M অক্ষরটার সঙ্গে রহস্য-রোমাঞ্চর একটা গভীর সম্পর্ক আছে! M নম্বর ওয়ানকে তো প্রায় সবাই চেনেন, দোসরা M কে এখনো না চিনে থাকলে আপনি জানেনও না কি হারাচ্ছেন। আমি আবার এক তৃতীয় M কে চিনি, যাঁর কার্যকলাপ কোনো অংশে কম রোমাঞ্চকর নয় – আজকে একটু সেই গপ্পোই হোক।
পি-এইচ-ডি ছাত্র হিসাবে মাঝে মাঝেই বেশ কিছু উঞ্ছবৃত্তির কাজ করতে হয়েছে, সেরকম একটা কাজ ছিল স্ট্যাটিসটিকস ডিপার্টমেন্টে গ্রেডারের কাজ। প্রতি হপ্তায় প্রায় দুশো ভাবী এঞ্জিনীয়ারের অ্যাসাইনমেন্ট চেক করতে করতে পিলে চমকে যেত; যেই ভাবতাম এরাই আরেকটা টুইন টাওয়ার বা গোল্ডেন গেট ব্রীজ বানাতে চলেছে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে কয়েকটা হার্টবীট মিস হওয়ার যোগাড়। ওই হৃৎকম্পটুকু ছাড়া কাজটা বলতে গেলে বেশ বোরিং, নেহাত কিছু এক্সট্রা টাকা পাওয়া যেত, তাই করা। প্রথম বছরটা এ ফ্রন্টে নিতান্তই পানসে কেটেছে। ২০০৮ এর শুরুতে জানতে পারলাম কোর্সটা এবার থেকে পড়াবেন প্রফেসর M, তখনো অবিশ্যি কোনো আইডীয়া ছিল না ভবিষ্যৎ-এর এক্সাইটিং দিনগুলো নিয়ে।
ক্লাস শুরু হওয়ার এক মাস আগে একটি বৈদ্যুতিন পত্র পেলাম M এর থেকে, দেখা করাটা আবশ্যিক। গিয়ে দেখি এক অসম্ভব ছটফটে মানুষ, আমাকে দেখেই অবশ্য এক গাল হাসলেন। তারপরেই আচম্বিতে প্রশ্ন “চোর ধরার ট্রেনিং আছে?” এরকম একটা প্রশ্নের সম্মুখীন হলে যে কারোরই ভেবড়ে যাওয়ার কথা, আমিও ব্যতিক্রম নই। তো-তো করছি দেখে খুব গম্ভীর মুখে বললেন, “পারবে তো বলো, নাহলে অন্য কাউকে দেখি।” উপরি টাকাগুলো ফস্কে যায় দেখে মরিয়া হয়ে বলে দিলাম পারব। আবার এক গাল হাসি, ‘এই তো চাই, এই তো চাই’ বলতে বলতে দেখি ফস করে একটা বিশাল ফোল্ডার খুলে ফেলেছেন। তাতে অলরেডী তিনটে মিডটার্মের প্রশ্ন তৈরী হয়ে বসে আছে, প্রত্যেকটার আবার চারটে করে ভার্সন। আমাকে বললেন “একশ আশিটা স্টুডেন্টের জন্য চারটে ভার্সন কি ঠিক ঠেকছে?” চারটেই আমার বেশ বেশি ঠেকছিল, সেটা বলতেই আঁতকে উঠলেন। খুব প্রাঞ্জল ভাষায় বোঝালেন যে আন্ডারগ্র্যাজুয়েটদের মত ধড়িবাজ স্পেসিমেন পৃথিবীতে খুব কমই আছে এবং M-এর জীবন তাদের চৌর্যবৃত্তি বন্ধ করার নিমিত্তে উৎসর্গীকৃত। চুরিবিদ্যা যে মহাবিদ্যা, সে ব্যাপারে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই এবং চারখানা ভার্সন-ও অ্যাপারেন্টলি বালির বাঁধের বেশী কিছু নাই হতে পারে।
সপ্তাহ তিনেক পরে আবার ডাক পড়ল, ঘরে গিয়ে দেখি খুব মন দিয়ে সবার হোমওয়ার্কের গ্রেড দেখছেন। আমাকে দেখেই প্রায় লাফ দিয়ে উঠলেন; তারপর খানিকটা সহানুভূতির গলায় বললেন “দেখেছ, তোমাকে নতুন পেয়ে কিরকম বোকাটা বানালো?” আমি যথারীতি ক্লুলেস। ভ্যাবলার মতন তাকিয়ে আছি দেখে বললেন “দেখো, দেখো – গ্রেড ডিস্ট্রিবিউশনটা দেখো! কি ভয়ঙ্কর নেগেটিভলি স্কিউড, মোড আর মিডিয়ান মীনের থেকে কত্তটা বেশী!” মোদ্দা কথা হল, ডাল মে জরুর কুছ কালা হ্যায়। আমারও একটু সন্দেহ হল, আফটার অল রজত কি অলিভিয়ারা শুধু ভারতবর্ষেই জন্মাবে, এরকম প্রোব্যাবিলিটি কত? রজত ছিল স্কুলের ব্যাচমেট – মাধ্যমিকের ইতিহাস পরীক্ষা শুরু হওয়ার আগে ওর কান্না দেখে রীতিমতন ঘাবড়ে গেছিলাম সবাই; পরে জানা গেল প্রাণপাত করে টুকে আনা নোটগুলোর সূচীপত্রটা নাকি কে লাস্ট মোমেন্টে ঝেড়ে দিয়েছে। এখন শের শাহ জামার কলারে বসে রাজত্ব করছেন নাকি অশোকের সঙ্গে হিপ-পকেটে সহবাস, সেসব পরীক্ষার টেনশনে মনে রাখাই দায়। অলিভিয়া আবার শুধু পরীক্ষার দিনগুলোতে পরত সালওয়ার-কামিজ। আর আমরা মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে দেখতাম ওড়নার ভাঁজ থেকে একে একে বেরিয়ে আসছেন অ্যাডাম স্মিথ, জন কেইন্স, পল স্যামুয়েলসন রা। যাই হোক, M গভীর অ্যানালিসিস করতে বসলেন, ভাবনাচিন্তা করে নিদান দিলেন শুধু বইয়ের অঙ্ক করতে দেওয়া হচ্ছে বলে টোকাটুকি বাড়ছে। অন্য প্রফেসররা এতদিন তাই করে এসেছেন, কিন্তু M কে ধোঁকা দেওয়া অত সহজ নয়।
অতঃ কিম? ঠিক হল পড়ানো হবে এক বই থেকে, আর প্রবলেমস দেওয়া হবে অন্য আরেক বই থেকে। বেটারা নির্ঘাত সলিউশন ম্যানুয়াল যোগাড় করেছে। খাটুনির চোটে দামড়া বাচ্চাদের মুখ গেল শুকিয়ে আর গ্রেডারের ছেড়ে দে মা, কেঁদে বাচি অবস্থা। সেই কোয়ার্টার দিব্যি চলল, M এর ফুর্তি দেখে কে! গ্রেড ডিস্ট্রিবিউশন-ও দিব্যি বেল শেপড হচ্ছে, স্টুডেন্টরাও শাপ-শাপান্ত করছে – M এর জন্য সোনায় সোহাগা।
গোল বাঁধল পরের কোয়ার্টার-এ গিয়ে। হতভাগারা আবার বেশী বেশী নম্বর পেতে শুরু করল। M এর ভুরূ গেল কুঁচকে, লাঞ্চ করতে ভুলে যেতে লাগলেন, TA আর গ্রেডারদের সঙ্গে মীটিং এর পর মীটিং হতে লাগল। শেষে ভদ্রলোক প্রত্যেক লেকচারের শেষে মুখে মুখে প্রবলেম তৈরী করে দিতে লাগলেন, বইয়ের অঙ্কের সঙ্গে সঙ্গে সেগুলোও ডিউ থাকল। চলল সে সিস্টেম মাস ছয়েক। তারপর আবার গ্রেড ডিস্ট্রিবিউশন দেখে তেনার মুখ গেল শুকিয়ে। এরা কারা রে? আবার ফুল মার্ক্স পাচ্ছে! তড়িঘড়ি মীটিং বসল, পাক্কা চার ঘন্টা আলাপ আলোচনার পর ঠিক হল একটা বিশাল কোয়েশ্চন ব্যাঙ্ক তৈরী হবে, সেখান থেকে আলাদা আলাদা কোয়ার্টারে র্যান্ডমলি প্রশ্ন তুলে দেওয়া হবে। মুশকিল হল ঘন্টা বাঁধার লোক আর পাওয়া যায় না। M ডিপার্টমেন্টে গ্র্যান্ট চাইলেন, বলা বাহুল্য সে গ্র্যান্ট মিলল না। American TA রা সপ্তাহে কুড়ি ঘন্টার বেশী কাজ হয়ে যাচ্ছে বলে প্রায় মুখের ওপরেই বলল করতে পারবে না। এরকম পরিস্থিতিতে সাধারণত গোবেচারা ভারতীয় ছাত্রছাত্রীরা শহীদ হয়। কিন্তু দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে যা হয় আর কি, আমিও পত্রপাঠ ইস্তফা দিলাম।
বছরখানেক পর হঠাৎই রাস্তায় দেখা। সেই আগের মতনই একগাল হাসলেন। তারপর খুব প্রাউডলি ঘোষণা করলেন “প্র্যাব, চীটিং সমস্যার ফাইনালি সমাধান হয়েছে, এবং এবারে পার্মানেন্ট ব্যবস্থা।” নিজের নামকে বেমক্কা খন্ডবিখন্ড হতে দেখেও রাগ হল না, কৌতূহলের চোটেই অস্থির। “কি কান্ড, বলুন বলুন প্লীজ কি করলেন”। M হাসলেন, এবারে বিজয়ীর হাসি “সব কোশ্চেন তুলে দিয়েছি ওয়েবসাইটে, উত্তর সমেত – এবার কি করবি পাজিগুলো? হুঁ হুঁ বাবা।” আমি হাঁ হয়ে আছি দেখে যাওয়ার আগে বলে গেলেন “চিন্তা নেই, ডিস্ট্রিবিউশন এখনো বেল শেপড।”
গ্রেডার না থেকেও ভারী চিন্তায় পড়ে গেছি সেই থেকে।