কয়েকদিন আগে বুদ্ধদেব গুহর ‘হলুদ বসন্ত’ পড়ছিলাম, যা লিখে তাঁর প্রেম সিরিজের জয়যাত্রার শুরু। এ উপন্যাস পড়ে সন্তোষকুমার ঘোষ বলেছিলেন “নীলাঙ্গুরীয়’র পর বাংলা কথা সাহিত্যে এমনতর প্রেমের উপন্যাস খুব কমই লেখা হয়েছে”। এসব কমপ্লিমেন্ট নিয়ে বিতর্কের মধ্যে যাচ্ছি না, তবে উপন্যাসটা পড়ে থাকলে জানাবেন কেমন লেগেছিল। আর যাঁরা পড়েননি অথচ বুদ্ধদেব গুহ পড়তে ভালোবাসেন তাঁদেরকে বলব ‘হলুদ বসন্ত’ আর তার ঠিক পরেই লেখা ‘খেলা যখন’ এই দুটোই পড়ে ফেলতে, বেশ ভণিতাবিহীন টান টান লেখা এবং যুবক বুদ্ধদেবের বেপরোয়া ভাবটা বেশ বোঝা যায়; আর হ্যাঁ, ‘খেলা যখন’ লেখা হয়েছে ঋতু গুহ আর ওনার রিলেশনশিপ নিয়ে, সেটা অ্যাডেড ইনসেন্টিভ হতে পারে।
একটু ধান ভানতে শিবের গীত হল, কিন্তু ব্লগই তো লিখছি, আড্ডাটাই মূল উদ্দেশ্য। এনিওয়ে, হলুদ বসন্ত পড়তে গিয়ে দেখলাম এক জায়গায় নায়কের জবানীতে বুদ্ধদেব বলছেন “দোলের দিন প্রতিটি লোকই হেরে যাবার জন্য মনে মনে প্রস্তুত থাকে। রূপসী বৌদিও যে কোনও অবাধ্য দেওরের কাছে হেরে যাবার জন্য মনেপ্রাণে হন্যে হয়ে থাকে।” আমি বুদ্ধদেবের প্রায় সমস্ত লেখাই পড়েছি, হঠাৎ মনে পড়ল রূপসী বৌদিদের প্রতি বুদ্ধদেবের এই আলাদা টানটা আরো বেশ কয়েকবার দেখতে পেয়েছি, যেমন ওনার ‘পুজোর সময়’ উপন্যাসের এক চরিত্র ভগাদা, উপন্যাসের নায়ক চাঁদুকে ফিসফিস করে জানিয়েছিলেন……কি জানিয়েছিলেন? পড়েই ফেলুন বরং, আগে থেকে বলে দিয়ে আপনার পড়ার আনন্দ মাটি করতে চাই না। তো বুদ্ধদেব একা নন, বৌদিদের নিয়ে এই রহস্যের বাতাবরণ আরো অনেকেই তৈরী করে গেছেন। একটা গল্পের উল্লেখ করতে চাই এখানে, রতন ভট্টাচার্যের ‘কৃষ্ণকীর্তন’, ১৯৬১ সালে দেশে বেরিয়েছিল। দেশ সুবর্ণজয়ন্তী গল্পসঙ্কলনে পেয়ে যাবেন। গল্পের শেষটা একটু তুলে দি,
“সেই স্তব্ধতায় রানীবৌদির চোখের দিকে তাকিয়ে রমেন হাসল। ‘রানীবৌদি, কাল সারারাত ঘুমুইনি।’ রানীবৌদি চোখ নামিয়ে বললেন ‘জানি!’। রমেন অবাক হয়ে বললে ‘জান? কি করে জানলে?’ ‘কাল সারারাত রকে বসে ছিলুম।’। এটাও পড়ে ফেলতে পারেন; এই নিদ্রাবিহীন রাত্রিযাপনের একটা ছোট্ট বর্ণনা আছে, বেশ দাগ কেটে যায়।
পয়েন্টটা হল বৌদিদের নিয়ে বাঙ্গালী যুবকের আগ্রহ আজকের নয় কিন্তু সে আগ্রহ যেন ক্রমশই অনুভূতি রহিত ঔৎসুক্যে পরিণত হচ্ছে। অনলাইন ফোরামে ফোরামে আলোচনার বহর দেখে মনে হচ্ছে শব্দটির যৌন টিপ্পুনি ব্যতীত অন্য কোনো কনোটেশনই নেই। বিশ্বাস না হলে বাংলায় একবার শব্দটা টাইপ করে গুগলে সার্চ করে দেখতে পারেন, তখন অবশ্য আঁতকে উঠে বলবেন না আগে কেন সতর্ক করিনি। মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হিসাবে ‘বৌদি’ শব্দটা মেয়েদের জন্য বড়ই ‘আন্- কুল’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মাঝ কুড়ি থেকে মধ্য চল্লিশ, ‘বৌদি’ বলে ডাকলে ভুরুটি কুঁচকোবেই। দুয়ের ফলাফলে বাংলা থেকে বন্ধুপ্রতিম, আড্ডাবাজ, প্রশ্রয়দাত্রী বৌদিরা বেবাক উধাও হয়ে গেছেন। দেবরকুল এর কুফল এক্ষুনি টের পাচ্ছে না হয়ত কিন্তু একদিন না একদিন ঠ্যালা বুঝবেই। বেকার দেওরকে হাতখরচ, প্রেমিক দেওরকে সাহস, বাপে তাড়ানো-মায়ে খেদানো দেওরকে প্রশ্রয় যোগানোর জন্য কেউ থাকছেন না, এ ভাবতেই বেশ আতঙ্ক হয়। অনাগতকালের যুবারা কাদেরকে হারাচ্ছেন একবার মনে করিয়ে দেওয়া ভালো!
১) নারায়ণী
মা মরা ছেলেদের চিরকালের ভরসা, নিজের মাও এতটা ভালোবাসতেন না হয়ত। ভালোবাসার খাতিরে নারায়ণীরা নিজেদের মাকে অবধি বাড়ি পাঠিয়ে দিতে পারেন যাতে ক্ষুদে দেওরের গায়ে আঁচটি না লাগে। তবে হ্যাঁ, বেশি বাঁদরামিতে মেজাজ গরম হতে পারে, তখন টানা তিন-চার দিন স্পীকটি নট! মাতৃসমা বৌদিরা যেরকম হন আর কি!
২) কমলা
অনার্স না পেলেও কমলা বৌদিরা গিফট দেবেন, কারণ তাঁদের দেওরদের থেকে ইন্টেলিজেন্ট ছেলেপুলে পৃথিবীতে নেই, পরীক্ষকরা বোঝেননি তো হয়েছেটা কি? তবে বাড়ির বাকি সবাই চাকরী এবং টাকা দেখে আহ্লাদিত হলেও, কমলা বৌদিদের মনে শান্তি নাই থাকতে পারে। কারণ, টাকা আনলেও সোমনাথরা মন মরা হয়ে আছে; শ্বাপদসঙ্কুল জন অরণ্যে লড়াই যে কত কঠিণ ব্যাপার, সে শুধু কমলা বৌদিরাই বোঝেন।
৩) চারুলতা
কে মাথার দিব্যি দিয়েছে যে বৌদিদের সর্বদা বয়োজ্যেষ্ঠা হতেই হবে? চারু্রা সমবয়স্কা, বৌঠান বলে ডাকলেও এনারা অমলদের সঙ্গে বসে বাগান বানানোর প্ল্যান করবেন, বায়না করবেন বাগান সংলগ্ন ঝিলে নীলপদ্ম এনে দিতে হবে বলে। এনাদের ছেলেমানুষীটা একটু বেশি কিন্তু দেবর অন্ত প্রাণ। তাদের জন্য জুতো সেলাই থেকে কবিতা পাঠ সব করতে পারেন। এর বেশি কিছু চাইবেন না, ওসব নাটক-নভেলে হয়।
৪)
বৌদিদের নাম জানা না থাকলেই বা কি? সময় সময় ওনারা সার্বজনীন বৌদি, শ্যাম হোক কি লালু – ভালোবাসায় কিছু ফারাক পড়ে না। পাড়াতুতো দেওরদের বেজায় প্রশ্রয় দেন, দরকার পড়লে তাদের হয়ে মিথ্যা কথা বলেন; সময় সময় পাড়ার মেয়েদের ম্যানেজ করার জন্যও এহেন বৌদিই ভরসা, বিটলে বুদ্ধি যোগানে সিদ্ধহস্ত। বোরিং পতিদেবতাটির থেকে দুষ্টু দেওরদের সঙ্গে সময় কাটানোতেই বেশী আগ্রহ।
৫) তপতী
এনারা একটু ন্যাগিং বৌদি, দেওররা যতই খ্যাঁচম্যাচ করুক না কেন, তাদের ভূতভবিষ্যৎ সব জেনে তবে শান্তি। কিন্তু দেওরদের ব্যবহারে এনারা রাগ করেন না, করেন খালি তাঁদের কাছে খবর চেপে গেলে – সে ভালো কি খারাপ যে খবরই হোক না কেন। ভালো চাকরি দুম করে ছেড়ে দেওয়ার খবর শুনে শুরুতে একটু কিন্তু কিন্তু করলেও, চাকরি ছাড়ার কারণটা জোরদার দেখাতে পারলে গয়না টয়না বেচে কবিতার ম্যাগাজিন ছাপানোর খরচ যোগাতে পিছপা হবেন না এনারা।
তাই বলছিলাম – বৌদিদিরা ফিরে আসুন, অবিলম্বে! আপনারা না ফিরলে শেষমেশ রইবেন কেবল সবিতা।