বিয়ের পর পর-ই এক মুখরা প্রতিবেশিনী মাকে বেশ একটু কথা শুনিয়েছিলেন মায়ের বাড়ির তত্ত্বটা ঠিক জমেনি বলে। মা স্বভাবতই দুঃখিত, এদিকে শ্বশুরবাড়ি সাদা বাংলায় যাকে বলে একদম ‘কুল’, অথচ পাড়া-পড়শীর ঘুম হচ্ছে না। মনের দুঃখটা এক দেওরের সঙ্গে শেয়ার করে ফেলতেই, সে বলে উঠল “ওসব ন্যাকড়াবাজী একদম বাদ দিন বৌদি।”; মা কোনোদিনই নববধূ সুলভ আচার-আচরণে বিশ্বাস করতেন না। তাও একটু তা না না করে বলেই ফেললেন “ও আবার কি অসভ্য কথা ঠাকুরপো?”। কাকা তাতে বেজায় চমকালেন, বৌদি বকে দিয়েছেন বলে নয় – প্রথমত, বৌদি ‘ন্যাকড়াবাজী’ কথাটাই জানেন না দেখে আর দ্বিতীয়ত, ওই শব্দের মানেটা বোঝাতে হবে শুনে। ন্যাকড়াবাজী হল ন্যাকড়াবাজী, তার আবার মানে কি? কাকা তো তড়িঘড়ি কেটে পড়লেন, মা পড়লেন মহা সমস্যায়। হাওড়ার ঘটিদের বিস্তর ট্রেডমার্কড ‘সোয়্যার ওয়ার্ডস’ আছে বলে শুনেছিলেন বটে বিয়ের আগে কিন্তু মানে গুলো তো জানতে হবে , না কি? ভরসা করে সেদিন সন্ধ্যাবেলা জেঠিমা অর্থাৎ মার বড় জাকে জিজ্ঞাসা করে ফেললেন; শুনে জেঠিমার কি হাসি। তারপর মুখে আঁচল চাপা দিয়ে হাসতে হাসতে বললেন, “তুই পারিস লা! ওসব পুরুষমানুষী কথায় তোর কি?” ফল হল বিপরীত, পুরুষমানুষরা যে অনেক কিছুর সঙ্গে একাধিক শব্দেরও স্বত্ব নিয়ে বসে আছে সেটা ভেবেই মার পিত্তি জ্বলে গেল। রেবেকা ওয়েস্ট কে নিয়ে মায়ের কোনো আইডিয়াই ছিল না তবে স্পষ্ট ভাষায় বুঝিয়ে দিলেন যে ওসব পুরুষমানুষী আধিপত্য মুখ বুঝে সহ্য করা আর পাপোষ হয়ে থাকা একই ব্যাপার। জেঠিমা বেচারি পড়লেন মহা ফাঁপরে, শেষে মিনমিন করে বললেন “চটিস কেন, দাঁড়া বিন্তিকে শুধোই।” বিন্তি হল মা-জেঠিমার পাঁচ ননদের সেজ জন, মার সমবয়সীই বলা যায়। সেও সব শুনে হেসে খুন, তারপর চারদিক একবার দেখে নিয়ে বলল “মোটেই ওটা পুরুষমানুষী কথা নয়, বরং অমনি কিছু বলতে হলে ওটাকে মেয়েমানুষী কথাই বলা উচিত।” শুনে মার গালে হাত, জেঠিমা পুরো থ! বলে কি বেটি, অ্যাদ্দিনে একথাটা জানলাম না। মা একটু গলা খাঁকরানি দিয়ে বললেন, “মানে, যা ভাবছি কি তাই?”, বিন্তি ফচকে হেসে বলল “আবার কি!”। কিন্তু মানে টা কি দাঁড়াল? বিন্তির বক্তব্য ওসব তত্ত্ব-ফত্ত্ব নিয়ে পুরুষেরা মাথা ঘামায় না, তাই ওহেন অ্যানালজী। মা ভারী বিব্রত হলেন কিন্তু মনে মনে খুশি, অর্থটা তো উদ্ধার হয়েছে।
কিন্তু এক সপ্তাহের মধ্যে মার মেন্টাল পীস আবার উধাও। বড় পিসেমশাই আবার হাওড়ারই মানুষ, তাই তার সঙ্গে শালাদের ভারী জমে, কারণ কমন লিঙ্গো বেজায় বেশী। রবিবারের সন্ধ্যাতে তাসের আড্ডায় বেশ কাঁদো কাঁদো মুখে ঘোষণা করলেন এবার পুজোয় আর একসাথে মীরাট যাওয়া যাবে না (মীরাটে আমার ঠাকুমার বাপের বাড়ি, দু’বছর অন্তর চ্যাটার্জ্জী গুষ্টি অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস পুজো কাটাতে সেখানে যান), পুজোর দিন গুলো বাদ দিয়ে বস কিছুতেই ছুটি দিতে চাইছেন না, বহু অর্ডার ধরা বাকি। বাড়িতে রীতিমতন হৈচৈ শুরু হয়ে গেল, বিস্তর অনুযোগ-উপযোগে পিসেমশাইয়ের মুড চেঞ্জ হয়ে গেল। রণহুঙ্কারে জানালেন বসের ন্যাকড়াবাজী সহ্য করার বান্দা তিনি নন, ছুটি আদায় করেই ছাড়বেন। তুমুল সেলিব্রেশন, এদিকে মার মুখ ভারী; বিন্তির থিয়োরী তাহলে কেটে গেল।
অনেক ভাবনাচিন্তা করে ঠিক করলেন তাহলে বাবাকেই জিজ্ঞাসা করা যাক। বাবা শুনে আকাশ থেকে পড়লেন “সে কি, তোমাদের ঝাড়গ্রামে ও কথা কেউ বলে না? সাধে আর নামের মধ্যেই গ্রাম!” মা ফোঁস করে উঠলেন “খবর্দার, ঝাড়গ্রাম নিয়ে কিছু বলবে না। আর আমি জন্মেছি ঝাড়গ্রামে কিন্তু বড় হয়েছি কালীঘাটে, সে তো জানোই। ওখানেও এরম অসভ্য কথাবার্তা শুনিনি বাপু।” বাবাও রাগলেন, হাওড়ার শব্দকে অসভ্যও বলবে, আবার কৌতূহলও বেজায়, বড়ই কনসিসটেন্সির অভাব। যাই হোক, সম্মুখ সমরের মধ্যেই দিব্যি বোঝা গেল যে ন্যাকড়াবাজী অর্থে অনর্থক রোয়াবী ব্যাপারটাকেই মীন করেছিলেন পিসেমশাই। যতই যুদ্ধু চলুক, পতিবাক্য পরম বাক্য মেনে নিয়ে মা নিশ্চিন্ত ছিলেন যদ্দিন না পাশের বাড়ির খিটকেল কুন্ডুদের পারিবারিক ঝগড়ায় কান পড়ে গেল। কুন্ডুমশাই দোজবরে কিন্তু মোটেও সুগার ড্যাডি সুলভ আদিখ্যেতা নেই। পাড়ার সবাইকে সাক্ষী রেখে নিত্যি রাত দুটোর সময় জানান দিতে লাগলেন, পণ বিশেষ কম পড়েছে; শ্বশুরবাড়িকে বহুত সময় দিয়েছেন আর এসব ‘ন্যাকড়াবাজী’ চলবে না। তখন তো আর পাড়ায় পাড়ায় নারী সমিতি ছিল না, মা জেঠিমাকেই জিজ্ঞাসা করলেন ঝাঁটা, বেলনী, আশুতোষ দেবের ডিকশনারী এসব নিয়ে হামলা চালানো সমুচিত কিনা। ভাগ্য ভালো, হাওড়ার মস্তানরা বিশ্ববিখ্যাত এবং বেজায় বৌদি-নেওটা, কুন্ডু-গিন্নী অল্পদিনেই তাদের বেশ হাত করেছিলেন। তাদের জন্য মাকে আর হামলা চালাতে হয়নি, কুন্ডু-বুড়োও চুপ।
কিন্তু প্রধান সমস্যাটা তো সেটা নয়। কুন্ডুর শ্বশুর তো আর মেয়ের স্বার্থ বন্ধক রেখে দোজবরে জামাইয়ের ওপর রোয়াবী দেখাবে না, তাহলে মানেটা কি দাঁড়াল? বছর তিরিশেক হয়ে গেল, সে রহস্য এখনো সমাধান হয়নি। মা মাঝে মাঝে ছেড়ে দিতেন হাল, আবার নতুন উদ্যমে শুরু হত ভাষাচর্চা। কলকাতায় পারমানেন্টলি চলে আসার পরেই আস্তে আস্তে সে উৎসাহে ভাটা পড়ল। তবে ইদানীং আমার এটিমোলজিক্যাল ইন্টারেস্ট আছে শুনে আমার ওপর ভারটা পড়েছে।
ভ্লাদিমির নবোকভ একটা শব্দ বানিয়েছিলেন ‘উপ্সিল্যম্বডা’ বলে, নেহাতই ফাজলামি আর কি। কোনো মানে নেই, অনেক নবোকভ-বিশেষজ্ঞ বলে থাকেন ওটা গ্রীক অক্ষরদ্বয় ‘উপসাইলন’ এবং ‘ল্যাম্বডা’ কে মিলিয়ে বানানো শব্দ। কিন্তু মজা হল, যে যার মতন মানে ধরে নিয়ে সেন্টেন্সে ওটা ইউজ করতে পারে (যেরকম খানিকটা দেখা যায় ‘ডিক্টেটর’-এর রাজত্বে –
Kawthata ki “nawkhra” kawra theke esechhe? Tachharra oi nawkhrewali gaan, echharrao ” beshi nawkhra koris na to”, eisawb phrase theke mone hochhe hoteo paare. Akhon abar nokshabaji kawthatao dibyi cholchhe. 🙂
LikeLike
সন্ময়দা – গুড পয়েন্ট, হতেই পারে। তবে মজাটা হল প্রত্যেকে নিজের মতন করে একটা অর্থ বানিয়ে নিয়েছে, একটা আসল মানে থাকার থেকে এ সিস্টেমটা বেশ এন্টারটেইনিং!
LikeLike
দিল্লিতে বহুকাল থাকার সুবাদে আমার দৃঢ় ধারণা যে ন্যাকড়াবাজী কথাটা ‘নখড়া’ থেকে এসেছে, কিন্তু বাঙালীকরণে তার ফর্ম এবং অর্থ ‘নখড়া’ এবং ‘ন্যাকামি’ মিলিয়ে ন্যাকড়াবাজীতে রূপান্তরিত হয়েছে।
LikeLike
ন্যাকড়া অতি বাজে জিনিস! মনে হয়না ন্যাকড়াবাজী ওই মেয়েলি কেস থেকে এসেছে। আমরা গেঁয়ো ভাষায় কিন্তু “ক” এর বদলে “খ”-ই ব্যবহার করতাম, মানে জাস্ট “ন্যাখরা করছে”। ন্যাকড়াবাজী টা ঠিক চালু ছিলনা, কিন্তু এখন দেখি ওটা সমাজে ভালই চলছে! 🙂
LikeLike
Liluah ‘r lokjon ke “nakhra-mi ” korte dekhechhi ….serom i “nakhra-baji” > “”nyakra -baji” ar ki
LikeLike