পাগলা সাহেবের খবর

Image

(উৎস – ‘লজিকমিক্স‘)

নিজেই বলে গেছিলেন “God, prevent me from sanity”; কথায় বলে পাগল আর জিনিয়াসে অল্পই তফাত হয়; সে দিক থেকে দেখলেও হয়ত পাগল বলা যায়। তবে এই ব্লগের টাইটল টা বোধহয় একজন গুণমুগ্ধ আদার ব্যাপারীর ভালোবাসার প্রতিফলন। ম্যাথেমেটিকাল লজিক নিয়ে আমার অবসেশন বহুদিনের, মুশকিল হল নিজের সীমিত জ্ঞানে এ প্যাশন নিয়ে চলার ঝক্কি অনেক। তাই রাসেলের ‘প্রিন্সিপিয়া ম্যাথেমেটিকা’ বছর ছয়েক ধরে পড়ে চলেছি (আপনারাও চেষ্টা করতে পারেন)! যাই হোক, এ চর্চা সূত্রেই পাগলা সাহেবের নাম প্রথম শুনি; ইনি ছিলেন আবার বারট্রান্ড রাসেলের প্রিয় ছাত্র, যদিও সম্পর্কটা পরে একটু অম্লমধুর হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু এনার কাজ এবং মানুষটিকে নিয়ে বিশদে জানার ইচ্ছে হল ‘লজিকমিক্স’ পড়ে (এ এক অনবদ্য বই, লেখা এবং রেখা নিয়ে আপনার যদি বিন্দুমাত্রও উৎসাহ থাকে তাহলে কিনে ফেলুন, ঠকবেন না।); আর জানার ইচ্ছে না হওয়াটাই অস্বাভাবিক, এত বর্ণময় চরিত্র ফিকশনেও চট করে খুঁজে পাবেন না – সোনার চামচ মুখে দিয়েই জন্মেছিলেন অথচ আজীবন চেষ্টা করে গেছেন পারিবারিক খ্যাতি এবং ধনসম্পত্তির থেকে  দূরে থাকার; এক বছর আগে লেখা শেষ করেছেন বিশ্বের শ্রেষ্ঠ দর্শনগ্রন্থগুলির একটি অথচ তার পর পরই ভিয়েনার এক প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষক হয়ে দিন কাটাচ্ছেন এবং দিব্যি আনন্দে আছেন; আবার কিছু দিন পর কেমব্রিজের প্রফেসর হিসাবে বিস্তর খ্যাতি (এবং কিছুটা কুখ্যাতি) কুড়োচ্ছেন অথচ প্রফেসরশিপটাই ছেড়ে দিলেন শুধু লেখালেখিটা মন দিয়ে করবেন বলে। এনাকে নিয়ে কবিতা লেখা হয়েছে, বিখ্যাত কিছু পেইন্টিং-এর ইন্সপিরেশনাল সোর্স ইনি, এনার কাজ নিয়ে তৈরী হয়েছে ধ্রুপদী সঙ্গীত এমনকি ব্লকবাস্টার থ্রিলারের প্রোটাগনিস্টদেরও দেখা গেছে এনার কাজের সূত্র ধরেই রহস্য সমাধান করতে।

থ্রিলারের রেফারেন্সটার আবার  আলাদা একটা তাৎপর্য আছে! এনার প্রফেশন নিয়ে বাংলায় এক শব্দে কিছু বলতে গেলে অধ্যাপক, বিদ্বজন, দার্শনিক কোনো কিছুই খাটবে না, বলা উচিত ‘সত্যান্বেষী’। আক্ষরিক অর্থেই সত্যের সন্ধান করে গেছেন সারা জীবন। গাণিতিক বাস্তব বলে আলাদা কিছু থাকতে পারে, এ কথা কিছুতেই মেনে নিতে পারতেন না।  ঋণাত্মক একের বর্গমূল যে শুধু গণিতের জগতেই বাস্তব, এহেন প্রপোজিশন ছিল এনার দুচোখের বিষ। বাস্তব জগত একটাই, গণিত তার বাইরে নয়। কিন্তু কিভাবে সেটা মেলান যায়? বোঝাই যাচ্ছে সে বড় সহজ কম্ম নয়, কারণ মেলানোর জন্য দরকার ‘চরম সত্য’। আর সেকাজ করার জন্য দরকার দার্শনিক তত্ব, মুশকিল এটাই যে সে তত্বও এর আগে কেউ দিয়ে যান নি। তাই থিয়োরি বলুন এবং তার অ্যাপ্লিকেশন, দুয়েরই গুরুভার বহন করতে হয়েছে এনাকে – এবং সে ভার বইতে গিয়ে মূল্য কম চোকাতে হয়নি। তাঁকে উন্মাদ বলা হয়েছে (এবং খুব একটা ভালোবেসে নয়), বলা হয়েছে তিনি বাড়বাড়ি রকমের আত্মম্ভরিতায় ভোগেন,  অভিযোগ আনা হয়েছে তাঁর ছাত্রদের চিন্তা করার ক্ষমতাকে তিনি ধংস করেছেন নিজের অতি অ্যাগ্রেসিভ লজিক খাটিয়ে, তাঁর গুরু মন্তব্য করেছেন ছাত্রের লেখা কোনো বুদ্ধিমান মানুষের পক্ষে পড়ে বোঝা সম্ভব নয় ইত্যাদি ইত্যাদি। ব্যক্তিগত জীবনের পরিপ্রেক্ষিতে কিছু অভিযোগের সারবত্তা নিশ্চয় আছে কিন্তু পেশাগত খুঁত বার করে তাঁকে সমালোচনা করার জায়গাটা দিনে দিনে কমে যাচ্ছে। তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা অনেক অভিযোগের মধ্যে একটা গুরুত্বপূর্ণ অভিযোগ ছিল সহজ জিনিসকে অনর্থক কঠিন করে দেখানো। স্বয়ং বারট্রান্ড রাসেল যেখানে দু’শ পাতা নিয়েছেন এক প্লাস এক দুই প্রমাণ করার জন্য সেখানে এটা বোঝাটা কষ্টকর নয় যে ম্যাথেমেটিকাল লজিকে আপাতসহজকে কঠিণ করে দেখানোটাই দস্তুর; কারণ সহজ ব্যাপারটা সবসময়েই ইম্পোজড, ধ্রুবসত্য ভেবে চ্যালেঞ্জ করি না বলেই বোধহয় মনে হয় সহজ। সাম্প্রতিক কালে এনার কাজ ধরে এগোতে গিয়েই কম্পিউটার সায়েন্টিস্টরা দেখেছেন কম্পিউটারকে পদার্থবিদ্যা বা জ্যোতির্বিদ্যা বোঝানর তুলনায় রূপকথা বোঝানো অনেক জটিল ব্যাপার। অথচ আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স নিয়ে ভাবার সময়ে প্রথমে বিজ্ঞানীরা ভেবেছিলেন রূপকথা দিয়ে শুরু করেই নিশ্চয় পদার্থবিদ্যায় যাওয়া উচিত।

গাণিতিক বাস্তব এবং দৃশ্যমান বাস্তবকে মেলানোর চেষ্টা নিঃসন্দেহে কঠিণ কাজ, বুদ্ধিজীবীদের পক্ষেও লজিকাল ফ্লো টাকে সবসময় অনুসরণ করা সম্ভব হয় না, তাই হয়ত এত সমালোচনা। কিন্তু এই প্রচেষ্টাটাই একটা মহৎ কাজ। এবং খুঁটিয়ে ভাবলে কিন্তু দেখা যাবে কাজটা সাধ্যাতীত নয়।

এইচ-জি-ওয়েলস এর সেই বিখ্যাত উপন্যাস ‘টাইম মেশিন’ এর শুরুটা মনে আছে? টাইম ট্রাভেলার আক্ষেপ করছেন যে জ্যামিতি আমাদের স্কুল-কলেজে শেখাচ্ছে, সেটা কতটা ভুল। বলা হচ্ছে চতুর্থ ডাইমেনশন অর্থাৎ সময়কে বাকি তিন ডাইমেনশনের সঙ্গে একত্রে ভাবতে পারা সম্ভব নয়। তাই আমরা বস্তুগত জীবনে তিনটে ডাইমেনশন নিয়েই মাথা ঘামাই। অথচ সামান্য গাণিতিক লজিক এ ফ্যালাসির সমাধান ঘটাতে পারে। আমরা কি এমন একটা কিউবের কথা ভাবতে পারি যেটা এক সেকন্ডের মধ্যে বিলীন হয়ে যাচ্ছে? না, পারি না। আমার চোখের সামনে টেবলের ওপর একটা কিউবকে দেখতে পাচ্ছি শুধু তার তিনটে ডাইমেনশন আছে বলে নয়, সেটা চতুর্থ ডাইমেনশন অর্থাৎ সময়ের রেফারেন্সেও দিব্যি থেকে যাচ্ছে বলে।

আরেকটা উদাহরণ দি – ঋণাত্মক রাশির সঙ্গে ঋণাত্মক রাশির গুণনে ধনাত্মক রাশি তৈরী হয়। স্কুলে কি ভাবে পড়ে এসেছেন ভাবুন একবার। এমন ভাবে পড়ানো হত (এবং এখনো হয়) যে মনে হওয়াটা স্বাভাবিক, এ একটা গাণিতিক বাস্তব। কিন্তু আমাদের নিজস্ব জগতে এর অস্তিত্ব বুঝতে পারা মুশকিল। কেন দুটো ঋণাত্মক রাশিকে গুণ করলে একটা ধনাত্মক রাশি তৈরী হবে? এ কি ম্যাজিক নাকি? অথচ গাণিতিক লজিক দিয়ে ভাবলে একটা সুষ্ঠু ব্যাখ্যা নিয়ে আসা অসম্ভব নয়।  গণিতবিদ ইজরায়েল গেলফান্ড এর সহজ একটা ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন –  পাঁচ ডলার করে তিনবার যদি আপনাকে ফাইন দিতে হয়, তাহলে আপনার ফাইন হল মোট পনের ডলার এবং যেহেতু আপনার পকেট থেকে গেল তাই এটা একটা ঋণাত্মক রাশি। কিন্তু কোনো কারণে যদি ফাইন নেওয়ার কেউ না থাকে, তাহলে তিনবারই আপনাকে ফাইন দিতে হল না ; আরেক অর্থে কতবার ফাইন দিলেন? নেগেটিভে তিনবার। তাহলে কিন্তু আপনার পকেটেই থেকে গেল পনেরো ডলার, অর্থাৎ একটি ধনাত্মক রাশি।

এবার কি মনে হচ্ছে না যে গাণিতিক বাস্তব-ও  আমাদের ধরাছোঁয়ার মধ্যেই থাকতে পারে?  হয়ত, হয়ত না। কিন্তু এটা নিয়ে ভাবিয়ে তুলেছেন বলেই লুডউইগ উইটজেনস্টেইন আমার ধন্যবাদার্হ। আবার লিখতে হবে ওনাকে নিয়ে, আজকের জন্য আপাতত এটুকুই।

পুনশ্চঃ উইটজেনস্টেইনের কাজ নিয়ে যে থ্রিলারটার কথা বলছিলাম, সেটাও বেশ উপভোগ্য। লেখক নিজেও গণিতবিদ। আর ওনার পি-এইচ-ডি টপিক? কেন, ম্যাথেমেটিকাল লজিক!

One thought on “পাগলা সাহেবের খবর

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s