিদ সুকুমার সেন নন, ইনি ভারতের প্রথম নির্বাচন কমিশনার। স্বাধীনতার পর পরেই জাতীয় নির্বাচন রাখার যে অন্যায় দাবী জওহরলাল জানিয়েছিলেন, তাকে যুক্তি দিয়ে খন্ডন করেন ইনিই। গণিতবিদ ভদ্রলোক পুঙ্খনাপুঙ্খ হিসেব করে দেখিয়েছিলেন ভারতব্যাপী নির্বাচনের প্রস্তুতিতে দরকার অন্তত তিনটি বছর, অনিচ্ছা সত্ত্বেও গাণিতিক যুক্তির বিরোধিতা করে উঠতে পারেননি জওহরলাল আর তাই ১৯৪৮ এর জায়গায় প্রথম জাতীয় নির্বাচন হয় ১৯৫১ তে। সুকুমার সেনের কথা আবার ফিরে এলে যখন প্রায় আধ ঘন্টা পর বিক্রম শেঠ তাঁর “স্যুটেবল বয়” থেকে পড়তে গিয়ে মনে করালেন দূরদর্শী ভদ্রলোক নজর দিয়েছিলেন প্রতিটি আপাততুচ্ছ ব্যাপারেও – তাই দু’হাত কাটা লোকেরাও যখন ভোট দিতে এসেছেন পোলিং অফিসাররা জানতেন নীল কালিটা শরীরের কোথায় ছোঁয়াতে হবে। রামচন্দ্র গুহের দৌলতেই অবশ্য ভারতীয় নির্বাচন নিয়ে আলোচনায় ঘুরেফিরে এল নানা বাঙ্গালীর কথা। শোনালেন জরুরী অবস্থার পরবর্তী ভোটের সময় সেন্ট স্টিফেন্সের ছাত্রদের ইন্দিরার বিরুদ্ধে ভোট দেওয়ার জন্য ক্যাম্পেন করেছিলেন এক বাঙ্গালী-ই। গুহ অবশ্য ক্ষমা চেয়ে নিলেন “স্বাভাবিক কারণেই সে আর এখন আমার বন্ধু নয়” – উল্লিখিত ছাত্রটি চন্দন মিত্র, বর্তমানে বিজেপির রাজ্যসভার সাংসদ। সঞ্চালক রুচির যোশীও ভেতরের গল্প জানেন, তাই গল্প শুধু চন্দন মিত্রতেই সীমাবদ্ধ রইল না, এসে গেল স্বপন দাশগুপ্ত এবং পরঞ্জয় গুহঠাকুরতার কথাও। তিন বন্ধুই পড়তেন কলকাতার লা মার্টিনীয়ার স্কুলে, সেখান থেকে একসঙ্গে পড়তে যান সেন্ট স্টিফেন্সে – চন্দন তখন ঘোষিত বামপন্থী, স্বপন ট্রটস্কাইট আর পরঞ্জয় অপেক্ষাকৃত দক্ষিণপন্থী। সাঁইত্রিশ বছর পর প্রথম দুজন চরম দক্ষিণপন্থী, পরঞ্জয়ের রাজনৈতিক মতাদর্শ প্রায় একই রয়ে গেছে আর তাই আপেক্ষিকতার হিসাবে তিনি এখন প্রায় বামপন্থী – নিয়তির ফের আর কাকে বলে।
আড্ডাবিলাসের মধ্যেই এবারেও কিন্তু রয়ে গেল বিলাপ – সোমনাথ চ্যাটার্জ্জী বোলপুর থেকে এসে পৌঁছতে পারেননি বলে নয়, চাই না – চাই না বলতে বলতেও সবাইকে প্রায় মেনে নিতে হল তখতে যাওয়ার জন্য সবথেকে প্রস্তুত দেখাচ্ছে মোদীকেই। আড্ডা যতই কলোনিয়াল স্মৃতিস্তম্ভ লাগোয়া বাগানে বসে হোক, সিংহভাগ শ্রোতা যতই লাল ঝান্ডাকে গাল পাড়ুন, শহরটার নাম যে কলকাতা – মোদীর ভারতবর্ষকে এখনো কল্পনা করা যাচ্ছে না। বিকল্পের খোঁজে বিলাপের মধ্যেই চলে এলাম, মঞ্চে তখন রাম গুহ তাঁর শৈশবে শোনা নির্বাচনী ছড়া শোনাচ্ছেন,
“জনসঙ্ঘ কো ভোট দো,
বিড়ি পিনা ছোড় দো,
বিড়ি মে তাম্বাকু হ্যায়,
কংগ্রেসবালা ডাকু হ্যায়।”
বাঃ, খুব সুন্দর বর্ণনা 🙂 মন ভরে গেল।
LikeLike
অনেক ধন্যবাদ 🙂
LikeLike